somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুঘল সম্রাট ও তাঁদের সাম্রাজ্য- পর্ব ১

১২ ই জুলাই, ২০১২ দুপুর ২:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাবার হইলো একবার জ্বর, ছাড়িল ঔষধে। এই বাক্যটা মুখস্ত করলেই আমরা এই উপমিহাদেশের ঐতিহাসিক মুঘল আমলের ৬ সম্রাটের নাম ক্রমানুসারে জেনে যেতে পারব।
বাবার = বাবর (জহির উদ্-দিন মুহাম্মদ জালাল উদ্‌-দিন বাবর)
হইলো = হুমায়ূন (নাসিরুদ্দিন হুমায়ুন-তীমুরীয়)
একবার = আকবর (আব্দুল-ফথ জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর)
জ্বর= জাহাঙ্গীর (নুরুদ্দীন জাহাঙ্গীর)
ছাড়িল= শাহ্‌ জাহান (আবুল মুজাফফর শিহাবুদ্দিন মুহম্মদ শাহজাহান সাহিব কিরান-ই-সানী)
ঔষধে= আওরঙ্গজেব (আবুল মুজাফফর মুহি উদ-দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব বাহাদুর আলমগীর)

আজ আমরা মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের কথা জানবো।


১ম মুঘল সম্রাট জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর

৩০শে এপ্রিল ১৫২৬ সনে প্রথম পানি পথের যুদ্ধের মাধ্যমে জহির উদ্-দিন মুহাম্মদ বাবরের হাত ধরে এই উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা পায় আর মার্চ ৩, ১৭০৭ শেষ মুঘল সম্রাট মুহি উদ-দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের আধিপত্য শেষ হয়।

জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর ১৪৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী ফারগানা (বর্তমানে উজবেকিস্তান) প্রদেশের আনদিজান শহরে জন্মেছিলেন। তিনি ফারগানা প্রদেশের শাসনকর্তা ওমর মি্জার বড় পুত্র ছিলেন। বারলাস উপজাতিতে বেড়ে উঠলেও বাবর জাতিতে তুর্কি ও পারস্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ছিল। এই অঞ্চলগুলো পরবর্তীতে ইসলামিক জাতিতে পরিণত হয় এবং তুরকিস্থান এবং খোরাসান নামে পরিচিত লাভ করে। বাবরের মাতৃভাষা ছিল চাঘাতাই যা তুর্কি ভাষা নামে পরিচিত ছিল। তিনি তৈমুর লঙ্গের সরাসরি বংশধর ছিলেন এবং তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন তিনি মাতার পক্ষ থেকে চেঙ্গিস খানেরও বংশধর ছিলেন।

কথিত আছে বাবরের দৃঢ স্পৃহা ছিল। শক্ত সমর্থ এবং শারীরিক ভাবে সুস্থ ছিলেন। তিনি কেবল ব্যায়ামের জন্য দু’কাঁধে দু’জনকে নিয়ে ঢাল বেয়ে দৌড়ে নামতেন। কিংবদন্তী আছে, বাবর তার সামনে পড়া সবগুলো নদী সাঁতরে পাড় হতেন এবং উত্তর ভারতের গঙ্গা নদী দু’বার সাঁতার দিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন।

বাবর একজন গোঁড়া সুন্নি মুসলিম ছিল। সে তার শিয়া মুসলিমদের অপছন্দ করাকে কখনও কখনও ব্যক্ত করেছিল " তাদের বিচ্যুতি " বলে ।যদিও ধর্ম বাবরের জীবনের এক প্রধান স্থান ছিল তথাপি তিনি মদ্যপায়ী ছিলেন। বাবর তার সমকালীন এক কবির কবিতার একটি লাইন প্রায় উদ্ধৃত করতেন:" আমি মাতাল, আধিকারিক।আমাকে শাস্তি দিন যখন আমি সংযমি। " বাবরের সহযোগী রাজারা মদ পান করতেন এবং প্রাচুর্য্য পূর্ণ ভাবে জীবন যাপন করতেন, তারা ছেলেদের সঙ্গে প্রেমে পড়েছিল এবং হিংস্র এবং নির্মম ছিলেন। বাবরের এক কাকার মতে "অধর্ম এবং পাপকার্জে সে আসক্ত হয়েছিল। সে সমকামিতেও আসক্ত হয়ে পড়েছিল। তার এলাকাতে, যখনই শান্ত কোনো যুবক তার সামনে এসেছে, তাকে পাবার জন্য সে সবকিছু সে করেছিল। তার সময় এই ধরনের সমকামিতা প্রচলিত ছিল এবং সেটা একটি গুণহিসাবে বিবেচনা করা হোতো (Pope, Hugh (2005). Sons of the Conquerors, Overlook Duckworth, pp.234-235)।" সে তার মৃত্যূর দুই বছর আগে মদ্যপান ত্যাগ করেছিলেন এবং তিনি তার রাজসভায় সকলকে একই কাজ করার কথা বলে ছিলেন। কিন্তু সে নিজে আফিং এর নেশা ছাড়তে পারেননি। বাবর লিখেছিলেন: " সবাই সুরাপান পছন্দ করে,পান করার জন্য শপথ নেয়, আমি শপথ নিয়েছিলাম এবং অনুতাপ করেছিলাম।

মাত্র বার বছর বয়সে ১৪৯৪ সালে বাবর প্রথম ফরগানার (উজবেকিস্তান) সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার চাচা অনবরত তাকে সিংহাসন চ্যুত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তার অন্যন্য শত্রুও ছিলেন। একসময় সে বাবরকে ক্ষমতাচ্যূত করতে সফল হয়। ফলে জীবনের বেশকিছু সময় তাকে আশ্রয়হীন এবং যাযাবর থাকতে হয়। এসময় তার সাথে শুধুমাত্র তার বন্ধু ও চাষীদের যোগাযোগ ছিল। ১৪৯৭ সালে বাবর সমরকন্দের উজবেক শহরে আক্রমণ চালান এবং ৭ মাস পর শহর দখল করতে সমর্থ হন। কিছুদিনের মধ্যে ফরগানায় বিদ্রোহের কারণে তাকে আবার ক্ষমতা হারাতে হয়। ফরগানা পূনরুদ্ধারের জন্য পুনরায় অগ্রসর হলে তার বাহিনীর লোকজন তাকে ফেলে চলে যায়, ফলে তাকে সমরকন্দ ও ফরগানা উভয় রাজ্য হারাতে হয়।

১৫০১ সালে বাবর আবার সমরকন্দের দখল নিতে প্রস্তুতি নেন, তবে আবারো তার পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষ মোহাম্মদ শেবানী খান এর কাছে পরাজিত হন। তিনি তার কিছু অনুসারী নিয়ে পালিয়ে আসতে সমর্থ হন। পরবর্তীতে বাবর একটি শক্তিশালী দল গঠনে মনযোগী হন এবং প্রধানত তাজিক ও বাদাক্‌শানদেরকে তার দলে অন্তর্ভূক্ত করেন। ১৫০৪ সালে তুষার সমৃদ্ধ অঞ্চল হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করেন এবং কাবুল দখল করেন। এর ফলে তিনি একটি নতুন ধনী রাজ্য লাভ করেন এবং নিজের ভাগ্য পূণর্প্রতিষ্ঠিত করেন এবং বাদশাহ উপাধি গ্রহণ করেন। ১৫০৬ সালে হুসাইন বায়কারাহ এর মৃত্যু তার অভিযানকে বিলম্বিত করে। বাবর তার মিত্রপক্ষের শহর হেরাতে দু’মাসের জন্য অবস্থান করে সম্পদের অভাবে এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এর মধ্যেও তিনি এই রাজ্যকে প্রাচূর্য্যমণ্ডিত করেছেন। হেরাতের শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়ের আধিক্য তাকে চমত্‌কৃত করে। তিনি অহিগুরের কবি মীর আলি শির নাভাই এর সাথে পরিচিত হন। নাভাই তার সাহিত্যে চাঘাতাই ভাষার ব্যবহার করতেন, তিনিই বাবরকে তার আত্মজীবনী লিখতে উত্সাহিত করেন।

এর দুই বছর পর একটি বিপ্লব সংঘটিত হলে তার কিছু শীর্ষস্থানীয় নেতা তাকে কাবুল থেকে তাড়িয়ে দেন। বাবর কিছু সঙ্গী সহ শহর থেকে পালিয়ে গেলেও পুনরায় শহরে ফিরে এসে কাবুল দখল করেন। বিদ্রোহীদের তিনি তার অধীনে নিয়ে আসেন। এদিকে ১৫১০ সালে মোহাম্মদ শেবানী পার্সিয়ার শাসনকর্তা ইসমাঈল সাকাভিদ এর কাছে নিহত হন। বাবুর এই সুযোগে তার পূর্বপুরুষের রাজ্য তিমুরিদ পুনঃরুদ্ধার করতে চেষ্টা করেন। কয়েক বছর বাবর ইসমাঈল এর সাথে মধ্য এশিয়া দখলের জন্য মিলিত হন। বাবর সাকাভিদকে তার রাজ্যে সার্বভৌম রাজা হিসেবে চলার অনুমতি দেন। শাহ ইসমাঈল বাবর ও তার বোন খানজাদার মধ্যে পুনর্নিলন ঘটান। খানজাদাকে শেবানী বন্দী করে জোরপূর্বক বিয়ে করেছিল। ইসমাঈল বাবরকে অনেক ধনসম্পদ এবং রসদ সরবরাহ করেছিলেন এবং প্রতিদানে বাবর তাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছিলেন।

এদিকে পারস্যে শিয়া মুসলিমদের শাহ এর একটি অভেদ্য দূর্গে পরিণত হয় এবং তিনি নিজেকে ৭ম শিয়া ঈমাম ঈমান মূসা আল কাজিমের বংশধর হিসেবে দাবি করতেন। তথন তার নামে মূদ্রা চালূ করা হয় এবং মসজিদে খুত্‌বা পড়ার সময়ে তার নাম নিয়ে পড়া হত। এই যুক্তিতে বাবর পারস্যের মিত্ররাজ্যের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন পার্সিয়ার শাহ্‌কে তাড়ানোর জন্য, যদিও কাবুলেও বাবরের নামে মূদ্রা ও খুতবা প্রচলিত ছিল।
পরে বাবর বুখার দিকে রওনা হন এবং সেখানে তার বাহিনীকে স্বাধীনতার সৈনিক হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। তিইমুরিদ হিসেবে এক্ষত্রে তার খুব সমর্থন ছিল। শহর ও গ্রামের লোকজন তাকে ও তার বাহিনীকে সাহায্য করতে গিয়ে সর্বস্ব উজাড় করে দিত। বাবর পার্সিয়ার সহযোগিতা ফিরিয়ে দেন তাদের প্রয়োজন মনে না করার আত্মবিশ্বাসে। ১৫১১ সালের অক্টোবর মাসে প্রায় ১০ বছর পরে বাবর সমরকন্দে আবার প্রবেশ করতে সমর্থ হন। জনগণ তাদের মুক্তিদাতাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বাবর শিয়া পোষাক পরে সুন্নীদের সামনে দাঁড়ান এবং পরিস্থিতি সামাল দেন। তার কাজিন হায়দার লিখেছেন, বাবর একটু ভীত ছিলেন পার্সিয়ার সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে। পার্সিয়ার শাহকে খুশী রাখার জন্য বাবর সুন্নী সম্প্রদায়কে কোন লাঞ্ছনা করেননি এবং শাহ্‌ এর সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক হাতটিও সরিয়ে দেননি। এর ফলে ৮ মাস পরে তিনি উজবেক পুনরায় জয় করতে সমর্থ হন।

উত্তর ভারত জয়ঃ
নিজের অতীতের কথা লিখতে গিয়ে বাবর বলেছেন, সমরকন্দ পূনরুদ্ধার ছিল আল্লাহ্‌র দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। এরপর বাবরের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় ফরগানা দখল করা। এদিকে পশ্চিম দিক থেকে উজবেকদের আক্রমণের ভয়ও ছিল। ফলে তাকে ভারত ও এর পূর্ব দিকে মনোনিবেশ করতে হয়, বিশেষ করে আইয়ুদিয়ার রাজ্য এবং পেনিনসুলার মালায়া। বাবর নিজেকে সৈয়দ বংশের সত্যিকারের শাসনকর্তা হিসেবে দাবি করেন। একইভাবে নিজেকে তিমুরের মুকুটের দাবিদার হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। তিমুর প্রকৃতপক্ষে খিজর খানের ছিল, তিনি এটিকে মিত্ররাজ্য পাঞ্জার হাতে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। পরে তিনি দিল্লী সালতানাতের সুলতান হয়েছেন। সৈয়দ বংশ পরে আফগানের শাসনকর্তা ইব্রাহীর লোদীর কাছে বেদখল হয়ে যায়। বাবর এটিকে পুণরুদ্ধার করতে চান। তিনি পাঞ্জাব আক্রমণ করার আগে ইব্রাহীম লোদীকে একটি অনুরোধ করেন, “আমি তাকে একটি গোসাওক পাঠিয়েছি এবং তার কাছে সে সব দেশের অধিকার চেয়েছি যেগুলো প্রাচীনকাল থেকেই তুর্কিদের উপর নির্ভরশীল।“

ইব্রাহীম বাবরের প্রস্তাব গ্রহণ করেন নি এবং খুব তাড়াতাড়ি তাকে আক্রমণের পরিকল্পনাও করেননি। তাই বাবর এর মধ্যে কিছু পূর্ব প্রস্তুতি সেরে নেন আক্রমণের জন্য এবং কান্দাহার বন্ধ করে দেন। তিনি কাবুলের পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ চালানোর একটি রণকৌশল ঠিক করেন ভারত দখলের জন্য। কান্দাহার বন্ধ করে দেবার ফলে আক্রমণ ধারণাকৃত সময়ের অনেক পরে সংঘটিত হয়। প্রায় তিন বছর পর কান্দাহার ও এর পৌরদূর্গ বেদখল হয়েছিল এবং এছাড়াও অন্যান্য ছোটখাট যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই খণ্ডযুদ্ধগুলো বাবরকে সফল হবার সুযোগ করে দেয়।

পাঞ্জাবে প্রবেশের সময় বাবরের রাজদূত লঙ্গর খান নিয়াজী বাবরকে পরামর্শ দেন জানজুয়ার রাজপুত্রকে এই অভিযানে সম্পৃক্ত করার জন্য, তাদের এই দিল্লী জয়ের অভিযান বেশ পরিচিত লাভ করে। বাবর তার প্রধান ব্যক্তি মালিক আসাদ এবং রাজা সংঘর খান এর কাছে তার রাজ্যে ঐতিহ্যগত শাসনের সুফল এবং তার পূর্বপুরুষের সহযোগিতার কথা তাদের কাছে উল্লেখ করেন। বাবর শত্রুদের পরাজিত করে তাদের নিজের দলে ভিড়ান। ১৫২১ সালে গাখারসে তার মিত্রদের একত্রিত করেন। বাবর তাদের প্রত্যেককে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন এবং রানা সংঘকে পরাজিত করেন, এটিও তার ভারত দখলের অন্তর্ভূক্ত।

১৫০৮ সাল থেকে ১৫১৯ সালের সময়টুকু বাবরের স্মৃতিকথায় ছিল না। এই সময় ইসমাঈল আই একটা দুঃসময় কাটান, তার বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয় অটোম্যান রাজার বিরুদ্ধে চালদিরান যুদ্ধে। সেখানে ম্যাচলক মাস্কেট নামক এক ধরণের নতুন অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। বাবর এবং ইসমাঈল দু’জনেই প্রযুক্তির উন্নয়ন উপলব্ধি করেন এবং বাবর তার বাহিনীকে ম্যাচলক যন্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতে একজন অটোম্যান উস্তাদ আলীকে তার বাহিনীতে আমন্ত্রণ জানান। উস্তাদ আলী তখন ম্যাচলক মানব নামে পরিচিত ছিলেন। বাবর মনে রেখেছিলেন যে, তার বিরোধীরা তার বাহিনীকে এই ধরণের কোন অস্ত্র আগে দেখেনি বলে বিদ্রুপ করত। এ যন্ত্রগুলো থেকে বিকট শব্দ হত এবং কোন তীর বা বর্ষা নিক্ষিপ্ত হত না।

এই অস্ত্রগুলো স্বল্পসংখ্যক সৈন্যের হাতে দেয়া হয় শত্রুদের উপর কর্তৃত্ব করার জন্য। ভারতের পথে অগ্রসর হবার সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলোর সাথে খণ্ড যুদ্ধের সময় এটি ব্যবহার করা হয় শুধুমাত্র শত্রুদের অবস্থান এবং কোশল পরীক্ষা করার জন্য। কান্দাহার ও কাবুলের দুটি শক্ত প্রতিরোধ থেকে রক্ষা পাওয়া বাবর কোন অঞ্চল জয়ের পর স্থানীয়দের খুশী করার চেষ্টা করতেন। এজন্য স্থানীয় সংস্কৃতি পালনের পাশাপাশি বিধবা ও এতিমদের সাহায্য করা হত।

ইব্রাহীম লোদীর সাথে যুদ্ধ
ইব্রাহীম লোদী অনেকের অপ্রিয় ছিলেন, এমনকি তার নিজস্ব নোবেলদের কাছেও। বাবর ১২০০০ সৈন্য যোগাড় করেন এবং লোদীর আফগান নোবেলদেরকে তার শামিল হবার আমন্ত্রণ জানান। এই সৈন্যসংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল কেননা তারা অগ্রসর হবার সময় স্থানীয় অনেকেই তাদের সাথে যোগ দিচ্ছিল। দুই পক্ষের মধ্যে প্রথম বড় সংঘর্ষ হয় ১৫২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বাবরের পুত্র হূমায়ুন ১৭ বছর বয়সে তিমুরিদ বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন ইব্রাহীমের উন্নত বাহিনীর বিপরীতে। হূমায়ুনের বিজয় অর্জন ছিল অন্যন্য খণ্ডযুদ্ধের চেয়ে বেশ কঠিন। তবে তারপরও এটি একটি চূড়ান্ত বিজয় ছিল। যুদ্ধের পর আটটি হাতি সহ প্রায় শতাধিক যুদ্ধবন্দীকে আটক করা হয়। তারপর অন্যান্য যুদ্ধের বন্দীদের মত এই বন্দীদের পরে আর মুক্ত করা হয়নি। হুমায়ূনের আদেশ অনুসারে তাদের হত্যা করা হয়। বাবরের স্মৃতিকথায় আছে, “উস্তাদ আলীকুলি খান এবং ম্যাচলকমানবদেরকে সকল বন্দীদের গুলি করার আদেশ দেয়া হয়েছিল। হূমায়ুনের প্রথম যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল এটি যা একটি চমত্কার পূর্বাভাস।“ এটিই ছিল খুব সম্ভবত ফায়ারিং স্কোয়াডের প্রথম উদাহরণ।


চিত্র পানিপথের যুদ্ধ

ইব্রাহীম লোদী প্রায় এক লক্ষ সৈন্য এবং ১০০টি হাতি সহ বাবরের দিকে অগ্রসর হন। তখন বাবরের সৈন্যসংখ্যা লোদীর অর্ধেকেরও কম ছিল, যা সর্বসাকুল্যে প্রায় ২৫০০০ এর মত। ১৫২৬ সালের ২১ এপ্রিলে সংঘটিত এই যুদ্ধটি পানিপথের প্রথম যুদ্ধ নামে খ্যাত এবং বাবর ও লোদীর মধ্যে প্রধান সংঘাত।। যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদী নিহত হন এবং তার বাহিনীকে পরাজিত করে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বাবর দ্রুত দিল্লী এবং আগ্রা উভয়ের দখল নেন। ঐদিনই বাবর হুয়ায়ূনকে আগ্রা যাবার আদেশ দেন জাতীয় ধনসম্পদ লুটপাটের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। হুমায়ূন সেখানে রাজা গোয়ালিয়রের পরিবারকে পান। রাজা যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন এবং তার পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তা নিশ্চয়তা লাভের আশায় হুমায়ূনকে একটি বড় হীরা দেন। এই হীরাটিকে বলা হত “কোহিনূর” বা আলোর পর্বত।“ ধারণা করা হয়, এটি তারা তাদের রাজ্য পূণরুদ্ধারের জন্য করে। এই পরিবারটিই গোয়ালিয়রের শাসনকর্তা ছিল, তবে তার পিছনে উপহারটির গুরুত্বের কথা জানা যায় না।

বাবর বিজয়ের তৃতীয় দিন দিল্লী পৌছেন। তিনি তার উপস্থিতি উদযাপিত করেন যমুনা নদীর তীরে এবং সেখানে শুক্রবার পর্যন্ত উত্‌সব স্থায়ী করা হয়। পরে মুসলমানেরা শোকরানা নামায আদায় করেন এবং এবং জামা মসজিদে তার নামে তিনি খুতবা শোনেন। পরে তিনি আগ্রার দিকে অগ্রসর হন ছেলের সাথে সাক্ষাতের জন্য। বাবরকে সেই কোহিনূর পাথরটি দিয়ে অ্ভ্যর্থনা জানানো হয়। বাবর বলেছিলেন, 'আমি তাকে এটি ফিরিয়ে দিলাম এবং একজন বিশেষজ্ঞ অলঙ্কারবিদ বললেন যে, এর মূল্য দিয়ে পৃথিবীর সকল লোককে আড়াই দিন খাওয়ানো যাবে'। পরবর্তী দুইশ বছর এই 'কোহিনূর' বাবর হীরা নামে পরিচিত ছিল।

রাজপুতদের সাথে যুদ্ধ
দিল্লী ও আগ্রা দখলের পরও বাবর মেওয়ারের রাজপুত রাজ রানা সাংগার দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটাতে লাগলেন। বাবরের অভিযানের আগে রাজপুতের জমিদারেরা সালতানাতের কিছু জাতি জয় করতে সমর্থ হয়েছিল। তারা বাবরের নতুন রাজ্যের দক্ষিণ পশ্চিমের একটি অঞ্চল সরাসরি শাসন করত যা রাজপতনা নামে পরিচিত ছিল। এটি কোন একতাবদ্ধ রাজ্য ছিল না, বরং এটি ছিল রানা সাংগার অধীন কিছু রাজ্যের সংগঠন।

সম্রাট বাবর ঐতিহাসিক যে সবযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে পড়েন তার মধ্যে উল্লেখোগ্য হল
• 1st Battle of Panipat (1526) Babar with Ibrahim Lodi
• Battle of Khanwa (1527) Babar with Rana Sanga
• Battle of Chanderi (1528) Babar with Medani Rai
• Battle of Ghagra (1529) Babar with Afghans

মুঘল সম্রাট হিসেবে তাঁর রাজত্বকাল ছিল ৩০শে এপ্রিল ১৫২৬ – ৫ই জানুয়ারি ১৫৩১ পর্যন্ত। আগ্রায় তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র হুমায়ূন মুঘল সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর সমাধীসৌধ 'বাগ-ই-বাবর' নামে পরিচিত।


বাবরী মসজিদ (প্রতিষ্ঠা-১৫২৭, ধ্বংস-১৯৯২)

সম্রাট বাবরের ৫জন বিবি'র কথা জানা যায়। তারা হলেন আয়েশা সুলতান বেগম, বিবি মুবারিকা ইউসুফা, দিলদার বেগম, গুলনার আগাচেহ, গুলরুখ বেগম। এবং তাঁদের ঘরে ৬ সন্তান- হুমায়ুন, কামরান মির্জা, আসকারি মির্জা, হিন্দাল মির্জা, এবং কন্যা গুলবদন বেগম, ফখর-উন-নিসা (বাবরের মোট সন্তান ছিল ১৮; অন্যরা শৈশবে ইন্তেকাল করেন)।

১৫৩০ সালের শেষ দিকে বাবর চরম অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হন। তিনি ৪৭ বছর বয়েসে ৫ই জানুয়ারী ১৫৩১ সালে মৃত্যুবরণ করেন (মতান্তরে ২৬শে ডিসেম্বর'১৫৩০)। মৃত্যুকালে সম্রাট বাবর হুমায়ুনকে ডেকে নিয়ে বলেন, 'আমার মৃত্যুর পর তুমি তোমার ভাইদের প্রতি কোন অ্ন্যায় আচরণ কর না, যদিও বা তারা তোমার সাথে বিরূপ আচরণ করে'।

প্রথমে সম্রাট বাবরকে আগ্রার মোসলিয়ামে (Mausoleum) সমাহিত করা হয়। পরব্তীতে তাঁর শেষ ইচ্ছায় কাবুলে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।


কাবুলে সম্রাট বাবরের স্মৃতিস্তম্ভ


পর্ব ২- Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুলাই, ২০১২ সকাল ১১:০২
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×