somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টুপ করে ডুবে গেল শমী

১৪ ই জুলাই, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বন্ধুরা ওকে মুটকো বলে ডাকতো, আমরা ডাকতাম এন্ড্রয়েড রোবট বলে। আটশাট জামা পরে, পেছনে একটা স্পোর্টস ব্যাগ লাগিয়ে ডানে বামে না তাকিয়ে হাটতো। বলতে গেলে একলা একলাই চলতো আমাদের শমী। গত বৃহস্পতিবার এভাবেই শরীফ মাহমুদ শমী সমগ্র সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে কাঁদিয়ে একলা একলাই চলে গেল না-ফেরার দেশে।

হলে আমি যে রুমটাতে থাকি সেখানে জুনিয়র ছেলেদের আনাগোনা অনেকটাই বেশী। আমার টেবিলের পাশে একটা স্টোর খাট আছে। দুনিয়ার আবর্জনা দিয়ে ভর্তী। সবাই এসে ঐ খাটেই বসে। শমী কয়েকদিন আগে এসে আমার কছে বলল-“ভাইয়া এখানে একটু বসি?” আমি বললাম-“না, এখন ব্যাস্ত পরে কথা বলব”।
সত্যি কথা বলতে শমীর প্রতি রাগ ছিল আমার। আমাদের ভাঙ্গা-চোরা সাংবাদিক সমিতিটাকে দাঁড় করাতে আমাকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। অতি উৎসাহী নতুন কিছু শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে এসেই বিভিন্ন সংগঠনে যোগ দেয়। সময়ের সাথে সাথে তাদের উৎসাহ কমে আসে। তখন বিপদে পরে সংগঠনগুলো। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি এমনি ভাবে বিপদে পড়েছিল শমীসহ আরো কিছু অতি উৎসাহিতদের জন্য। আমি কাউকে কিছু বলিনি। শমী সেদিন এসে বলল-“ভাইয়া প্লিজ আমাকে আরেকবার সুযোগ দিন, এবার আর ভুল হবে না।” আমি বললাম-“ঠিক আছে, দিব। তবে তার আগে আমার কাছে তোমাকে পাঁচটা নতুন রিপোর্ট জমা দিতে হবে।”
সন্ধ্যাবেলা একটি রিপোর্ট নিয়ে শমী হাজির। মাৎস্য-বিজ্ঞান অনুষদের ক্লাসরুম সংকট। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল, ডিন স্যারের বক্তব্য ছিল না। আমাকে অনুরোধ করল-বক্তব্যটা এনে দিতে হবে। সেদিন আরো বলল-কোন বন্ধুর সাথে নাকি ওর ঝগড়া হয়েছে। কিছু টাকাও চাইল। আমার মানিব্যাগও প্রায় শূন্য, তাই দিতে পরি নাই।
পরদিন শমীর আর দেখা নেই। শমীকে সাথে নিয়ে অডিটরিয়ামের দূরাবস্থা নিয়ে রিপোর্ট করবো -পাত্তা নেই তার। পরদিন শমী সকালে এসে বলল-“ভাই আজ আমাদের অনুষদের প্রোগ্রামের কাভারেজের সময় আমাকে সাথে নিতে হবে।” আমি ওর বোকা বোকা হাসি দেখে আগের দিনের রাগ ভুলে গেলাম- “ঠিক আছে, চলো।”
গত বুধবার একটি জাতীয় দৈনিকে শমীর প্রথম রিপোর্ট প্রকাশ পেল। ছবি সহ ছোট্ট রিপোর্টটি শমীর গাল ভরা হাসি এনে দিল। পেছনে স্পোর্টস ব্যাগ ঝুলিয়ে হাতে করে তার রিপোর্টটি রাস্তায় যাকে পায় তাকেই দেখায়। আমি সেদিন আমার ফেইসবুক এ্যাকাউন্ট থেকে রিপোর্টটি প্রকাশ করায় সে কয়েকবার আমাকে ফোন করে ধন্যবাদ দিল।
বৃহ্স্পতিবার। কৃষি অনুষদ প্রথম ব্যাচ তাদের শিক্ষা সমাপনী উৎসব পালন করবে। সকাল থেকেই সাজ সাজ রব। আমিও প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। উৎসব আয়োজন করতে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। শমী সকাল থেকেই স্যারদেরও চেম্বারে চেম্বারে গিয়ে গিয়ে তার প্রথম প্রকাশিত রিপোর্টটি দেখাল। বেলা সারে বারটায় শমী আসল আমাদের অনুষদ ভবনের সামনে। চোখগুলো ছোট ছোট করে আমার কাছে আবদার করলো-“ভাইয়া আপনাদের র‌্যাগ উৎসবের কাভারেজ আমি করবো। প্লিজ ক্যামমেরাটা আমাকে দেন।” সাত পাঁচ না ভেবেই ক্যামেরাটা দিয়ে দিলাম। “তোমার প্রথম রিপোর্ট ছাপা উপলক্ষ্যে আমাকে খাওয়াবা না?” শমী একগাল হাসি দিয়ে বলে-“কি খাবেন, মিষ্টি না বিরিয়ানী? আজ বিকালে তাহলে আমরা বাইরে গিয়ে দুজন খেয়ে আসব।”
উপাচার্য মহোদয় আনন্দ শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে র‌্যাগ উৎসবের উদ্বোধন ঘোষনা দিলেন। ব্যান্ড পার্টির বাজনার তালে তালে শুরু হলো রং খেলা। আবিরের রঙে একে অপরকে রাঙ্গিয়ে আমরা ক্যাম্পাস প্রদক্ষিন করছিলাম। শমী আমাদের সব আনন্দ ক্যামেরায় ধারন করছিল। এ ডাকে, ও ডাকে- শমী এদিকে আসো, শমী আমার ছবি তোল। ক্লিক ক্লিক করে শমী আমাদের ছবি তোলে।
দুপুর তিনটার দিকে স্টাফ কোয়ার্টার সংলগ্ন পুকুরে আমরা সবাই গোসল করতে যাই। শমীকে পেয়ে আমাদের ব্যাচের মেয়েরা পাথরের স্তুপের উপর উঠে গেল-আমাদের একটা ছবি তুলে দাওনা শমী!! আমি শমীকে দূর থেকে ডেকে বললাম-আমার ক্যামেরাটা রুমে পৌছে দিও কিন্তু।
আমি ভাল সাতার পারি না। আমার মতো যারা সাতার জানে না তারা পুকুর পারে সিড়িতে বসে থাকল। কয়েকজন জুনিয়রের সহযোগীতায় একটু একটু সাতার দিলাম। তারপর কয়েকটা ডুব দিয়ে কোন মতে উঠে আসলাম। হলে আসার পর একজন এসে ক্যামেরাটা দিয়ে গেল-ঐ মোটা ভাইটা আপনাকে দিতে বলল। ক্লান্ত শরীরে হলে এসে আবার গোসল করলাম। কাপড় ছেড়ে কম্পিউটারটা ছাড়লাম আজকের তোলা ছবি দেখব বলে। একটা ফোন-“পুকুরে ডুবে আছে শমী। মাত্র তোলা হল। জ্ঞান নেই।”
মনে হল কে জানি মাথায় আঘাত করল। দৌড়ে পুকুর পারে গেলাম। গিয়ে দেখি শমী নাই, হাসপাতালে নিয়ে গেছে। একলা একলা নাকি প্যান্ট শার্ট পরেই পুকুরে নেমেছিল। এতো বড় শরীরটার প্রাণ কি করে অভিশপ্ত পুকুরটা গ্রাস করে নিতে চাইল-বুঝলাম না। নিথর দেহটাতে প্রাণ আসুক মনে প্রানে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলাম। সে প্রার্থনা কবুল হয়নি।
সন্ধ্যায় আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি আসল। শমীর মৃত্যুর খবর শুনে সবাই ভিড় জমাচ্ছে। আমার শুধু মনে পরছে, আজ সন্ধ্যায় আমাদের বিরিয়ানি খেতে যাওয়ার কথা ছিল। শমীর প্রথম রিপোর্ট প্রকাশের উদযাপন করার কথা ছিল। অর্ধেক রাত শমী হাসপাতালের মর্গের হিমঘরে শুয়ে ছিল। চিৎকার করে বলতে মন চাইছিল-উঠো শমী উঠো !!

৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×