somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এ গল্পের কোন নাম নেই !!

২৫ শে জুন, ২০১২ রাত ১২:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার কেবল মনে হল যে ছেলেটার পেছন পেছন দৌড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই । সিমুকে বাঁচাতে হলে কেবল এই কাজটাই করতে হবে ।
দৌড়াতে হবে ।
এই কঠিন জ্যামের মধ্যে গাড়িটা সেই কখন থেকে নিশ্চল হয়ে দাড়িয়ে আছে । অথচ আমাদের হাতে সময় নেই একদম ।
ছেলেটা ততক্ষনে দৌড়াতে শুরু করেছে । বাবা প্রথমে বাঁধা দিতে চেয়েছিল কিন্তু ছেলেটা শুনলোই না । সিমুকে কাধে তুলে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল । আমি নিজেও ছেলেটির পেছন পেছন দৌড়াতে শুরু করলাম ।
অন্য সময় হলে আমি হয়তো নিজেই এই দৃশ্যটা বিশ্বাস করতাম না । কিন্তু আমি এখন নিজেই এর ভিতরে ঢুকে গেছে । আমি জানি, সচরাচর এই শহরে এই দৃশ্য দেখা যায় না ।
প্রচন্ত জ্যামে পুরো শহর থেমে আছে । তার মধ্যে সাদা শার্ট পরা একটা ছেলে, ২৪ বা ২৫ বছর বয়স হবে, একটা ১০ বছরের মেয়েকে কাঁধে তুলে দৌড়াচ্ছে ।
ছোট্ট মেয়েটার নাক, মুখ আর কান দিয়ে অনবরত রক্ত পরছে । সেই রক্তে ছেলেটার সাদা শার্ট ভেসে চলে যাচ্চে কিন্তু ছেলেটার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ।
যেকোন ভাবেই হোক হাসপাতালে যেন তাকে পৌছাতে হবে । ঐ ছেলেটার পেছন পেছন আর একটা মেয়েও দৌড়াচ্ছে প্রানপনে । আর তার পেছন একজন মাঝ বয়সী লোক ।
এই দৃশ্য কি বাস্তবে সহজে চোখে পড়বে ?
ছেলেটি রাস্তার ওপারে পৌছে গেছে । এখনই বোধহয় রিক্সায় চড়বে ! ওখান থেকে রাস্তা মোটামুটি ফাকাই বলা চলে ।
আমি দাড়াও বলে কোন মতে চিত্‍কার দিলাম ।
আমার দম ফুরিয়ে এসেছে । একটা মেয়ে হয়ে এতো দুর দৌড়ে এসেছি ভাবতেই অবাক লাগছে । অন্য সময় হলে হয়তো এতোদুর আমি হেটেও আসতে পারতাম না ।
আসলে পরিস্থিতি মানুষকে কি না করতে বাধ্য করে ।
আমি দেখলাম ছেলেটা লাফ দিয়ে রিক্সায় উঠল । কিন্তু রিক্সা ছেড়ে দিল না । তারমানে ছেলেটা আমার চিৎ‍কার শুনতে পেরেছে । আমার জন্য অপেক্ষা করছে ।
আমি আরো জোরে পা চালালাম । পৌছে গেলাম রিক্সার কাছে যা ভেবেছিলাম তারও আগে ।
আমি জানতামই না এতো জোরে দৌড়াতে পারি আমি?
রিক্সায় উঠতেই বুঝলাম আমার বুকটা কি পরিমান হাপাচ্ছে । আমি রিক্সার পেছনে তাকিয়ে দেখলাম বাবা তখনও অনেকটা পেছনে ।
আসতে আরো সময় লাগবে ।
রিক্সা চলতে আরাম্ভ করল । হাসপাতালে পৌছাতে আর বড় জোর পনের বিশ মিনিট সময় লাগবে !
আমার বোনটা বাঁচবে তো ? ওকে বাঁচাতে পারবো তো ?
ছেলেটা সিমুকে আমার কোলে দিয়ে মোবাইল বের করে কাকে যেন ফোন দিল ।
-কোথায় তোরা ?
খানিক নিরবতা ।
-হ্যা । জলদি মেডিক্যালে পৌছা । ইমার্জেন্সি !
তারপর ছেলেটা আর এক জায়গায় ফোন দিল
-হ্যা তুহিন কই ? ওকে! ডাক্তার শফিকের কাছে যা । ইমার্জেন্সির সামনে রেডি থাকতে বল । জলদি জলদি ।
ফোন কেটে দিয়ে তৃতীয় বারের মত ফোন দিল ছেলেটা ।
-রাফি ?
-
-কোথায় তোরা ?
-
-একটু মেডিক্যালে আয় জলদি ।
-
-হ্যা রক্ত লাগবে ।
-
-কোন গ্রুপ ?
ছেলেটা এবার আমার দিকে ফিরল । জিজ্ঞেস করল
-আপনার বোনের রক্তের গুপ কি ?
-আমি জানি না ।
-আচ্ছা । ব্যাপার না ।
ছেলেটা আবার ফোনে ফিরে গেল ।
-যতজনকে পারিস রেডি রাখ । আমি আধঘন্টার মধ্যে জানাচ্ছি ।
রিক্সা হাসপাতালের সামনে থামতেই ছেলেটি সিমুকে নিয়ে আবার দৌড় মারল । আমিও পেছন পেছন দৌড় দিলাম ।
দেখলাম জরুরী বিভাগের সামনে আগে থেকেই কয়েক জন দাড়িয়ে আছে স্ট্রেচার নিয়ে । আরো চারপাচ জন ছেলে দুতিন জন নার্স আর একজন ডাক্তার গোছের লোক । তবে তার বয়স কম । ছেলেটার থেকে কিছু বেশি হবে ।
ছেলেটা স্ট্রেচারের উপর সিমুকে সাবধানে শোয়াল । তারপর দ্রুত ভিতরের দিকে চলে গেল ।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম চারিদিকে কেমন একটা হুলস্থুল বেধে গেল সিমুকে নিয়ে । ডাক্তারা ছোটাছুটি করছে । কিছু ছেলে চলে এসেছে রক্ত দেবার জন্য । আরো কত কি ? এরই মধ্যে বাবা চলে এসেছে ।
খুব হাপাচ্ছে !
ছেলেটি বাবাকে ধরে বেঞ্চের উপর বসালো । বলল
-আঙ্কেল আপনি শান্ত হয়ে বসুন । আর আল্লাহকে ডাকুন । এখন সব ওনার হাতে ।
এমন সময় একজন ডাক্তার এসে পেছনে দাড়াল ।
-প্রতিক ?
ডাক্তার ডাক দিল ।
-জি শফিক ভাই !
-অপারেশন করা লাগবে এখনই । এখনই যদি ইন্টার্নাল ব্লিডিং থামানো না যায় অবস্থা আরো সিরিয়াস হয়ে যাবে । রোগীর রিলেটিভ কোথায় ?
-এই তো ।
ডাক্তার শফিক একটা কাগজ এগিয়ে দিল বাবার দিকে ।
-এখানে সাইন করুন ।
সাইন নিয়ে ডাক্তার চলে গেল ।
আমি বাবার পাশে বসে রইলাম চুপ করে ।
কেন জানি আর ভয় করছে না । এতো গুলো মানুষ সিমুর জন্য এসেছে ! সিমুকে বাঁবানোর এতো চেষ্টা বৃথা যেতে পারে না ।
কিছুক্ষন আগে যখন রাস্তায় জ্যামের মধ্যে বসে ছিলাম তখন খুব ভয় লাগছিল । বারবার মনে হচ্ছিল আমার ছোট্ট বোনটাকে বুঝি আর বাঁচাতে পারলাম না ।
কিন্তু কোথা থেকে ফেরেস্তার মত প্রতিক নামের ছেলেটা এসে হাজির হল । এখন দেশের মানুষ আর অন্যের সমস্যা নিজের সমস্যা বলে মনে করে না ।
কিন্তু ছেলেটা করল । যখন গাড়ির মধ্যে সিমুকে দেখল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
-কি হয়েছে ?
চোখ দিয়ে কেবল পানিই বের হচ্ছিল তখন । কোন মতে বললাম যে
-সিড়ি থেকে পড়ে গেছে ।
ছেলেটার আরো কাছে এসে বলল
-আরে এর অবস্তা তো খুব খারাপ । এখাবে বসে থাকলে তো বাঁচানো যাবে না । দেখি বের হন গাড়ি থেকে ।
ছেলেটা এক প্রকার জোর করেই সিমুকে গাড়ি থেকে বের করে আনল । ছেলেটার হাতে একটা পপকর্ণের প্যাকেট ছিল । ভরাই বলতে গেল । সবে মাত্র মুখ খোলা হয়েছে ।
প্যাকেটটা গাড়ির ব্যাগ সিটে পরে রইল ।
সত্যি প্রতীক না থাকলে আজ হয়তো এখনও এপর্যন্ত আসতেই পারতাম না ।
একটা সময় হাসপাতালের কোলাহল কমে যায় । একটু আগে যেমন কত লোক ছিল আসেপাশে কিন্তু এখন পুরো করিডোরটা জুরে কেবল আমি আর বাবা ! মাঝে সাঝে দুএক জন নার্সকে দেখা যাচ্ছে ।
আশ্চার্য নিরব সব কিছু । অপারেশন থিয়েটারের লাল লাইটটা বন্ধ হতেই একজন ডাক্তার বেড়িয়ে এল ।
বেশ বয়স্ক ।
বাবা আর আমি কাছে গেলাম । ডাক্তার মুখের মাস্ক খুলতে খুলতে বলল
-অবস্থা এখনও সিরিয়াস তবে আশংকা কেটে গেছে অনেকটা । ভয় পাবেন না ।
বাবা হু হু করে কেঁদে দিলেন । আমিও আর কান্না আটকিয়ে রাখতে পারল না । তবে এ কান্না আনন্দের কান্না । প্রিয় জনকে না হারানোর আনন্দ ।
আমার প্রথমেই মনে হল প্রতীক নামের ছেলেটাকে আগে ধন্যবাদ দিতে হবে । ও না থাকলে আজ আমার বোন বাঁচতো না । কিছুতেই বাঁচতো না ।
আমি মানছি আল্লাহ সবাইকে বাঁচান । কিন্তু উছিলারতো দরকার হয় । প্রতীক সেই উছিলা হয়েই আমার বোনকে বাচিয়েছে ।
কিন্তু আসেপাশে কোথাও প্রতীক অথবা তার কোন বন্ধুবান্ধবকে দেখতে পেলাম না ।
একেবারে পুরোপুরি হাওয়া । পরবর্তী এক ঘন্টা আমি কেবল প্রতীক কেই খুজলাম । কিন্তু কোথাও তাকে পেলাম না ।
তারা কোথায় গেল সবাই ?


ফেবু লিংক
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১২ রাত ১:০০
১৭টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×