গতকালের প্রথমআলোতে পড়া:.......আপনাদের মতামত কী?
যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনালের শুনানি, জেরা আর পাল্টা জেরার মধ্যে যা চলছে, তা আসলে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই। ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই মানে ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই। শেষ পর্যন্ত ইতিহাস মানে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে বাঁধ রচনা। অপরাধ ভুললে বিচারের দায়ও ভুলে থাকা যায়। বিস্মৃতি আর অবিচার তাই সমার্থক। একাত্তরের স্মৃতিগুলো তারাই ভুলতে ও ভোলাতে চায়, যারা একাত্তরের অপরাধী; যারা মানবতার বিরুদ্ধে সেই সব অপরাধের বিচারের ভয়ে ভীত। কিন্তু যারা বিচার চাইতে ভীত নয়, যারা অপরাধের শিকার, তাদের মন সেই সব স্মৃতি ভুলতে পারে না, তারা চাইবে ইতিহাস সেসব স্মৃতি মনে রাখুক, তাদের অপূরণীয় ক্ষতির প্রমাণ রাখুক। বিস্মৃতি আর অবিচার তাই সমার্থক।
জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধের বিচারকে ‘প্রহসন’ বলে অভিহিত করছে। বিচারের প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে অনেকেরই সমালোচনা আছে, মাত্র কয়েকজনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বাকিদের মুফতে বাঁচিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা যায়। কিন্তু জামায়াত নেতাদের অভিযোগ সেটা নয়, তাঁরা মনে করেন, বিচারযোগ্য কোনো অপরাধ তাঁদের ‘প্রাণপ্রিয়’ নেতারা করেননি। এই প্রস্তাবের অর্থ ১. একাত্তরে যুদ্ধাপরাধ ঘটেনি, ২. ঘটলেও অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তাতে জড়িত নন, ৩. জামায়াতে ইসলামীতে যুদ্ধাপরাধী নেই। এটাই যদি সত্য হয়, তাহলে বাংলাদেশের কর্তব্য হচ্ছে, একাত্তরকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হওয়া। কী ঘটেছিল সে বিষয়ে একটি ট্রুথ কমিশনের দাবির বিপরীতে একটি বিস্মৃতি কমিশন গঠন করলে জামায়াত তাই খুশি হয়।
গ্রিক উপকথায় লেদে নামে এক বিস্মৃতির নদী আছে, সে নদীতে ডুবলে মানুষ স্মৃতি হারিয়ে ফেলে। একাত্তরের রক্তনদীতে অবগাহন করা বাংলাদেশকে কি তাহলে উপকথার সেই বিস্মৃতির নদীতে চোবানোর প্রকল্প নিয়েছে গণহত্যা-অস্বীকারকারীরা? যুদ্ধাপরাধের বিচারের মামলা তাই বিস্মৃতির বিরুদ্ধে ইতিহাস প্রতিষ্ঠার মামলা।
যার আর কিছু নেই তার আছে কেবল অতীত; জামায়াতের তাও নেই। যে অতীতের গায়ে ভুল আর অপরাধের দাগ গুটিবসন্তের মতো ফুটে আছে, সেই দাগ ঢেকে বা মুছে চলা ছাড়া করার কিছু থাকে না। বিস্মৃতি এবং ইতিহাস-বিরোধিতায় আসক্ত জামায়াত তাই পেছনটা মুছতে মুছতেই একাত্তরটি বছর পার করেছে। দেশের অন্যতম প্রাচীন দল হয়েও কোনো রাজনৈতিক পুঁজি সঞ্চয় করতে পারেনি দলটি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অতীতের গৌরবকীর্তন চালু ব্যাপার হলেও, কীর্তন করবার মতো কোনো অতীত তাদের নেই। যা আছে তা গৌরবহীনতা আর স্ববিরোধিতায় ভরা। একাত্তরে যে পাকিস্তান বাঁচাতে তারা দেশদ্রোহী ঘাতক হয়েছিল, সাতচল্লিশে সেই পাকিস্তানকে তারা কবুল করেনি। গোলাম আযমকে তারা ভাষা আন্দোলনের ‘নায়ক’ করার চেষ্টা করলেও সেই নায়ক স্বয়ং ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের শুক্কুর শহরে দেওয়া বক্তৃতায় ভাষা আন্দোলনকে ‘মারাত্মক ভুল’ বলে তাতে তাঁর ‘আকস্মিক সম্পৃক্ততার’ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। আজ যে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য তারা জান কোরবান করার কথা বলছে, সেই বাংলাদেশকেও তারা চায়নি। যে ইসলামের নামে তারা রাজনীতি করে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মানুষ তাদের ‘ইসলামের’ বন্ধু মনে করেনি। ইসলাম ও একাত্তর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান দুই চালিকাশক্তি এবং এই দুইয়ের মধ্যে বিরোধ কল্পনা করা জামায়াতের ঐতিহাসিক ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয়। অতীতের এই সব ভুল ও অপরাধের দায়মুক্তি তখনই সম্ভব যখন জামায়াতি যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি হবে এবং অপরাধের জন্য দলটি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইবে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের ব্যর্থতা দুটি দিকে স্পষ্ট হয়। প্রথমত, সর্ববৃহৎ সুসংগঠিত কর্মিবাহিনী থাকা সত্ত্বেও দলটি আজ অবধি এককভাবে কোনো আন্দোলন সৃষ্টি করতে পারেনি। অথচ তাদের থেকে অনেক গুণ কম শক্তি নিয়েও বামপন্থীরা কোনো কোনো ইস্যুতে গণ-আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় ডান-বাম সবার প্রভাব থাকলেও জামায়াত সেখান আঁচড় কাটতে ব্যর্থ। এ দেশের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে জামায়াতের আদর্শ ও কর্মসূচির কোনো যোগাযোগ নেই। জামায়াতের কর্মীরা সবখানেই জনবিচ্ছিন্ন, বৃহত্তর সমাজের ওপর তাদের প্রভাব নেই বললেই চলে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিএনপিও জাতীয়তাবাদ ও মুসলমান পরিচয়কে মিশিয়ে একটা সংস্কৃতি খাড়া করতে পেরেছে। এবং সেই সংস্কৃতি দল ছাপিয়ে সমাজের মধ্যেও চারিয়ে গেছে। জামায়াত তেমন কিছু নেই, তাদের আছে কেবল একটা ভুঁইফোড় দলীয় ‘কালচার’— দলের সীমার মধ্যেই তা সীমিত। দ্বিতীয়ত, একাত্তর বছরের জীবনে জামায়াতের ভোট ছোট একটা বৃত্তের মধ্যেই আটকে আছে। ১৯৮৬ থেকে ২০০৮-এর নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এককভাবে তাদের ভোট ৩-৫ শতাংশের মধ্যেই খাবি খাচ্ছে।
ইসলামপন্থী অন্য দলগুলোর মধ্যেও জামায়াত মিত্রহীন। জামায়াতের একমাত্র মিত্র বিএনপির পক্ষেও এই মিত্রতা চালিয়ে যাওয়া অলাভজনক হয়ে যাচ্ছে। জামায়াতের বিএনপিকে প্রয়োজন রাজনৈতিক ছাতা হিসেবে, আর বিএনপির জামায়াতকে প্রয়োজন রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের দরকারে। বিএনপির এই ঠেকা ছাড়া জামায়াতের সত্যিকার কোনো রাজনৈতিক ভিত আসলেই নেই। জামায়াত এখন মূলত একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক মঞ্চ হয়ে উঠেছে। যে ধরনের ব্যবসায়িক ও সেবাভিত্তিক সংস্থার মাধ্যমে জামায়াতি পুঁজি মুনাফামুখী হয়ে আছে, বেআইনি কার্যকলাপের মাধ্যমে সেই পুঁজি ও বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে তারা ধ্বংস করতে চাইবে না। তা ছাড়া জেএমবির অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের জন্য উর্বর ভূমি নয়। তাই দলবাজির বাতিক কিংবা ইসলামভীতির ঘোরমুক্ত হয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এককভাবে জামায়াত গণতন্ত্রের জন্য হুমকি নয়। যখনই বড় কোনো শক্তির আশ্রয় তারা পেয়েছে, কেবল তখনই তারা ভীষণ চেহারা ধারণ করেছে। বিএনপি বা আওয়ামী লীগ বা তৃতীয় কোনো শক্তির মদদ ছাড়া জামায়াতের পক্ষে কিছু করা তাই সম্ভব নয়। তারা যা পারে সেটাই করেছে। ব্যবসা, ব্যাংক, এনজিও, সেবা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিপুল ব্যবসা-পুঁজি জড়ো করেছে। এই সব ব্যবসা ও পুঁজির দেখভালের সঙ্গেই তাদের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী জড়িত। অর্থের আরাম এবং এই পুঁজির নিরাপত্তার স্বার্থেই কোনো রকম চরম পন্থা থেকে তারা দূরে থাকবে।
তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, তুরস্ক বা মিসরের ইসলামপন্থীদের থেকে জামায়াত মৌলিকভাবে আলাদা। এই দলগুলোর কোনোটাই স্বদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি কিংবা গণহত্যায় জড়িত থাকেনি। মিসরের ব্রাদারহুড সর্বদাই রাষ্ট্রীয় নির্যাতন-নিপীড়ন সয়ে এসেছে। বর্তমান আমল এবং স্বাধীনতার পরের কয়েক বছর ছাড়া প্রায় সব সময়ই জামায়াত ক্ষমতার দুধ-মধু পেয়ে এসেছে। তাদের রাজনীতিও বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির জমিনে প্রোথিত নয়। তা ছাড়া যত দিন তারা যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক থাকবে এবং অস্বীকার করবে একাত্তরের গণহত্যার ব্যাপকতাকে, তত দিন তাদের রাজনৈতিক বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধই থাকবে। এ রকম প্রশ্নবিদ্ধ চরিত্র নিয়ে তাদের পক্ষে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়াও অসম্ভব।
এত দুর্বলতা সত্ত্বেও জামায়াত সামর্থ্যের চেয়ে বেশি ক্ষমতা ধারণ করেছে বড় দুটি দলের ক্ষমতার কোন্দল এবং প্রকাশ্য ও গোপন আঁতাতের জন্য। উভয় দলই সময়েসময়েজামায়াতকে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছে। সামনেও এমন মওকা জামায়াত খুঁজবে। বিএনপি-জামায়াত জোড় ভাঙতে আওয়ামী লীগের দিক থেকে জামায়াতের সঙ্গে দর-কষাকষির সম্ভাবনা একেবারে বাতিল করা যায় না। গত ১০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রকাশ্যে জামায়াতের কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীমুক্ত নতুন জামায়াত গঠন করুন। একাত্তরের সময় যদি আপনার বয়স ১০ হয়ে থাকে, তাহলে তো আপনি যুদ্ধাপরাধী নন, তাহলে কেন আপনারা যুদ্ধাপরাধের কলঙ্ক বয়ে বেড়াবেন?’ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ‘ব্যাক টু দি ফিউচার’ শীর্ষক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও পশ্চিমা কূটনীতিকদের একাংশের এমন আগ্রহের ইঙ্গিত আছে। একই কথা বিএনপির নেতা-কর্মীদের অনেকের মনেও বাজছে নিশ্চয়। কারণ, তাঁরা জানেন, গত নির্বাচনে জামায়াতপ্রীতি বিএনপির ভোট কমিয়েছে।
আওয়ামী লীগের সমর্থকদের জামায়াত নিয়ে অতি ভীতি আর তাকে কোলে করে রাখার বিএনপির রাজনীতি তাই না বাস্তব না কৌশলী। এই দোটানা থেকে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ বেরোলেও প্রধান দুটি দলের নীতিনির্ধারকেরা মনে হয় বেরোতে পারেননি। একদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালিয়ে যাওয়া, অন্যদিকে রাজনীতির মাঠে জামায়াতকে একা করে রাখলে বড় দুটি দলের কারোরই ক্ষতির আশঙ্কা নেই। কিন্তু নিজের ভালো কি তারা বুঝবে?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]
তথ্যসুত্র : প্রথম আলো ১১ই জুলাই ২০১২.