somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এশিয়ার বৃহত্তম রেল সেতু- এর ইতিবৃত্ত

১৫ ই জুলাই, ২০১২ বিকাল ৩:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশীতে অবস্থিত এশিয়ার বৃহত্তম রেল সেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এদেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের সাথে রেল যোগোযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এপারে ঈশ্বরদী সাঁড়াঘাট এবং ওপারে ভেড়ামারার দামুকদিয়া-রাইটা ঘাটের মাঝে সেতুবন্ধনের সৃষ্টি করেছে এই হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। আর নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে প্রমত্তা পদ্মা নদী।

এক সময় অবিভক্ত ভারতের পূর্ববঙ্গের সাথে কলিকাতার যোগাযোগ বাহন ছিল কেবল মাত্র জাহাজের মাধ্যমে। জাহাজগুলো নারায়নগঞ্জ বন্দর থেকে ছেড়ে সাঁড়া, দামুকদিয়া ও রাইটা ঘাট হয়ে কলিকাতা বন্দরে গিয়ে পৌছাতো। এ অঞ্চলের শাক-সবজি, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রকার কাঁচামাল কলিকাতা যেতো। এভাবেই এ অঞ্চলের সাথে কলিকাতার আত্বিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির পূর্বলগ্ন পর্যন্ত এ অবস্থা বলবৎ ছিল।

একদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য অপরদিকে পর্যটক তথা অবিভক্ত ভারতের পূর্বঞ্চলীয় রাজ্য আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তর পূর্ববঙ্গের সঙ্গে কলিকাতা দিল্লীর সহজ যোগাযোগের কথা বিবেচনা করে বৃটিশ শাসিত ভারত সরকার ১৮৮৯ সালে পদ্মা নদীর উপর দিয়ে সেতু তৈরির প্রস্তাব পেশ করে। ১৯০৮ সালে সেতু নির্মাণের মঞ্জুরি লাভের পর প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে বৃটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট গেইলস হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯০৯ সালে পদ্মায় সেতু নির্মাণের জন্য সার্ভে করা হয়। ১৯১০-১১ সালে প্রথম কাজের মৌসুম শুরু হলে ভয়াল পদ্মার দুই তীরে সেতু রক্ষী বাঁধ নির্মণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে মূল সেতুর কাজ শুরু হয় পরের বছর।

সেতুটির প্রস্তাবের উপর প্রথম প্রকল্প প্রণয়ন করেন স্যার এস, এম রেনডলস। শুধু সেতু নকশা প্রণয়ন করেন প্রধান প্রকৌশলী স্যার রর্বাট উইলিয়াম গেইলস। প্রথমে সেতুটির কাজ শুরু হয় বর্তমান স্থান থেকে ১ কিঃ মিঃ দক্ষিণে। প্রাথমিক কিছু কাজ হওয়ার পর স্থান পরিবর্তন করে বর্তমান স্থানে নিয়ে আসা হয়। সেতুতে রয়েছে মূল পনেরটি স্প্যান, যার প্রতিটি বিয়ারিংদ্বয়ের মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৩’শ ৪৫ ফুট এবং উচ্চতা ৫২ ফুট। প্রতিটি স্প্যানের ওজন ১ হাজার ২’শ ৫০ টন, রেললাইন সহ ওজন ১ হাজার ৩’শ টন। সেতুটিতে পনেরটি স্প্যান ছাড়াও দু’পাশে রয়েছে ৩ টি করে অতিরিক্ত ল্যান্ড স্প্যান। এ ছাড়াও দুটি বিয়ারিং এর মধ্যবর্তী দৈর্ঘ্য ৭৫ ফুট। সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৫ হাজার ৮’শ ৯৪ ফুট অর্থাৎ ১ মাইলের কিছু বেশি।

সেতুটি নির্মাণের ঠিকাদার ছিলেন ব্রেইথ ওয়ালটি এন্ড ক্রিক। সেতু নির্মাণের চেয়েও নদীর গতি নিয়ন্ত্রণ করা কম কষ্টসাধ্য ছিল না। প্রকৃত পক্ষে বড় সমস্যা ছিল প্রমত্তা পদ্মার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে স্থায়ীভাবে প্রস্তাবিত সেতুর নিচ দিয়ে যাওয়া। সেতু নির্মাণের ১’শ বছর পর আজও এ সেতু নির্মাণের কাজ বা রিভার ট্রেনিং ওয়ার্ক পৃথিবীর প্রকৌশলীদের নতুন ধরনের অনুপ্রেরণা যোগায়। ১৯১২ সালে সেতুর গাইড ব্যাংক নির্মাণ শুরু হয়। এই গাইড ব্যাংক ৪/৫ মাইল উজান থেকে বেঁধে আসা হয়। সে বছরই সেতুর গার্ডার নির্মাণের জন্য পাঁচটি কুপ খনন করা হয় এবং পরের বছর সাতটি কুপ খনন শুরু হয়। তারপর লোহা ও সিমেন্টের কংক্রিটের বিশাল বিশাল পায়াগুলো নির্মত হয়। এই সেতু নির্মাণ করতে পদ্মার উপর স্টিমার বার্জ নিয়ে আসা হয়।

সে সময় দিন-রাত কাজ করার পর ব্রিজ নির্মাণ ও সেতু রক্ষা বাঁধের জন্য মাটির প্রয়োজন হয় ১.৬ কোটি ঘনফুট এবং নদী নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন হয় ৩ কোটি ৮৬ লাখ ঘনফুট মাটির। মোট পাথর প্রয়োজন হয় ৩ কোটি ৮ লাখ ঘনফুট। মোট ইটের গাঁথুনির কাজ হয় ২ লাখ ৯৯ হাজার টন। মোট ইস্পাত ব্যবহৃত হয় ৩০ লাখ টন। মোট সিমেন্ট ব্যবহৃত হয় ১ লাখ ৭০ হাজার ড্রাম ফিল্ড সিমেন্ট। তৎকালীন হিসেবে সেতু তৈরির ব্যয় হয় মূল স্পানের জন্য ১ কোটি ৮০ লাখ ৫৪ হাজার ৭’শ ৯৬ টাকা। এটি স্থাপনের জন্য ৫ লাখ ১০ হাজার ৮’শ ৪৯ টাকা, নদী নিয়ন্ত্রণের জন্য ৯৪ লাখ ৮ হাজার ৩’শ ৪৬ টাকা। দুই পাশের রেল লাইনের জন্য ৭১ লাখ ৫৫ হাজার ১’শ ৭৩ টাকা অর্থাৎ সর্বমোট ৩ কোটি ৫১ লাখ ২৯ হাজার ১’শ ৬৪ টাকা ব্যয় হয়।

হার্ডিঞ্জ সেতুর বিশেষত্ব হচ্ছে এর ভিত্তির গভিরতা। বাংলাদেশের নরম পলি মাটিতে বড় স্প্যানের সেতু গড়তে ভিত্তির গভিরতা চাই প্রচুর। ভিত্তির জন্য দুটো কুয়ো বসানো হয়। একটি পানির সর্ব নিম্ন সীমা থেকে ১’শ ৬০ ফুট নিচে এবং অপরটি বসানো হয় ১’শ ৫০ ফুট নিচে। ১৫ নম্বর সেতু স্তরের কুয়ো স্থাপিত হয়েছে পানির নিম্ন সীমা থেকে ১’শ ৫০ দশমিক ৬০ ফুট নিচে এবং সর্বোচ্চ সীমা থেকে ১’শ ৯০ দশমিক ৬০ ফুট অর্থাৎ সমুদ্রের গড় উচ্চতা থেকে ১’শ ৪০ ফুট নিচে। সেতু তৈরিকালীন সারা পৃথিবীতে এ ধরনের ভিত্তির জন্য এটিই ছিল গভিরতম।

১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকল্পটিতে কর্মী সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৪’শ। এই ২৪ হাজার ৪’শ শ্রমিকের দীর্ঘ ৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ১৯১৫ সালে সেতু নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ওই সময়ে ইংরেজি নবর্ষের দিনে অর্থাৎ ১ জানুয়ারি ১৯১৫ সালে ১ ডাউন লাইন দিয়ে প্রথম চালু হয় মাল গাড়ি। দুই মাস পরেই ৪ মার্চ ১৯১৫ সালে সেতুর উপর ডবল রেল লাইন দিয়ে যাত্রীবাহী গাড়ি চলাচলের উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভাইসরয় লড হার্ডিঞ্জ যার নামে বর্তমানে সেতুটির নাম করণ হয়েছিল হর্ডিঞ্জ সেতু।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী পশ্চাদাপসরণের মুখে ব্রীজের স্প্যানের ১২ নং স্প্যানটিতে বোমার আঘাতে ধ্বংস করে। আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ১৫ নং স্প্যানটির ক্রসগাডার ও দুটো স্ট্রিকারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া দুই নং সেতু স্তরের উপরের স্পাতের ট্রাসেলটিও সেলের আঘাতে বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রহস্ত হয়।

দেশ স্বাধীনতার পর শুরু হয় ১২ নং স্প্যানের উদ্ধার কাজ ও সেতু মেরামত। ব্রিটিশ সরকার অতিদ্রুততার সঙ্গে তাদের নিজ খরচে বিশ্ব সংস্থার মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত জাহাজ উদ্ধারকারী কোম্পানি সেলকোকে দিয়ে উদ্ধার কাজ করেন। উল্লেখ্য হাডিঞ্জ ব্রিজ পূণঃনির্মাণের কাজে যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে ভারতের পূর্ব রেলওয়ে মন্ত্রী এইচ কে ব্যানার্জী, চিপ ইঞ্জিনিয়ার আর কে এম কে সিংহ রায়, ডভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার ডিজাইন শ্রী পিসিজি মাঝি উল্লেখ্য যোগ্য। যুদ্ধ বিধ্বস্ত তৎকালীন বাংলাদেশে রেলওয়েকে যারা নবজীবন দান করেন তারা হচ্ছেন তৎকালীন বাংলাদেশ রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান আঃ মুহিত চৌধুরী, মেম্বরর এম এ গফুর ইঞ্জিনিয়ার, মেম্বর সৈয়দ মর্তুজা হোসেন প্রমুখ। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পূণঃনির্মানের কাজে বাংলাদেশ রেলওয়ের আরও যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে চিফ ইঞ্জিনিয়ার আমজাদ আলী, এম রহমান, ডিভিশনাল সুপারেনটেনডেন্ট সৈয়দ হোসেন এবং ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার এম মুনাফ।

বহু ত্যাগ ও পরিশ্রমের ফলে আবার প্রমত্তা পদ্মার উপর দিয়ে রেলপারাপার শুরু হয় ১২ ই অক্টোবর ১৯৭২ সালে। বর্তমানে বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অন্যতম। প্রতিদিন সকাল থেকে দূরদূরান্তের বহু মানুষ এবং বিদেশী পর্যটক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দেখতে আসেন। শীত মৌসুমে এখানে পিকনিক করতে আসেন অনেকে। বর্ষার সময় প্রমত্তা পদ্মা নদীর ভয়াল রুপ মানুষের হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার করে। জেলেদের জালে ধরা পড়ে মাছের রাজা রুপালী ইলিশ। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনাথী হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিচে এসে এ দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আল্লাহর সাহায্য

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৫ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪০



দুই মেয়ের পরীক্ষা বিধায় আমার স্ত্রীকে লক্ষ্মীপুর রেখে আসতে গিয়েছিলাম। বরিশাল-মজুচৌধুরীর হাট রুটে আমার স্ত্রী যাবে না বলে বেঁকে বসলো। বাধ্য হয়ে চাঁদপুর রুটে যাত্রা ঠিক করলাম। রাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডয়েজ ভেলে'র প্রকাশিত এই প্রামাণ্যচিত্রটি বেশ উদ্বেগজনক

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৫ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন বাহিনী থেকে প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকান্ডে যুক্ত সৈনিকদের ইউ.এন. এর পিস কিপিং মিশনে পাঠানোর বিষয়ে ইউ.এন. এর কর্মকর্তাগণ বেশ উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে ডয়েচ ভেলে ক'দিন আগেই একটি প্রামাণ্যচিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুলের চিন্তার কাবা প্রাচ্য নাকি পাশ্চাত্য?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে মে, ২০২৪ ভোর ৫:০৫


কাজী নজরুলের বড় বিপত্তি তিনি, না গোঁড়া ধর্মীয় লোকের কবি আর অতিমাত্রায় বামের কবি, না হোদাই প্রগতিশীলের কবি। তিনি সরাসরি মধ্যপন্থীর। অনেককেই দেখি নজরুলের কিছু কথা উল্লেখ করে বলেন কাফের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘূর্ণিঝড় রিমাল সর্তকতা।

লিখেছেন কাল্পনিক_ভালোবাসা, ২৬ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩

প্রিয় ব্লগারবৃন্দ,
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় রিমাল প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে এবং ইতিমধ্যে বাংলাদেশের উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোর ব্লগারদের কাছে যদি স্থানীয় ঝড়ের অবস্থা এবং ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে চিরতরে যুদ্ধ বন্ধের একটা সুযোগ এসেছিল!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৬ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৩


মনে হয় শুধু মানুষের কল্পনাতেই এমন প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন সম্ভব- যদি বাস্তবে হত তবে কেমন হত ভাবুন তো?
প্রত্যেকটি দেশের সমস্ত রকমের সৈন্যদল ভেঙে দেওয়া; সমস্ত অস্ত্র এবং সমর-সম্ভার, দুর্গ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×