somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মরমী কবি দুরবীন শাহ্

৩০ শে জুন, ২০১২ দুপুর ১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেট। আর এই সিলেট বিভাগের ঐতিহ্যবাহী শিল্প নগরী ছাতকের ইতিহাসে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কালক্রমে জন্মগ্রহন করেন অনেক দার্শনিক, সাহিত্যিক এবং মরমী কবি শিল্পীরা। তাদের মধ্যে দেওয়ান মোহাম্মদ আজফর, সাহিত্যিক মুসলিম চৌধুরী এবং মরমী কবি দুর্বীণ শাহ অন্যতম। মরমী কবি দুর্বীণ শাহ বাংলাদেশের লোক সঙ্গীতের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের নাম। যার জন্ম ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ১৫ কার্তিক, ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে। মৃত্যু ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ৩ ফাল্গুন ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ছাতকের সুরমা নদীর উত্তর পারে নোয়ারাই গ্রামের তারা মনি টিলায় জন্মগ্রহণ করেন। এই তারামণি টিলা কালান্তরে দুর্বীণ টিলা নামে পরিচিত হয়। দুর্বীণ শাহ’র পিতা সফাত আলি শাহ এবং মাতা হাসিনা বানু। সফাত আলি শাহ’র পিত্রালয় ছিল স্থানীয় গোবিন্দগঞ্জের বুড়াইগাঁও এ। বয়স্ক লোক মুখের ধারাভাষ্য থেকে জানা যায় যে সফাত আলি শাহ ছিলেন একজন সুফি সাধক। তিনি বেশির ভাগ সময় নিকট আত্মীয়ের সম্পর্কে স্থানীয় গোবিন্দগঞ্জের সুপ্রাচীন পরিচিত স্থানীয় নূরুল্লাহপুর গ্রামে এবং জাওয়ার খাড়ায় কাটিয়েছেন। পরে তার পথ হয় ছাতকের দিকে। তখন নুরুল্লাহপুরের ভাগনা সম্পর্কিত মরহুম হাবিব উল্লাহকে বলেন ‘ভাগনা আমাকে ছাতকের উত্তর পাড়ে কুমার কান্দিতে দিয়ে এসো’। ভাগনা হাবিব উল্লাহ মামার কথা শুনে শিউরে উঠলেন কারণ ঐ সময় কুমার কান্দিতে কোনো মানুষজন ছিল না। এখানে বাঘে নাকি হরিণ ধরে ভোজন করত কিন্তু মামাকে ভাল করে চিনতেন বলে কোনো প্রশ্ন না করে তার আরো ক’জন চাচাত ভাইকে নিয়ে নৌকা যোগে এই সুফি সাধককে কুমার কান্দিতে নিয়ে যান এবং ফেয়ার পথে ভাগনা মামাকে জিজ্ঞেস করেন, মামা আপনাকে এখানে কোথায় পাওয়া যেতে পারে।’ তিনি বলেন ‘ভাগনা কখনো যদি এদিকে আসো তাহলে এখানকার সবচেয়ে উঁচু টিলায় আমাকে পাবে।’ যার নাম পূর্বে ছিল তারামণি টিলা। পরে এই টিলা থেকে দুর্বীণ দিয়ে জমি জরীফ করা হত বলে এক দুর্বীণ টিলা নামে পরিচিতি বাড়ে। পরবর্তীকালে এই সুফি সাধক সফাত আলি শাহ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং স্থানীয় তারামণি টিলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। কথিত আছে যখন সফাত আলি শাহ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে উপস্থিত হন তখন নাকি দুর্বীহ শাহ তার মায়ের পেটে। তখন সফাত আলি শাহ তার স্ত্রী কে বলেন তোমার গর্ভে একটি পুত্র সন্তান আসছে। তুমি তার নাম রেখে দিও ‘দুর্বীণ শাহ’। সফাত আলি শাহ ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেলেন। আসলেন মায়ের কোলে এই ভূবন মাতানো মরমী কবি দুর্বীণ শাহ। দুর্বীণ শাহ তার মায়ের কাছ থেকে ছোটবেলা থেকে আধ্যাত্মিক লাইনে পুঁজিটুকু সংগ্রহ শুরু করেন। জীবন পরিক্রমায় দুর্বীণ শাহ ৫৭ বসন্ত অতিক্রম করেন। তার অনবদ্য অবিনাশি ‘গীতিমালা’ তে ইলমে মারিফত, স্রষ্টার প্রেম এবং পল্লীর চিরাচরিত রূপ স্পষ্ট ভেসে ওঠে। তার গানের সুরে বাংলার মানুষের আনন্দ বেদনা, হাসি কান্না, প্রতিফলিত হয়। যেমন- তুই যদি হইতে গলার মালা চিকন কালা / তুই যদি হইতে গলার মালা / আদরে গলে পড়াইয়া, স্বহস্তে আয়না ধরিয়া / সাধ মিটাইতাম দেখিয়া নিরালা / ঐ অথবা নির্জন ও যমুনার কোলে, বসিয়া কদম্ব তলে / বাজায় বাঁশি বন্ধু শ্যামরায় / ঐ অথবা মুর্শিদ ছুরতে খোদা বর্তমান / খোদে খোদা আদম জাদা পয়দা ছুরতে ইনসান / ঐ মরমী কবি দুর্বীণ শাহ’র এই সব ভাবপূর্ণ গানের মধ্যে রয়েছে পল্লীগীতি, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী এবং হামদ, নাত। এছাড়া তিনি গভীর নিভৃতে বিচরণ ও সঙ্গীত রচনা করেছেন দেহ তত্ত্বে, প্রেম তত্ত্বে, কাম তত্ত্বে, পারঘাটা তত্ত্বে, বিরহী, বিচ্ছেদ, ইত্যাদিতে। তার গানের ভাষা বাংলা। তবে উর্দু, হিন্দি, ফারসী, ইংরেজী প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার হয়েছে। যেমন-ইয়া মোহাম্মদ সারওয়ারে আলম / তুম হ্যায় মেরে গড কি ফ্রেন্ড / ঐ তুমক যেছ দিন পয়দা কিয়া, ছিতারা ছুরত বানায়া / রাহে তুমনে শীর জুয়াকা / ইয়ার্স থ্রি নাইনট্রি থাউজেন্ড / ঐ অথবা অটোমিটিক কলের মিশিন এই দেহ সবার / টেকনিকেলের হেড মেস্ত্রী আপনে হলেন ফিটার/ ঐ। এ সব গানের নিগূঢ় তত্ত্বে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির এক মহা সম্পর্ক সেতু বন্ধন উজ্জীবিত হয়েছে। কবি দুর্বীণ শাহ সাংসারিক জীবনের সাথে আপস করেছিলেন। তিনি সাংসারিক জীবনে তিন ছেলে সন্তানের জনক ছিলেন। কিন্তু সংসারের এই মায়া মোহ লোভ লালসা তাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। তিনি বারবার আত্মশুদ্ধি-আত্মনিবারণের জন্য ছুটেছেন। অন্তর আত্মাকে সাধিত করেছেন সুমতির উপরে। সর্বদাই যেন এই কবির চোখে মুখে স্রষ্টার প্রেমের মনোভাব কল্পনা করা যেত। কারণ সুফি সাধকদের এই অধ্যায়ের কঠিন অনুশীলন করতে হয়। আর এই অনুশীলনের প্রধান উপাদান হল ‘জিকির বা স্মরণ’। ছয় লতিফার মধ্যে অন্যতম লতিফা হল ‘ক্বলব’আর এই ক্বলবের প্রধান খাদ্য হল জিকির। তাই সুফি সাধকদের প্রধান কাজ হচ্ছে নিজের ক্বলবকে সাধিত করা। যারা নিজের ক্বলবকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে ষড় রিপু তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সুফি সাধকদের এই অনুশীলনের মধ্যে অন্যতম বিষয় হচ্ছে দেহ তত্ত্ব। দেহকে ভেদ বিচার করা। আব, আতশ, খাক, বাদ এই চার পদার্থ এবং ছয় লতিফা প্রভৃতির প্রতি সঠিক ধ্যান ধারণা রাখা একান্ত জরুরী। কবি দুর্নীণ শাহ তার গানের এক ছত্রে লিখেছেন- মান আরাফা নাফছাহু, ফাক্বাদ আরাফা রাববাহু / দুর্বীণশাহ কয় এই যে হুকুম শুনলে প্রাণে বেকরার / ঐ। উপরে উল্লেখিত হাদিসের অর্থ হল ‘যে নিজেকে চিনে, সে আল্লাহকে চিনে’। এখন নিজেকে চেনা তো বড়ই কঠিন কাজ আর জগতে যারা নিজেকে চিনতে পারছেন তারা মরে অমরত্ব লাভ করেছেন। সুফি শব্দে গ্রীক ভাষা থেকে উদ্ভুত ‘মিষ্টিক’ বা মরমী কথাটির সামঞ্জস্য রয়েছে। সুফি শব্দটির উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। কারো কারো মতে এ শব্দটি আরবী সুফ (পশম) থেকে উদ্ভুত। আবার কারো কারো মতে ‘আহলাস সাফফা’ থেকে সুফি শব্দটির উৎপত্তি। যারা সর্বদাই আল্লাহর প্রেমে দুনিয়ার সকল পার্থিব লোভ লালসা থেকে বঞ্চিত হয়ে নির্জনে নিমগ্ন থাকে জিকির আজকার করে আমরা তাদেরকেই সুফি বলে থাকি। সুফি সাধকদের এই গূঢ়ার্থ পূর্ণ অধ্যায়কে ইলমে মারিফত বা বাতেনি বলে। কবি দুর্বীণশাহ তার গানের মধ্যে লিখেছেন- আমায় আমি চিনতে গেলে বাজে বড় গন্ডগোল / আমি কে হই আমা থেকে স্মরণ হইলে পড়ে ভুল / ঐ আমি গেলে সবই যাবে খোদা বলে কে ডাকিবে / দুর্বীণ শাহ কয় আমার ভাবে আমি আর চরণের ধূল / ঐ মরমী কবি দুর্বীণ শাহ’র প্রতিটি গানের ছত্রে তার নিজ আত্মাকে চেনার ভাবাবেগ প্রতিফলিত হয়েছে। আর এটাই তো সুফি সাধকের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শরীয়ত, হকিকত, তরিকত, মারিফত এর মধ্যে ইলমে মারিফত হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন। এই অধ্যায়ে যে অর্জন করেছে সে মুর্শিদের উছিলায় ‘সাইর ইলাল্লাহ’ থেকে ‘সাইর ফিল্লাহ’ দিকে ভ্রমণ করতে পারেন। এজন্যই তো বাউল কবিরা সব সময় আত্মশুদ্ধি টানে উন্মাদ হয়ে পড়েন। কবি দুর্বীণ শাহ সেই পথেরই একজন-নয়ন পুরে যাবে কোন্দল, মনটারে লয় করে পাগল / মাসুক ছবি করে সম্বল গাছ তলাতে ঠিকানা / কাঠ পুড়ালে আঙ্গার কালি অঙ্গরা পুড়ে হয় যে ছালি / শুনে লোকের গালাগালি তবু সে নাম ভুলে না-ঐ কবি দুর্বীণ শাহ তার অনবদ্য অবিনাশি এই সৃষ্টিকর্মের মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকবেন চিরকাল। তার এই সৃষ্টিকর্ম উপমহাদেশের বাউল সম্রাটের আসনে অভিষিক্ত হয়ে আছেন সাধারণ মানুষের হৃদয় জুড়ে। কবি দুর্বীণ শাহ ১৯৬৭ সালে প্রবাসী বাঙালিদের আমন্ত্রণে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন। সেখানে তার গানের কথা ও সুরে বিমোহিত হয়ে সঙ্গীত প্রেমীরা তাঁকে ‘জ্ঞানের সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
সূত্র : ক্লিক করুন
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১২ দুপুর ১:০২
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্যাড গাই গুড গাই

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

নেগোশিয়েশনে একটা কৌশল আছে৷ ব্যাড গাই, গুড গাই৷ বিষয়টা কী বিস্তারিত বুঝিয়ে বলছি৷ ধরুন, কোন একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে৷ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বুঝা যায় তার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

টান

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১১ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২২


কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর
বিচ্যুতি ঠেকা‌তে ছু‌টির পাহাড়
দিগন্ত অদূর, ছ‌বি আঁকা মেঘ
হঠাৎ মৃদু হাওয়া বা‌ড়ে গ‌তি‌বেগ
ভাবনা‌দের ঘুরপাক শূণ্যতা তোমার..
কোথাও স্ব‌স্তি নেই আর।
:(
হাঁটুজ‌লে ঢেউ এ‌সে ভাসাইল বুক
সদ্যযাত্রা দম্প‌তি... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরী

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৯

স্বল্প আয়ের লক্ষ্যে যে স্কিলগুলো জরুরীঃ


১। নিজের সিভি নিজে লেখা শিখবেন। প্রয়োজন অনুযায়ী কাস্টোমাইজ করার অভ্যাস থাকতে হবে। কম্পিউটারের দোকান থেকে সিভি বানাবেন না। তবে চাইলে, প্রফেশনাল সিভি মেকারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১১ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৫

অহনা বলেছিল, তুমি হারাবে না
অহনা বলেছিল, আমি জানি আমি তোমাকে পেয়েছি সবখানি
আমি তাই নিশ্চিন্তে হারিয়ে যাই যখন যেখানে খুশি

অহনা বলেছিল, যতটা উদাসীন আমাকে দেখো, তার চেয়ে
বহুগুণ উদাসীন আমি
তোমাকে পাওয়ার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিয়াল ফিলিস্তিনীরা লেজ গুটিয়ে রাফা থেকে পালাচ্ছে কেন?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১১ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



যখন সারা বিশ্বের মানুষ ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ফেটে পড়েছে, যখন জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে সাধারণ সদস্য করার জন্য ভোট নিয়েছে, যখন আমেরিকা বলছে যে, ইসরায়েল সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করার জন্য আমেরিকান-যুদ্ধাস্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×