somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গণভোট, স্বাধীন স্কটল্যান্ড ও অখণ্ড যুক্তরাজ্য

১৫ ই জুন, ২০১২ বিকাল ৪:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অনেকের ধারনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য এখনও অস্তমিত হয়নি, তাদের এরুপ মনভাবের যথেষ্ট কারন রয়েছে, রপ্তানির চেয়ে আমদানি বেশি, কল্যাণ রাষ্ট্রের বদৌলতে তাদের জনগণ যেখানে এখনও বসে বসে খায়, নিজের দেশের মানুষ যেখানে রাজতন্ত্রের অহেতুক খরছে মনঃক্ষুণ্ণ সেখানে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের মানুষ ব্রিটেনের রানীকে রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে পেয়ে যথেষ্ট খুশি। গ্রেট ব্রিটেনে বা যুক্তরাজ্যের এই সাফল্যের পিছনে কি আছে? সবারই জানা যুক্তরাজ্যেই পৃথিবীর প্রথম শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল আর এই বিপ্লবকে কাজে লাগিয়ে আজ তারা বিশ্ব অর্থ ব্যাবস্থাপনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, অর্থ সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে নিউইয়র্কের পাশাপাশি লন্ডনের নামটি অবধারিত ভাবে চলে আসে। তেমন কিছু উৎপাদন না করেও আজ তারা পৃথিবীর ৬ষ্ঠ সম্পদশালী দেশ, ইউরোপে জার্মানি আর ফ্রান্সের পরেই তাদের স্থান। এই সাফল্যের বীজ কিন্তু বপিত হয়েছিল ১৭০৭ সালে যুক্তরাজ্য প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই আর ঐ যাত্রায় তাদের সঙ্গী হয়েছিল স্কটল্যান্ড পরে এই অগ্র যাত্রায় আরও যোগ দিয়েছিল নর্দান আয়ারল্যান্ড আর ওয়েলস আর সেই থেকেই এই চার দেশের যুক্ত রুপকেই বলে হয়ে থাকে যুক্তরাজ্য।

আজকের লেখার বিষয়বস্তু কিন্তু যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি নিয়ে না বরং স্কটল্যান্ডের আলাদা হওয়ার বা স্বাধীনতা ঘোষনার বিষয়টি যা কিনা যুক্তরাজ্য তথা পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে! ১৯৯৯ সাল থেকে ওয়েলস আর স্কটল্যান্ডে আলাদা পার্লামেন্ট চালু হয়েছে আর আয়ারল্যান্ডে এই ব্যাবস্থা শুরু হয় একটু দেরিতে ২০০৭ এর দিকে। এই ব্যাবস্থায় সর্বোচ্চ আসন লাভকারি দল সরকার গঠন করে আর সরকারের প্রধানকে বলা হয় ফাস্ট মিনিস্টার। ২০১১ সালের মে মাসের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টির ভয়াবহ বিপর্যয় হয় আর এতে স্কটল্যান্ডের সংসদে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এস.এন.পি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বরাবরের মত এবারও নির্বাচনে তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল ‘স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা’! নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর এস.এন.পি প্রধান ও ফাস্ট মিনিস্টার আলেক্স সালমন্ড আরও বলিষ্ঠ কণ্ঠে ভবিষ্যৎ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন আর এতেই লন্ডনের ক্যামেরন সরকারের কপালে ভাজ পরা শুরু হয়। এস.এন.পি’র এত মরিয়া হয়ে উঠার কারনটা কি? বিশ্লেষকরা বলেন অনেক দিন থেকে চলে আসা রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক বৈষম্য আর স্কটিশদের চিরাচরিত স্বাধিনচেতা মনোভাবই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

পর্যটন, তেল আর মৎস্য আহরণকে ঘিরেই স্কটিশদের অর্থনীতি, কিন্তু আহরিত সম্পদ তারা সরাসরি ব্যাবহার করতে পারেনা, সরকার সেই টাকা বাৎসরিক বাজেট চাহিদা অনুযায়ী ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস আর স্কটল্যান্ডের মাঝে বিতরন করে থাকে। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী যুক্তরাজ্যের তেল থেকে মোট ৬.৫ বিলিয়ন পাউন্ডের আয়ের মাঝে ৫.৯ বিলিয়ন পাউন্ডের সমপরিমান তেল স্কটল্যান্ড থেকে আহরন করা হয়েছে কিন্তু তারপরেও স্কটল্যান্ডের বাৎসরিক বাজেট ঘাটতি প্রায় ৬.৮ বিলিয়ন পাউন্ড।

স্কটিশদের নিজেদের পার্লামেন্ট থাকলেও অর্থনীতি আর পররাষ্ট্র এই দুই ক্ষেত্রে তাদের বিন্দুমাত্র অংশগ্রহন নেই এক্ষেত্রে ব্রিটিশ পার্লামেন্টই সর্বেসর্বা। স্কটল্যান্ড হয়ত বাজেট তৈরি করতে পারে কিন্তু বরাদ্দের জন্য ওয়েস্টমিনিস্টারের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী স্কটল্যান্ড নিজ সম্পদ থকেই তাদের মোট বাজেটের ৮৮ ভাগ পূরণ করার ক্ষমতা রাখে আর স্বাধীন হওয়ার পর তেল সম্পদের উপর পুরো দখল চলে আসলে তাদের কোনও বাজেট ঘাটতি থাকবেনা।

স্কটল্যান্ড যদি সত্যিই যুক্তরাজ্য ছেড়ে চলে যায় ব্রিটেনের পার্লামেন্ট মারাত্মক সংকটে পড়বে। স্কটল্যান্ড থেকে পাশ করা ৪১ জন লেবার এমপি তাদের সিট হারাবেন আর সেই সাথে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তাদের মোট আসন সংখ্যা কমে দাঁড়াবে ২১৫টিতে আর ১টি মাত্রও আসন হারিয়ে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ ক্যামেরন সরকারের হাথে থাকবে ৩০৪টি আসন যেটা পুরা পার্লামেন্টকে অসম বা স্বৈরাচারী করে তুলতে পারে। দলীয় লাভ হবে জেনেও ক্যামেরন (কোয়ালিশন) সরকার যুক্তরাজ্যের অখণ্ডতায় অটল সেটা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক যে কারনেই হউক না কেন। ঐ দিকে আসন হারানো বা অখণ্ডতা যেই করনেই হোক বিরোধী লেবার পার্টিও কিন্তু স্কটল্যান্ডকে হারাতে চায়না। স্কটল্যান্ডকে হারালে নর্থ সি এর সব সম্পদের দখল হারাবে ব্রিটেন, এক হিসাবে ঐ সাগরে এখনও ২৪ বিলিয়ন ব্যারেল তেল আর গ্যাস রক্ষিত আছে। আর এই তেল আহরনে সর্বমোট ২ লাখ ৪০ হাজারের মত লোক জড়িত আছে, এর মাঝে প্রায় ৪৫ ভাগ লোক স্কটিশ। এখন এই অঞ্চলের দখল চলে গেলে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজারের মত ইংলিশ, আইরিশ আর ওয়েলশ চাকরি হারাবে। বর্তমান বৈরি অর্থনৈতিক অবস্থায় এত লোকের এক সাথে বেকার হয়ে যাওয়া যুক্তরাজ্যকে দেউলিয়া করে দিতে পারে। অর্থনীতির সাথে সাথে রাজনৈতিক ভাবেও ব্রিটেন মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হবে। স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলে তার জনসংখ্যার হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে যুক্তরাজ্যের গ্রহনযোগ্যতা অনেকাংশে কমে যেতে পারে। শেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা ৫ কোটি ২০ লাখের মত প্রকারন্তরে স্কটল্যান্ডে ৫০ লাখ লোক বাস করে যদিও সারা বিশ্বে ৪ কোটি মানুষ স্কটিশ বংশদ্ভোত। ২০১৪ স্কটল্যান্ডের গণভোটে যদি ‘হ্যাঁ’ ভোটের জয় হয় তাইলে অন্য অংশ নর্দান আয়ারল্যান্ড ও ওয়েলস যুক্তরাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘোষনা দিতে পারে যদিও সেটা আমার অনুমান মাত্রও কিন্তু ইংল্যান্ড আর নর্দান আয়ারল্যান্ডের অতীত স্কটল্যান্ডের তুলনায় আরও বেশি রক্তাত্ত।

এদানিংকার একটি জরিপ অনুযায়ী স্কটল্যান্ডের মাত্র ৪০ ভাগ লোক স্বাধীনতার পক্ষে, ১০ ভাগ সিদ্ধান্তহীন আর ৫০ ভাগ এর বিপক্ষে মত দিয়েছে। আর এটি আঁচ করতে পেরেই স্কটিশ ফাস্ট মিনিস্টার গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ এর পাশাপাশি ‘ডেভো মিক্স’ নামে আরও একটি সুযোগ রাখতে চাচ্ছেন যদিও তাতে কেন্দ্রিও কনজারভেটিভ সরকারের আপত্তি রয়েছে। ‘ডেভো মিক্স’ স্কটল্যান্ডকে স্বাধীনতা না হউক অন্তত পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে পারে যার মাধ্যমে স্কটিশরা নিজেদের ভাল মন্দ নিজেরাই দেখভাল করতে পারবে। গণভোটকে সামনে রেখে দুই পক্ষই জনমত তৈরি করতে আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমে পরেছেন। প্রখ্যাত অভিনেতা শন কনোরি সহ অন্যান্য নামি দামিরা স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন অন্য দিকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যামেরনও কয়েকদিন আগে স্কটল্যান্ড সফরে গিয়ে যুক্তরাজ্যের অখণ্ডতার ব্যাপারটি আবারও তুলে ধরেছেন। ১৩১৪ সালের বিনকবার্ন যুদ্ধে রবার্ট ব্রুসের স্কটিশ সেনাবাহিনী ইংরেজ রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ডকে পর্যুদস্ত করেছিল আর সেই ঐতিহাসিক যুদ্ধের ৭০০ বছর আর ব্রিটেনের সাথে যুক্ত হওয়ার ৩০৭ বছর পূর্তি উপলক্ষকে সামনে রেখে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত গণভোটে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পাল্লাটাই ভারি মনে হচ্ছে। অখণ্ডতা রোধ করতে এখন দেখার বিষয় ব্রিটেন সরকার কি পদক্ষেপ নেয়।

সুনামগঞ্জ, জুন ১৫, ২০১২
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০১২ বিকাল ৪:৪২
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বর্গের নন্দনকাননের শ্বেতশুভ্র ফুল কুর্চি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ২২ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৭


কুর্চি
অন্যান্য ও আঞ্চলিক নাম : কুরচি, কুড়চী, কূটজ, কোটী, ইন্দ্রযব, ইন্দ্রজৌ, বৎসক, বৃক্ষক, কলিঙ্গ, প্রাবৃষ্য, শক্রিভুরুহ, শত্রুপাদপ, সংগ্রাহী, পান্ডুরদ্রুম, মহাগন্ধ, মল্লিকাপুষ্প, গিরিমল্লিকা।
Common Name : Bitter Oleander, Easter Tree, Connessi Bark,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচলের (সচলায়তন ব্লগ ) অচল হয়ে যাওয়াটই স্বাভাবিক

লিখেছেন সোনাগাজী, ২২ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬



যেকোন ব্লগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর, একটি ভয়ংকর খারাপ খবর; ইহা দেশের লেখকদের অদক্ষতা, অপ্রয়োজনীয় ও নীচু মানের লেখার সরাসরি প্রমাণ।

সচল নাকি অচল হয়ে গেছে; এতে সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

হরিপ্রভা তাকেদা! প্রায় ভুলে যাওয়া এক অভিযাত্রীর নাম।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২২ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৩


১৯৪৩ সাল, চলছে মানব সভ্যতার ইতিহাসের ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। টোকিও শহর নিস্তব্ধ। যে কোন সময়ে বিমান আক্রমনের সাইরেন, বোমা হামলা। তার মাঝে মাথায় হেলমেট সহ এক বাঙালী... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনারই মেরেছে এমপি আনারকে।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২২ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকারদলীয় এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল তারই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন!

এই হত্যার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আরেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাকা ভাংতি করার মেশিন দরকার

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:১০

চলুন আজকে একটা সমস্যার কথা বলি৷ একটা সময় মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল৷ চাইলেই টাকা ভাংতি পাওয়া যেতো৷ এখন কেউ টাকা ভাংতি দিতে চায়না৷ কারো হাতে অনেক খুচরা টাকা দেখছেন৷ তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×