somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লিচুতে কেমিক্যাল: ১৩ শিশুর মৃত্যু

২৭ শে জুন, ২০১২ সকাল ১০:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গত ২০ দিনে এরা মারা গেছে : ফল খেয়ে এত মৃত্যু এই প্রথম

মৌসুমী ফল লিচু। আর তা যদি হয় দিনাজপুরের, তাহলে তো কথাই নেই। শুধু দেশের মানুষ নয়, বিদেশেও দিনাজপুরের লিচুর আলাদা কদর। এবার জানা গেল সেই দিনাজপুরের লিচু খেয়ে ১৩টি শিশুর মৃত্যুর কথা। তাদের সবার বয়স ২ থেকে ৬ বছরের মধ্যে। আম বা লিচুতে কেমিক্যাল দেয়া হয়, আর তা খেয়ে আমরা হজম করার শক্তি অর্জন করেছি। কিন্তু ছোট্ট শিশুরা তো সেই শক্তি অর্জন করতে পারেনি, তাই হয়ত তাদের জীবন দিতে হল। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রোগ তত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ও আন্তর্জাতিক উদারময় গবেষণা কেন্দ্রর (আইসিডিডিআরবি) বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হয়েছেন বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত লিচু খেয়েই এই শিশুদের মৃত্যু হয়েছে। তারপরও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে মৃত শিশুদের রক্ত ও অন্যান্য নমুনা আমেরিকার সিডিসি আটলান্টায় পাঠানো হয়েছে। গত পহেলা জুন থেকে ২০ জুনের মধ্যে দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসব শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এসব শিশু লিচু বাগানে খেলার সময় লিচু খেয়ে অসুস্থ হয়।

আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছি কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় শিশুরা মারা গেছে। আর তা লিচু থেকে বিষক্রিয়াই। জানা গেছে, গত এক সপ্তাহ আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবি’র বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা দিনাজপুরে অবস্থান করে নানাবিধ পরীক্ষা নিরিক্ষা করে এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন।

কিডনি, লিভার, ক্যান্সার এবং শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের খবর ভয়াবহ আতঙ্কের বিষয়। গাছে কি এমন কেমিক্যাল দেয়া হল যে শিশুরা মারা গেল। তাদের মতে, যারা খাবারে কেমিক্যাল দিচ্ছে প্রচলিত আইনে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তাই তাদের জন্য মৃত্যুদণ্ড ছাড়া বিকল্প নেই। চীন ও থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে খাবারে ভেজালকারীদের মৃত্যুদণ্ডের আইন রয়েছে। বাংলাদেশেও এই আইন এখন কার্যকর করার সময় এসেছে। তা না হলে ঘরে ঘরে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হবে মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. খন্দকার মো. সিফায়েত উল্লাহ ইত্তেফাককে বলেন, সরেজমিন ঘুরে আসা বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ফল খেয়ে একসঙ্গে এত শিশুর মারা যাওয়ার ঘটনা এই প্রথম।

গতকাল মৃত শিশুদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে সন্তানহারা পিতা-মাতার আর্তনাদ। ডাক্তাররা কোন কিছু বুঝার আগেই শিশুগুলো ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। আর স্বজনদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে যাচ্ছিল। স্বজনরা বার বার চিত্কার করছিল আর বলছিল কি হয়েছিল আমার সন্তানের। এর কি কোন চিকিত্সা নেই? শিশুরা অসুস্থ হওয়ার পর তাত্ক্ষণিকভাবে অনেকেই ভেবেছিল এটা নিপা ভাইরাস হতে পারে। কিন্তু নিপা ভাইরাসের লক্ষণগুলো ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।

অজ্ঞাত এই রোগে গত পহেলা জুন থেকে ২০ জুন পর্যন্ত হাসপাতালে ১৫ শিশু ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ১৩ জন। শুরুতে চিকিত্সকরাও রোগের ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি। ফলে ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞদের ডাকা হয়। পরীক্ষা নিরিক্ষার পর তারা নিশ্চিত হয় লিচু খাওয়ার পর বিষাক্ত কেমিক্যালেই তাদের মৃত্যু হয়েছে।

হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিনাজপুর বিরল মহেশপুরের মো. আইনুলের মেয়ে মোছা. নিভা (৪ বছর ৬ মাস) এবং বিরল রামপুরের মো. সোহাগের মেয়ে মোছা. সায়লাকে (৪) অজ্ঞাত রোগে গত ১ জুন দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেই দিনই তাদের মৃত্যু হয়। এরপর ৬ জুন বিরল উপজেলার মাধববাটি গ্রামের বাবুল হোসেনের ছেলে বোরহানকে (২), ৭ জুন বিরল উপজেলার রুনিয়া গ্রামের মো. করিমুল ইসলামের ছেলে নুর কিবরিয়াকে (৪), ৮ জুন বিরল উপজেলার জসরাল গ্রামের মার্কুসের ছেলে সাগরকে (৪), ৯ জুন সদর উপজেলার সুন্দরবন গ্রামের কাশের আহমেদের মেয়ে নার্গিসকে (৬), ১৪ জুন ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বরচুনা গ্রামের মানিক চন্দ্রের মেয়ে তাপসিকে (২ বছর ৬ মাস), ১৫ জুন দিনাজপুর চিরিরবন্দর উপজেলার কিষ্ণপুর গ্রামের মো. তৈয়বুরের ছেলে তাজমিরকে (১০), ১৬ জুন সদর উপজেলার পারগাঁ গ্রামের হোপনা সরেনের ছেলে নয়নকে (২), ১৭ জুন সদর উপজেলার আকবরপুর গ্রামের ধোলা বাবুর ছেলে ধনঞ্জয়কে (৬), ২০ জুন সদর উপজেলার বড়ইল গ্রামের নিতিশের মেয়ে সুবর্ণাকে (৫) এবং একই দিন ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ওই দিনই তারা মারা যায়। এছাড়া বিরল উপজেলার জসরাল গ্রামের জালালের ছেলে সুজন বর্তমানে চিকিত্সাধীন রয়েছে এবং বীরগঞ্জ উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের জাহেরুলের ছেলে আলামীন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে।

শিশুরা অসুস্থ হওয়ার পর চিকিত্সকের সাথে কথা বললে তারা বলেছিলেন এটি একটি অজ্ঞাত রোগ। তবে তারা সন্দেহ করেছিলেন যে কেমিক্যাল মিশ্রিত কোন কিছু খাওয়ার ফলে এ রোগ হতে পারে। পরে অবশ্য তাদের সেই সন্দেহই ঠিক হল।

দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ডা. ওয়ারেশ আলী জানান, গত ১ জুন থেকে এ ধরনের রোগী দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসতে শুরু করে। প্রথম দিন ২ জন শিশু ভর্তির কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের মৃত্যু হয়। এরপর একে একে এভাবে শিশু মৃত্যু চলতে থাকলে ঢাকার আইইডিসিআর’র বিশেষজ্ঞ দলকে অতি দ্রুত দিনাজপুরে আসার জন্য আহবান জানানো হয়।

ডা. ওয়ারেশ আলী আরও জানান, আইইডিসিআর’র বিশেষজ্ঞ দলটি এখন পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে কাজ করে চলেছে। বিশেষজ্ঞ দলের প্রধান ও আইইডিসিআর’র পরিচালক ডা. প্রফেসর মাহমুদুর রহমান জানান, এখন পর্যন্ত তাদের পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে তারা নিশ্চিত হয়েছেন লিচুতে মেশানো কীটনাশকের তীব্রতার কারণে শিশুগুলোর মৃত্যু হয়েছে। সব পরীক্ষা দেশে করা সম্ভব নয়। তাই পরীক্ষার জন্য বিদেশে প্রেরণ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মৃত শিশুদের বেশিরভাগেরই বাড়ি লিচু বাগানের পাশে। লিচু বাগানে সেপ্র করার সময় বিষক্রিয়া চারদিকে ছড়িয়ে যেতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত শিশুর প্রচণ্ড জ্বর হয় ও সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে এবং খিচুনি হয়। হাসপাতালে নিয়ে আসলে একের পর এক শিশুর মৃত্যু ঘটে।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক লিচু ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, লিচুতে রাসায়নিক পদার্থ বা কেমিক্যাল ফরমালিন না দিলে ফলের রঙ সুন্দর হয় না। এবং বেশি দিন টাটকা থাকে না। এর ফলে ক্রেতারা কিনতেও চায় না। ক্রেতারা না কিনলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে এসব কেমিক্যাল ফলের সাথে মেশাতে হয়।

একজন বাগান মালিক জানান, চলতি বছর প্রচণ্ড খরার ফলে ফল বড় হয়নি। অপরদিকে হঠাত্ করে বৃষ্টি হওয়ায় লিচুর পচন শুরু হয়, লিচু ফেটে যায়। পচন ও ফেটে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ঘন ঘন ক্যামিকেল সেপ্র করা হয়। তবে এ ধরনের অধিকাংশ ঘটনাই বিরল উপজেলায় ঘটেছে। একজন কৃষি বিশেষজ্ঞ জানান, অনেক বাগান মালিক লিচু গড়া পচন ও একসঙ্গে না পাকার জন্য মাঝে মধ্যে হরমোন সেপ্র করে থাকে। কারণ একই সঙ্গে পুরো বাগানের লিচু যদি পেকে যায় তাহলে বাজারজাত করতে সমস্যা দেখা দেয়। তিনি জানান, হরমনে তেমন কোন ক্ষতি হওয়ার কারণ নেই। তবে কোন অজ্ঞাত ক্যামিক্যাল সেপ্র করা হলে বিপদ হতে পারে। অবশ্য ১৫ দিন পরে খেলে তেমন কোন ক্ষতি হয় না বলে তিনি জানান।

দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডা. মওদুদ হোসেন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এ পর্যন্ত ১৩ জন শিশু মারা গেছে। প্রকৃত কারণ কি এবং কি কারণে মারা গেছে তা তিনি বলতে পারেন না। তবে তিনি জানান, মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এখনও মাঠ পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ দল কর্মরত রয়েছে।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কথাটা খুব দরকারী

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ৩১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৩৪

কথাটা খুব দরকারী
কিনতে গিয়ে তরকারি
লোকটা ছিল সরকারি
বলল থাক দর ভারী।

টাকায় কিনে ডলার
ধরলে চেপে কলার
থাকে কিছু বলার?
স্বর থাকেনা গলার।

ধলা কালা দু'ভাই
ছিল তারা দুবাই
বলল চল ঘানা যাই
চাইলে মন, মানা নাই।

যে কথাটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×