somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প : একটি অপ্রথাগত প্রেমের গল্প

২২ শে জুন, ২০১৩ সকাল ৭:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অপ্রত্যাশিত দৃশ্যটা দেখে সাত সকালেই হাবিব সাহেবের মনটা ভালো হয়ে গেল।ঢাকায় এখন মাঠ তো দূর ,খোলা জায়গাও খুব বেশী নেই। সামনের মাঠটা তাই নিজেই একটা বিষ্ময়। তার উপর আজ প্রবল ঝমঝম বৃষ্টিতে ভিজে একদল বালক ফুটবল খেলায় মেতেছে। দৃশ্যটা দেখে এমনিতে কঠোর স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ হাবিব সাহেব আজকের মর্নিং ওয়াকটা মাটি হবার দুঃখটাও ভুলে গেলেন।আশ্চর্য, যান্ত্রিক ঢাকায়ও এমন দৃশ্য দেখা যায়!ছেলেবেলার ফিরে যাবার মত একটা অনুভূতি হল তাঁর,ঐ ছেলেদের মাঝে যেন তাঁর অদৃশ্য উপস্থিতি । পাশে বসা রেহানা বেগমের দিকে তাকালেন তিনি। রেহানা বেগমের চোখও ঐদিকে ,কিন্তু তাতে হাবিব সাহেবের উত্তেজনা বা চাঞ্চল্যের কিছুই নেই.। অহহো , থাকবে কোথা থেকে, মেয়েদের স্মৃতি এইসবে থাকে না,থাকে অন্যকিছুতে যার পরিধির কোন খবরই হাবিব সাহেব জানেন না- তিনি চিরকুমার।

প্রেমে ব্যর্থ হওয়া বা এই জাতীয় কিছু না। হাবিব সাহেবের মা অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন, বাবা তাও কিছু অভাব বুঝতে দেননি। তবে সতের বছর বয়সে তিনিও যখন মারা গেলেন তখন থেকেই সংসারের প্রখর রৌদ্রের তাপটা হাবিব সাহেব বোঝা শুরু করলেন হাড়ে হাড়ে। তার পর যা হয় আরকি ,ছোট চার ভাইবোনের দ্বায়িত্ব পালন করতে করতে কখনো কারো স্বামী না হয়েই একেবেরে পিতৃত্বের আসনে প্রমোশন হয়ে গিয়েছিল তাঁর । তারপর যখন সময় হল, তখন মেঘে অনেক বেলা পেরিয়ে গেছে।একা থাকতে থাকতে তাঁর একসময় একাকীত্বে শুধু অভ্যস্ততা না, ভালো লাগা এসে যায়। ভালোই তো, তাঁর অন্য বন্ধুদের মত সাংসারিক সব ঝামেলা - সমস্যা থেকে তিনি মুক্ত। এই জন্যেই শেষ বয়সে তাঁর সব দায় দায়িত্বের পালা নিবারণ শেষে ভাইবোনদের বাড়িতে তাদের কারো সাথে না থেকে তিনি আজ শান্তিনীড় বৃদ্ধাশ্রমে।কারো কাছে উঠতে ইচ্ছা হয় না , বৃদ্ধরা শেষ পর্যন্ত একটা বোঝা হয়ে যায়। তার চেয়ে এই চিরভ্যস্ত স্বাধীনতা- এইই ভালো।তাছাড়া তার ভাই বোন গুলো এখানে প্রায়ই আসে, দেখা সাক্ষাৎ এবং অবধারিত জোরাজুরি , সঙ্গে থাকার জন্য।

বিশেষ কারে সবচে ছোটটা-রীমা সবচেয়ে বেশী রাগ করে। এবোনটি তাঁর সবচে আদরের, তাঁকে একটা বিয়ে দিতে , সংসারী করতে সে কম চেষ্টা করে নি। এমনকি এই প্রৌড় বয়সে পৌঁছে যাবার পরও সে হাবিব সাহেবকে বিয়ে করার কথা বলে।
"তোর মাথাটাথা কি খারাপ হয়ে গেল নাকি রে? ঘাটের মড়াকে কে বিয়ে করবে?"
রীমা এসব কথায় অসম্ভব ক্ষেপে যায়।শুধু রাগ না ,একধরনের গিল্টি ফিলিংসও হাবিব সাহেব পরিষ্কার টের পান,ওদের জন্যই যে এখনও তিনি সংসারসুখ বঞ্চিত তা রীমাকে এক ধরনের অপরাধবোধে আচ্ছন্ন করে।তার এসব কথা তিনি আর কারো সাথে শেয়ার করেননি , কাউকে শেয়ার করার জন্য পানওনি আসলে, কেবল রেহানা বেগমকে ছাড়া।

বৃদ্ধাশ্রমে কেউ শখ করে আসে না ,বাধ্য হয়ে আসে-যখন ছেলেমেয়েরা মনে করে বাবামার কাছ থেকে আর কিছু নেবার বাকি নেই এবং এখন ওরা নিজেরই মহীরুহে পরিণত হয়েছে- পরগাছা থেকে, তাই তাদের আর কোন অবলম্বনের দরকার নেই।সবাই ভিতরে ভিতরে সেই সন্তানের জন্যই কাতর, রেহানা বেগমের ক্ষেত্রেও ব্যাপার কিছু আলাদা ছিল না। একদম সকালে উঠে বৃদ্ধাশ্রমের লাগোয়া নিজস্ব পার্কের বেঞ্চে এসে বসে থাকতেন।ধনী গৃহের গৃহবধূ - সারাজীবন নিজে বিন্দূমাত্র বিলাসিতা না করে বাচ্চাদের 'মানুষ' করায় ব্যস্ত ছিলেন রেহানা বেগম। স্বামী মারা যাবার পর ছেলেমেয়েরা কৌশলে এমনকী তাঁর নিজের নামে থাকা সম্পত্তিটুকুও নিজেদের নামে লিখিয়ে নিয়েছে।সাবা জীবনের অন্তঃসারশূন্যতা আর রিক্ততায় তিক্ত প্রতারিত মন।হাবিব সাহেবের মর্নিং ওয়াকের সময়টায় টুকটাক কথা বলতে বলতে ওদের পরিচয়।একজন বাহ্যত একাকী অপরজন অন্তরে - এই বৈপরীত্যই কি ওদের কাছে টেনে এনেছিল?সন্তান থেকে দূরে থাকার কষ্ট ভোলা যায় না তবে শেয়ার করে সহনীয় করা যায় । মনের কথাগুলো অদলবদল করার সম্পর্ক গড়ে ওঠে ওঁদের।

আজ যখন হাবিব সাহেব ছোটবেলার ফুটবল খেলার একটা মজার ঘটনার কথা বলতে গিয়ে পাশে মুখ ফেরালেন তখন রেহানা বেগমের দিকে তাকিয়ে তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গেল। রেহানা বেগমের চোখে মুখে প্রবল ব্যাথার ছাপ।মুহূর্তের মাঝে হাবিব সাহেবের চোখের সামনেই ঢলে পড়লেন তিনি।

ডাক্তার বলেছে ভয়ের কিছু নেই তাও হাবিব সাহেব প্রচন্ড ভয় পাচ্ছেন। না না মৃত্যুভয় নয়, তারচাইতেও বেশী কিছুর ভয়- রেহানা বেগমকে হারানোর ভয়।সময় ঘনিয়ে এসেছে -দুজনেরই; কিন্তু কতটা তা এমনকি যখন থাকার জন্য বৃদ্ধাশ্রমে এসেছিলেন তখনও বোঝেননি হাবিব সাহেব যতটা না আজ বুঝতে পেরেছেন।জীবনের পড়ন্ত বেলা হলেও তাঁর ষাট বছরের ভালোবাসা, ভার্সিটি পড়ুয়া উনিশ-কুড়ি বয়সের চেয়ে একতিলও কম নয়।ভালোবাসার রং সবসময়েই এক।
রেহানাকে প্রস্তাবটা দেবার সময় বুক কেঁপেছে তাঁর- বেশী চাইতে গিয়ে যা পেয়েছেন তাও যদি হারাতে হয়? কিন্তু সময় -ও যে বড়ই কম -অপেক্ষা তাঁর সহ্য হবে না, তাই বলেই ফেলেছিলেন।

রেহানা বেগম চমকে উঠেছেন, "এ ও কি সম্ভব"!হ্যাঁ, নিজের কাছে স্বীকার করতেও তাঁর সঙ্কোচ হয়, কিন্তু তিনিও হাবিব সাহেবকে ভালোবাসেছেন- নিয়মের বাইরে নিজেকে লুকিয়ে,যা হাবিব সাহেবের প্রপোজাল এর সাথে সাথে নিজের গুপ্ত অবস্হান ছেড়ে বাইবে চলে এসেছে ,একেবারে নিজের কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেছে।তাঁর স্বামী গিয়াস সাহেবের সংসারে তিনি ছিলেন ঘটিবাটি- হাড়িপাতিলের মতই সংসারের অবশ্যপ্রয়োজনীয় একটা জিনিস যাকে বাকিরা ব্যবহার করেছে। কোনদিন গিয়াস সাহেব জানতে চাননি তা পছন্দের রং কি কিংবা কি তার ভালো লাগে। কোন ব্যাপারেই তাঁর মতামত তিনি জানতে চাইতেন না। স্রেফ হিসেবি সাংসারিক এক মানুষ যিনি অর্থের যোগান দিতেন ,আর কিছুর নয়, আর রেহানা বেগম দিতেন শ্রম ও মমতা।

হাবিব সাহেবকে সাংসারিক বিবেচনার বাইরে গিয়েই তিনি ভালোবেসেছেন তা স্বীকার করতে মুখ লালিমায় ঢেকে গিয়েছে তাঁর কিন্তু অস্বীকার তিনি করতে পারেন নি।কিন্তু বিয়ে, এই বয়সে? তাও পশ্চিমা দেশ হলেও তো কথা ছিল;ওদেশে সবই চলে, কিন্তু হাবিব সাহেব ভাংবেন তবু মচকাবেন না,রেহানা বেগমকে শেষ পর্যন্ত রাজি করাতে তিনি সমর্থ হলেন।

তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে কানাঘুষা যথেষ্টই শুরু হয়েছিল, মানুষের চোখ তো বন্ধ থাকে না। গুঞ্জন সত্য হওয়ায় সবাই খুশি। এমনকি শান্তিনীড়ের সবাই মিলে দিনক্ষণ ও ঠিক করে ফেলল, বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা নিজাম- নিলুফার দম্পতিসহ সবাই অনুষ্ঠানের তোড়জোড় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
"ছেলেমেয়েদের জানাতে হবে,কে জানে কি জানি বলবে ওরা !"উদি্বগ্ন রেহানা বেগম বললেন হাবিব সাহেবকে।
ছেলেমেয়ে যতই মা-বাপকে ভুলে যাক না কেন,মাবাবারা কখনো তাদেরকে ভোলে না।
কিন্তু তাদের জানানোর দরকার রেহেনা বেগমের ছিল না কেননা কিভাবে কিভাবে যেন ওরা আগেই খবর পেয়ে গিয়েছিল।সব একসাথে এসে হাজির বিয়ে ভাঙার জন্য।
"এই বয়সে বিয়ে! ছি ছি মা তোমার একটু লজ্জাও করলো না"বড় ছেলে ইমরানের সাথে তাল মেলায় মেজো মেয়ে শায়লা,
"লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না"।
আরক্ত নির্বাক রেহেনা, তিনি অবশ্য এরচে বেশী কিছুর আশা ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে করেনওনি।
কিন্তু হাবিব সাহেব চুপ করে থাকার মানুষ নন।
"বুড়ো মাকে এভাবে ওল্ডহোমে ফেলে গেলেও তো লোকে ভালো বলে না, কিন্তু তখন তো তোমরা লোকের চেয়ে নিজের কথাই বেশী করে ভেবেছো,আর আজ যখন তোমাদের মা নিজের খুশির জন্য কিছু করছেন তখন লোকের কাছে তোমাদের মায়ের সুখের চেয়ে নিজেদের ভুয়া সম্মান বড় হয়ে গেল?এতদিন ধরে মাকে ফেলে রেখেছো এমনকি মায়ের একবার খবর নেয়ার সময়ও হয়নি তোমাদের অথচ নিজের স্বার্থে ঘা লাগায় আজ এক্কেবারে দল বেঁধে হাজির।"

কিছুতেই বিয়ে ভাঙতে না পেরে বিফল মনোরথ রেহানা বেগমের ছেলেমেয়েরা যার যার বাড়ি ফিরে যায়।বলাই বাহুল্য তারা বিয়েতে আসে নি,তবে হ্যাঁ রসিক রীমা ওদের কাছে কার্ড পাঠাতে ভুল করে নি। আর হাবিব সাহেবের বিয়েতে উপস্থিত না থাকলেও তার ভাই বোনের পরিবার উভয়পক্ষের সকল কাজ নিপুন ভাবে সম্পন্ন করেছিল, অনুষ্ঠানে কনেপক্ষের অভাব একেবারেই বোঝা যায় নি।
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×