এখনও দশ মিনিট আছে , ডাব্লিউ এইচ স্মিথ এর সামনেই দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি আরও কিছুক্ষন পায়চারী করব। এইদিকটা থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়।আজকের দিনে হাতে পিন্ক রোজ নিয়ে বেশী ঘুড়তে ইচ্ছে করছে না। লোকজন মাঝে মাঝে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে।
গতকাল রাতে সবে কাজ শেষে বাড়ী ফিরেছি, তখনই ফোন। এতো রাতে দেশ থেকে ফোন , কোন খারাপ কিছু না তো । ভয়ে ভয়ে রিসিভ করলাম। ওপাশে দিপ্রার কন্ঠ। এতো রাতে ও সাধারনত ফোন করে না । কি করেছে পাগলীটা কে জানে! - কি ব্যাপার সব ঠিক আছে তো?
- হ্যা সব ঠিক আছে। শোন, কাল আমি তিনটার দিকে ল্যান্ড করব,তুমি থেকো। বাকী কথা কাল হবে। এখন তুমি কাজ থেকে ফিরেছো রেস্ট করো।
আমি কি করবো কিংবা কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। জানি ওকে বলেও লাভ নেই, মাথায় একটা কিছু ঢুকলে না করা পর্যন্ত শান্তি নেই। কয়েকদিন আগেই কথা হচ্ছিল- সামনে ১৪ই ফেব্রুয়ারী । বললাম আমার জন্য কি গিফ্ট কিনেছো? - কি চাই তোমার বল? - তোমাকে, ইস্ এমন যদি হতো দিনটা আমরা একসাথে কাটাচ্ছি তাহলে কেমন হতো বলোতো? তোমার কি চাই বল? ওপ্রান্তে নীরব দিপ্রা । আমি একটু নরম গলায় বললাম - কি হল , বল কি চাই? অনেকক্ষন পর বলল - তোমাকে। - আর কয়েকটা মাস দেখতে দেখতে কেটে যাবে, তারপরতো আসছি তোমার কাছে।... কাজের ব্যস্ততায় গত দুদিন কথা হয়নি। এরই মধ্যে ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। মেয়েটা যে কিনা, পুরা পাগল! আমি হচ্ছি কঠিন বাস্তবাদী, এক যুগেরও বেশী পরবাসে থাকলে যা হয়। আর দিপ্রা হচ্ছে আমার বিপরীত,ওর সবকিছুর বিচার আবেগ দিয়ে। বলে - ভালবাসায় যদি আবেগই না থাকলো ওটাতো ভালবাসা না ,সমঝোতা। তোমাকে আমি ভালবেসেছি , বিয়ের জন্য পাত্র ঠিক করিনি। ...ওকে বোঝাতে পারে এমন সাধ্য কার আছে! দিপ্রার সাথে পরিচয়টা হয়েছিল হঠাৎ করেই। প্রায় বছর খানেক হবে কাজ থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় বসে অলস সময় কাটাচ্ছি । এক বিকেলে কিছুই করার নেই,মনটাও এলোমেলো । ঢুকলাম চ্যাট রুমে। সব ছোট ছোট ছেলে মেয়ে, আমি যেন বেমানান। অতনুর ফোনের জন্য অপেক্ষা করছি,ও ফোন করলেই জিমের জন্য বের হব। এর মাঝে চোখ পড়ল একটা নিকে। শেষের কবিতার নায়িকা - লাবন্য । নক করলাম । গতানুগতিক কথা চলছে। ঝগড়ায় ওস্তাদ। একটা লিখলে পাল্টা জবাব দেয়। বেশ এনজয় করছিলাম। এক সময় বললাম - ফোন নাম্বারটা কি পেতে পারি? - না,প্রথম পরিচয়ে নাম্বার দেয়া আমার পছন্দ না। আমিও ছাড়বার পাত্র নই,জেদ চেপে বসেছিল আজ নাম্বার না নিয়ে আমি যাবনা। সেও কম জেদী না । যতই কথা চলছে ঘুড়ে ফিরে আগের জায়গায় , নাম্বার দিবে না। শেষ চেষ্ঠা মনে মনে বললাম। - আমি জাস্ট দু মিনিটের জন্য কথা বলবো , তারপর তোমার ভাল না লাগলে বলবনা । এবার একটু নরম হলেন। নাম্বার দিলেন তবে লাস্ট ডিজিট গোপন রেখে আর বললেন - প্রথম দিনেই যেহেতু নাম্বার পেয়ে গেলে সো একটু কস্ট করে দেখো । কি আর করার। এই মেয়ে কারও ঘাড়ে পড়লে খবর আছে। নাম্বার ঘুড়াতে ঘুড়াতে অবশেষে পাওয়া গেল । অদ্ভুত আদুরে আর মিষ্টি গলা ,কথাও বলে বেশ গুছিয়ে । বোঝা গেল আমার সাথে কথা বলে ওর ভাল লাগেনি। কারন আমি হর হর করে কথা বলি আর গোছানোতো কোন দিনই সম্ভব না। তবুও বললাম - কাল ফোন করলে কথা বলবে তো? - এক্সপেনসিভ কনভারসেশন সো বলবো। বলে হাসতে লাগলো । মেয়েটা হাসলে মনে হয় অনেকগুলো রেশমী চুড়ি এক সাথে বেজে উঠছে। আমি নিজেই কি এমন ভেবে নিচ্ছি নাকি আসলেই সত্যি কে জানে!
আচ্ছা ও দেখতে কেমন হবে ? জানতে চাওয়াতে বলেছিল - কালো, মোটা , বেটে।আবার নাকি চশমাও পড়ে। মনে হয় বানিয়ে বলেছে। বানিয়ে বানিয়ে বেশ আগাতে পারে। নিজের নামটাই তো বানিয়ে বলেছিল। হয়তো প্রথম পরিচয়ে বলতে চায়নি। যে কিনা এতো সুন্দর করে কথা বলে সে দেখতেও নিশ্চয়ই সুন্দর। আজও মনে পড়ে - কিছুটা আশঙ্কা, কিছুটা চাপা উত্তেজনায় সেদিন আমার নিদ্রাদেবী কোথায় যে পালিয়েছিল কে জানে! রাত দুটা - আড়াইটা -পৌনে তিনটা ঘড়ির কাটা এতো ধীরে ধীরে যে কেন ঘুড়ছে , মনেহচ্ছে টেনে টেনে ঘুড়িয়ে দেই। এতোক্ষনে ও নিশ্চয়ই ঘুম থেকে উঠে গেছে । আর দেরী করা যায় না । রিং করলাম। ওপাশ থেকে ঘুম ঘুম কন্ঠে - হ্যালো বলে উঠতেই বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠল। - ঘুমাচ্ছি্লে? - হুম্- আমি কি রেখে দিব? - না, বলো - তুমি কি অনলাইনে আসতে পারবে? - ২০ মিনিট, ঠিক আছে?
- আচ্ছা
সেই বিশ মিনিট আমার কাছে ২০ ঘন্টারও বেশি দীর্ঘ মনে হয়েছে। কেন এমনটা হয়েছিল কে জানে? ওকে দেখার জন্য, নাকি মনের ভেতরের সেই ভয় যদি দেখতে ভাল না হয়! আমি নিজেওতো বানিয়ে বলেছি - মাথার চুল গোনা যাবে, ভুড়ি আকাশে ঠেকেছে, ডিভোর্স। অদ্ভুত মেয়ে বলে কিনা - ডিভোর্স হলে সমস্যা নেই কিন্তু ম্যারেড হলে কথা বলবনা। কেন, বলতেই বলল- কোন নারীর দীর্ঘ শ্বাসের কারন আমি হতে চাইনা।
সেদিন বিশ মিনিটের অপেক্ষার পর দেখে মনে হয়েছে, ওর জন্য আমি হাজার বছর অপেক্ষা করতে পারি। এরপর অনেকটা সময় কেটে গেছে । মাইলের পর মাইলের দূরত্ব পেরিয়ে এখন অনেক কাছাকাছি। মান অভিমানও যে হয়নি তা নয়। প্রথম অভিমান পর্বটা হয়েছিল ২৫শে ডিসেম্বর। বন্ধুরা মিলে আগে থেকে প্ল্যান করে রেখেছিল সবাই মিলে আমার বাসায় আসবে তারপর রাতে সেন্ট্রালে বের হব। কিন্তু কেন যেন আমার যেতে ইচ্ছে করছেনা । শরীর খারাপের কথা বলে সবাইকে বিদায় দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন ও ঘুম থেকে উঠবে। আজ না হয় একটু আগেই উঠল। ওর সকালের ঘুম ঘুম কন্ঠটায় একটা যাদু আছে। ২৫ মিস করা যায় কিন্তু ওটা মিস করা যায়না। কথা বলে যথারীতি অনলাইনে আসতে বললাম। দুই মিনিট বলে বিশ মিনিট বসিয়ে রেখেছে। ভাবলাম চলে যাই আবার ঠিক করলাম অনলাইনে থাকব কিন্তু কথা বলব না। এলেন উনি ঠিক এক ঘন্টা পর। - সরি, আমার হাবটা কাজ করছিল না তাই লেট হলো। - কি হলো বললাম তো সরি। ওপাশ থেকে দেখি কোন লিখা আসছে না । বললাম - নাটক দেখি। - ঠিক আছে, দেখা শেষ হলে বলো। আমি আছি।....আরও দশ মিনিট সময় নিয়ে বললাম - শেষ। একটা টেক্সট করলেওতো হতো। - আসলে আমি ভাবছিলাম এইতো হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সময় লেগে গেল।
ওটাই ওর সাথে অনেকটা সময় নিয়ে রাগ করে থাকা। না ভুল হয়ে গেল আরও একটা দীর্ঘ সময় ছিল সেটা -আটদিন। থার্টি ফার্স্ট নাইটে কথা বলছি, মাঝে মনে হলো এদিকে ওর মনযোগ নেই,কি কারনে যেন মন খারাপ। অনেক জেরার পর জানা গেল ওর কাজিনরা বাসায় এসেছে এক সাথে মজা করবে আর ও দরজা বন্ধ করে আমার সাথে কথা বলছে। এতে সবাই মাইন্ড করেছে। - আমাকে বল্লেই হতো । তুমিতো এখন স্কুলে পড়না, তাই না? একটু বুঝে চলতে শেখ। রাগটা বোধ হয় একটু বেশীই হয়ে গিয়েছিল। ও চুপ করে ছিল কোন কথাই বলেনি। আমার নিজেরও মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল । সেদিন আর কথা হয়নি। পরের দিন সকালে উঠে ওর কোন এস.এম.এস পেলাম না । যা ও কখনও ভুলে যায়না। আমার রাগ কেন যেন আরও বেড়ে গেল। দেখি কয়দিন এভাবে থাকে। এভাবে আটদিন চলে গেল কিন্তু ও কোন যোগাযোগ করছেনা ।
এক সন্ধ্যায় ফোন দিয়ে বসলাম। - কেমন আছো? ওপাশ থেকে কোন কথা নেই। - কি হলো? ভাল আছো? - না আমি ভাল নেই, তুমি এতদিন ফোন দাওনি কেন?- তুমি সেদিনের পর যোগাযোগ করনি তাই ভাবলাম তোমাকে আর বিরক্ত করবনা। - তুমি জানো, আমি তোমাকে কতটা পছন্দ করি,তার পরও তুমি আমার সাথে এমন কর কেন? ওপাশে কন্ঠটা ভারী হয়ে আসছে। বুঝতে পারলাম কাঁদছে।- ঠিক আছে, আমারই ভুল, মাফ চাইছি। এবার মাথা ঠান্ডা হয়েছে? - হুম।
এর মধ্যে আমাদের দুজনেরই ছুটি শেষ হয়েছে। কাজের ব্যস্ততায় কথা কম হয় কিন্তু সম্পর্কটা আরও দৃঢ় হয়েছে। আমাদের প্রফেশন এক হওয়ায় আমাকে ও অনেক হেল্প করে। প্রজেক্ট নিয়ে আমার মাথা গরম থাকলে আমার সব প্রেজেনটেশন ও রেডী করে দেয়, অনেক জটিল বিষয়গুলো সহজ সমাধান যেন ওর কাছে রেডী থাকে। তবে ফেলে আসা ছুটির সময়গুলো খুউব মিস করি। টানা ৪/৫ ঘন্টা কথা, কিভাবে যে সময় পার হয়ে যেত বুঝতেই পারতাম না। ওকে কতবার বলি এখানে চলে আসার জন্য কিন্তু ওর সেই এক কথা - ভীন দেশে স্বর্নলতা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে নিজ দেশে শ্যাওলাও ভাল। কে কাকে বোঝাবে! আমি জানি আমার জন্য বাসায় ওকে অনেক যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কিন্তু মুখ ফুটে বলবেনা কিছুই। জানতে চাইলে প্রসঙ্গ পাল্টায়। আমার খুব ভয় হয় ওর এই পাগলামো নিয়ে, কখন যে কি করে বসে কোন ঠিক নেই। এইযে, আজকে আসবে কিছুই জানায়নি, কে জানে কিভাবে সব ম্যানেজ করেছে। তবে এবার ওকে বন্দী করব , বাম পকেটেই আছে আজ সকালেই কিনেছি ফিঙ্গার রিংটা। গোলাপী গোলাপগুলো ওর জন্যই। একদিন এক বন্ধুর বাসায় যাব নতুন বউ দেখতে। দিপ্রাকে বলতেই বলল- কিছু নিয়েছো?- হ্যা
- কিছু পিন্ক রোজ নিয়ে যেও। বললাম - আমি যাকে তাকে পিন্ক রোজ দেই না।- আমাকে দিবিতো? হেসে বললাম - জানিনা। ও ছাড়বার পাত্র নয়, বলল- তোর কয়টা লাগবে বল? - আমার কিছু লাগবেনা, শুধু তুই পাগলামো করিস না। ওর পাগলামোর কোন শেষ নেই,একবার কাজের চাপে তিনদিন ফোন করতে পারিনি তখন ওর মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার মানেই হয়না। সব কিছু ওর কাছে শব্দহীন আর ফ্যাকাশে লাগে। আমি নিজেও ওকে প্রচন্ড ভালবাসি কোন সন্দেহ নেই আর তাই ওকে নিয়ে খুউব ভয়ে থাকি।
ভাবনার মধ্যে দিয়ে কখন যে সময় পার করে দিলাম টেরই পাইনি। যাত্রীরা আসতে শুরু করেছে।এতো মানুষের ভীরে আমার ও কোথায়! সামনে আগাই তা না হলে বলবে - এখানে টঙ হয়ে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমার হয়েছে মরন।
- কি হলো আবার কাকে খুঁজছো? ..পিঠের মধ্যে কে যেন ঘুষি বসিয়ে দিয়েছে।
- একি! তুমি কখন এলে? আমিতো খেয়ালই করিনি।
- তা করবে কেন? সব মানুষ তাকিয়ে আছে আর উনি চোখে হেজাব পড়ে আছেন।
আমি অপলক চেয়ে আছি ওর দিকে। অদ্ভুত মায়াবী চোখ , সরু নাক আর রেশমী চুল। পড়নে লাল শাড়ী, হাতে লাল রেশমী চুড়ি। এতো সুন্দর!! যেন স্বপ্নপুরী থেকে কোন অপ্সরা নেমে এসেছে আমার ভুবনে।
(চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১:৪৭