somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: মিসেস ইরফানির বিস্ময় ও কান্না

০৮ ই জুন, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশে যেতে হবে শুনে মেজাজ খিঁচড়ে গেল মিসেস ফায়েজা ইরফানির। স্বামী মাজিদ ইরফানি করাচির বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ সরকার দু বছর আগে পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের জন্য মালটিপল ভিসা অফার করেছে। তার আগেই অবশ্য মাজিদ ইরফানি বাংলাদেশে সিরামিক্স ইন্ড্রাষ্টিতে জয়েন্ট ভেঞ্চারে বিনিয়োগ করেছেন । মাজিদ ইরফানি কে প্রায়ই বাংলাদেশে যেতে হয়। ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন তিনি। মিসেস ইরফানি কখনও স্বামীর সঙ্গে বাংলাদেশ যাননি। তার কারণ আছে। মন থেকে তিনি আজও বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেননি, ঠিক ঘৃনা না-করলেও- বাংলাদেশকে অবজ্ঞা করেন। মিসেস ইরফানির পরিবারের অনেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন- এখনও আছেন। উনিশ ’শ একাত্তরের যুদ্ধে মিসেস ইরফানির পরিবারের বেশ কয়েকজন মারা গেছেন ... সেই ক্ষোভ, সেই অর্ন্তজ্বালা আজও মনে অসহ্য দহনজ্বালা সৃষ্টি করে ...
স্বামী অবশ্য বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলে নিরবই ছিলেন। কিন্তু এখন বাংলাদেশ যেতে হবে। মাস দুয়েক আগে মাজিদ ইরফানির মাইল্ড স্ট্রোক হয়ে গিয়েছেন। স্বামীর এই ভালনারাবল অবস্থায় মিসেস ইরফানি তাকে একা ছাড়েন কি করে? কাজেই স্বামীর সঙ্গে তাকে ঢাকা যেতেই হল। মিসেস ইরফানির দুটি ছেলেমেয়ে। ফারহান ও আমিনাহ; স্কুল-কলেজে পড়ছে । ওরা অবশ্য করাচিতেই থাকবে। বাড়িতে মিসেস ইরফানির বিধবা ননাস আছে। সেই ওদের দেখাশোনা করবে। তাছাড়া প্রাইভেট সিকুরিটির লোক আছে।

ঢাকায় মাজিদ ইরফানির ফ্ল্যাটটি বনানীর ওল্ড ডিওএইচএস- এ। এয়ারপোর্ট থেকে আসার পথে মিসেস ইরফানি কে বেশ বিস্মিতই মনে হল। রাস্তায় জ্যাম থাকলেও রাস্তার দু-ধারের দালানকোঠা এবং যানবাহন একেবারে মলিন হতশ্রী না। বাংলাদেশ তাহলে বেশ উন্নতি করেছে বলতে হয়। উন্নতি বলতে লোকজন প্রথম রাস্তাঘাট আর বহুতল ভবনই বোঝে। তাছাড়া মিসেস ইরফানি শুনেছেন বাংলাদেশ নাকি উন্নয়নশীল বিশ্বের মডেল। তাই কি? গ্রামীন নারীদের উন্নয়নের জন্য ড. ইউনূস নোবেল পেলেন। আর পাকিস্তান? পাকিস্তান দেশটা ধ্বংস হতে বসেছে তালেবান গোষ্ঠীর চক্রান্ত। তালেবান গোষ্ঠী মাস দুয়েক আগে মিসেস ইরফানির স্বামীর কাছে দশ কোটি রুপি চাঁদ চেয়েছে। তারপরই তো মাইল্ড স্টোক হয়ে গেল ... দশ কোটির জায়গায় পাঁচকোটি রুপি দিয়ে কোনওমনে ম্যানেজ করেছেন ওদের, নইলে ওদের গানম্যানরা অ্যাটাক করত। ঢাকা শহরে সশস্ত্র বাহিনীর প্রহরা নেই। করাচির অবস্থা তেমন নয়। করাচির শপিংমল, সিনেমাহলের সামনে সশস্ত্র প্রহরা ...

সাড়ে তিন হাজার স্কোয়ার ফুটের বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট। অ্যাটাচড বাথরুম এবং ড্রেসসহ চারটি বেডরুম। লিভিং রুমটা বেশ বড়। বিশাল বারান্দা। কিচেন উইথ প্যানট্রি।
নট ব্যাড। করাচির ফাতেমা জিন্নাহ রোডের মিসেস ইরফানির ফ্ল্যাটটিও এ রকমই।
সব দেখেশুনে মিসেস ইরফানি কে সন্তুষ্টু মনে হল। কিন্তু খাবার-দাবারের কথা ভেবে মন খারাপ করলেন।মিসেস ইরফানি স্বামীকে প্রায়ই অভিযোগের সুরে বলেন, বেঙ্গলিদের দেশে কি খাও না খাও। আমি করাচিতে বসে তোমার জন্য ভেবে মরি।
মাজিদ ইরফানি হেসে বলেন, আরে কি যে বল। ঢাকায় আমার যে বাবুর্চি আছে সে ভালো রাঁধে।
বাবুর্চি বেঙ্গলি?
হ্যাঁ।
ভালো না ছাই। বেঙ্গলিরা আবার রাঁধতে জানে নাকি। মুখ বেঁকিয়ে বলেন মিসেস ইরফানি ।
তা মাজিদ ইরফানি বেশ আমুদে মানুষ আছেন বটে। তিনি স্ত্রীকে আজ ভেলকি দেখাবেন ঠিক করলেন। বললেন, দাঁড়াও, তোমাকে আজই আমার বাবুর্চির কেরামতি দেখাচ্ছি। বলে, শওকত কে বাজারে পাঠালেন। ২৮/২৯ বছর বয়েসি ফরসা চেহারার শওকত ছেলেটি মাজিদ ইরফানির সহকারি।
এন্তার বাজার-সদাই করে ফিরল শওকত।
মাজিদ ইরফানি বাবুর্চিকে বুঝিয়ে বললেন রাতে কি কি রাঁধতে হবে।
তো বাঙালি বাবুর্চির নাম ইদ্রিস মিঞা। তার বয়স এই ধরুন গিয়ে চল্লিশ-পয়তাল্লিশ। শুঁটকো মতন কালো কুচকুচে চেহারা। মাথায় চুল পাতলা। মাথায় সাদা কাপড়ের টুপি। কপাল বেশ চওড়া। ইদ্রিস মিঞার জন্ম পুরনো ঢাকার বাবু বাজার। ঘটনাচক্রে চৌদ্দ বছর বয়েসে ঢাকার বিখ্যাত বাবুর্চি ফকরুদ্দীন- এর শিষ্যত্ম লাভ করে। ইদ্রিস মিঞার জন্মগত প্রতিভা তো ছিলই, তার ওপর খাঁটি ওস্তাদের হাতে পড়ে তুখোড় রন্ধনশিল্পী হয়ে উঠেছে।
তো এসব ব্যাপারে মিসেস ইরফানি উৎসাহী নন। তিনি পণ করলে তিনি ইদ্রিস মিঞার রান্না খেয়ে বাজে বলবেন!
ইদ্রিস মিঞার যত সুখ্যাতি তা সুতি কাবাব- এর জন্য। মাজিদ ইরফানি ইদ্রিস মিঞার জবরদস্ত ওই সুতি কাবাব খেয়ে কুপোকাৎ হয়েছেন। ইদ্রিস মিঞা কে ইঙ্গিতে আজ মাজিদ ইরফানি তাই রাঁধতে বললেন।
ইদ্রিস মিঞা খেটেখুটে তাই রাঁধল। একশ বছর আগে ঢাকায় এই সুতি কাবাবকে বলা হত পারসন্দের। তো এত কথা মিসেস ইরফানির জানার কথা নয়। তিনি এও জানেন কিনা সন্দেহ ঢাকায় এককালে মুগলদের শাসন ছিল।
সে যা হোক।
রাত আটটা বেজে গিয়েছে। মিসেস ইরফানি এসে খেতে বসলেন। ইদ্রিস নানরুটির সঙ্গে পরিবেশন করল পারসন্দের ...মানে সুতি কাবাব, শামি কাবাব, হান্ডি কাবাব, ইরানি, মুঠিয়া, গুর্দার কাবাব আর ক্ষিরি কাবাব । আর টকঝাল বোরহানী, ঠান্ডা লাচ্ছি, শীতল ফালুদা আর সুস্বাদু ঢাকাই ফিন্নি
মাজিদ ইরফানি মুখ করুণ করে বসে আছেন। স্ট্রোকের পর রিচ ফুড বন্ধ। কাটাঁ চামচ দিয়ে শশা আর টমাটো খাচ্ছেন। টেবিলে যা আছে কিছুই মুখে দিতে পারবেন না।
খাবার মুখে দিয়ে মিসেস ইরফানি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। এ রকম মজাদার রান্নার বদনাম করলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না। খেতে খেতে তিনি কীসব যেন ভাবতে লাগলেন। করাচিতে তিনি প্রায়ই পার্টি দেন। হাই সোসাইটির নারীপুরুষ আসে পার্টিতে। তিনি জানেন করাচির বনেদিরা ইদ্রিস মিঞার হান্ডি কাবাব, ফালুদা আর ঢাকাই ফিন্নি খেলে কুপোকাৎ হয়ে যাবেই । তাতে মিসেস ইরফানির ইজ্জৎ বাড়বে। মিসেস ইরফানি অত্যন্ত ইমেজ সচেতন। হাই সোসাইটির মহিলারা ইজ্জৎ বাড়াতে কত কিছুই না করে। শীতের দেশের দামি কুকুর কিনে এনে গরমের দেশে কষ্ট দেয়।
মিসেস ইরফানি নরম সুরে বললেন, ইদ্রিস মিঞা তোমার রান্না চমৎকার।
ইদ্রিস মিঞা কিছু না বলে দুহাত কচলাতে লাগল। কাঁধে গামছা।
ইদ্রিস মিঞার রান্না স্ত্রীর পছন্দ হয়েছে দেখে মাজিদ ইরফানির মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখা গেল।
মিসেস ইরফানি আরও নরম সুরে বললেন, তুমি কি করাচিতে আমার বাড়িতে চাকরি করবে?
ইদ্রিস মিঞার জন্ম পুরনো ঢাকয় হওয়ায় সে চোস্ত উর্দু বোঝে । সে মাথা দুলিয়ে বলল, না বিবিসাব। গোস্তাকি মাপ করবেন। আমি করাচি যেতে পারব না।
কেন শুনি? মিসেস ইরফানি অবাক।
ইদ্রিস মিঞা চুপ করে রইল।
পরিবার এখানে তাই? মিসেস ইরফানি জিজ্ঞেস করলেন।
ইদ্রিস মিঞা চুপ করে রইল।
আচ্ছা, আমি তিন মাস পরপর দু-সপ্তাহের জন্য ছুটি দেব। আসা-যাওয়ার খরচও আমার । বলে স্বামীর দিকে তাকালেন মিসেস ইরফানি । স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, ইদ্রিস মিঞার বেতন কত দাও?
পনেরো হাজার দিই।
নট ব্যাড।
সম্প্রতি মিসেস ইরফানি পৈত্রিক পেয়েছেন । দু কোটি রুপি করাচির একটা ব্যাঙ্কে আছে। তিন মাস পরপর মোটা অঙ্কের মুনাফা পান। তা দিয়ে নানান শখ মেটান।
মিসেস ইরফানি বললেন, ইদ্রিস মিঞা, তুমি আমার সঙ্গে পকিস্তান চল। আমি তোমার বেতন পাঁচ হাজার বাড়িয়ে কুড়ি হাজার করে দেব ।রুপিতে দেব। তার মানে আরও বেশি পাবে।
ইদ্রিস মিঞা চুপ করে থাকে।
পঁচিশ।
ইদ্রিস মিঞা চুপ করে থাকে।
তিরিশ।
ইদ্রিস মিঞা চুপ করে রইল।
ইদ্রিস মিঞা কিছুতেই করাচি যেতে রাজি হল না। মিসেস ইরফানি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। করাচি দিন দিন বিপদজনক শহর হয়ে উঠছে। গত চার বছরে করাচিতে অন্তত ৬০০০ মানুষ মারা গেছে । সে কথা কি ইদ্রিস মিঞা জানে? মনে হয় জানে। এখন সবখানেই টিভি আছে । এক সময় দুটি দেশ একসঙ্গে ছিল, পাকিস্তান সর্ম্পকে বেঙ্গলিদের কিউরিসিটি থাকবেই। সত্যি করাচির অবস্থা ভালো না। অজ্ঞাত পরিচয়ধারী গানম্যানদের হাত থেকে বাঁচতে ব্যাঙের ছাতার মতন প্রাইভেট সিকুরিটি কোম্পানি গড়ে উঠেছে। হোটেল-রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেও গানম্যান থাকে।তবে পাকিস্তানের সবই খারাপ না। পাকিস্তানে স্ট্রং মিডিয়া এবং জুডিশিয়ারি আছে...
মিসেস ইরফানি ডাইনিং টেবিল থেকে বেডরুমে এলেন। বেঙ্গলির রান্না খেয়ে বিস্মিত হয়েছেন। ইদ্রিস মিঞা পাকিস্তান যেতে রাজি হল না। এটাও কম বিস্ময়ের না।তিনি বিষন্ন বোধ করেন।মিসেস ইরফানি শাওয়ারে যাবেন। শাওয়ার নিলে তার বিষন্নতা কমে।
বাথরুমে ঢোকার ঠিক আগে ফোন বাজল।
আমিনাহ। ছোট মেয়ে। কিছুক্ষণ কথা হল। শেষে আমিনাহ বলল, শোন আম্মি, ঢাকা থেকে আসার সময় জেমস- এর একটা পোস্টার এনো।
জেমস? হু ইজ হি? মিসেস ইরফানির ভুরু কুঁচকে ওঠে।
উহ। তুমি কিছু চিন না। জেমস ইজ আ বাংলাদেশি সিঙ্গার।
ওহ। মিসেস ইরফানি আবারও বিস্মিত হলেন। আমিনাহ বাংলাদেশি সিঙ্গরের নাম জানে। স্ট্রেঞ্জ। পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশকে নতুন চোখে দেখছে। বাংলাদেশি সিঙ্গার কে চেনে ...অথচ এদেরই পূর্বপুরুষ ...
মিসেস ইরফানির এই ছোট মেয়েটির গানবাজনার ঝোঁক। চমৎকার পিয়ানো বাজায়। বড় ছেলে ফারহান গিটার বাজায়। তবে ফারহানের পড়াশোনায় ঝোঁক। বিশেষ করে গণিতে ভীষন মেধাবী ।বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সালমান খান তার আইডল। সে সালমান খানের মতন এমআইটিতে পড়তে চায়। ইউটিউবে সালমান খান- এর টিউটেরিয়াল দেখে ।
মিসেস ইরফানি মেয়েকে বললেন, দে, ফোনটা ফারহানকে দে।
ছেলে ফোন ধরলে ছেলেকে কিছুক্ষণ উপদেশ দিলেন মিসেস ইরফানি ।
ফোন রাখার আগে ফারহান বলল, আম্মি, আসার সময় সালমান খান -এর ঢাকায় বাড়ির একটা ছবি এনো।
কে? কার ছবি আনব?
সালমান খান। আ ফ্রি অন লাইন এডুকেটর। ওর অ্যানস্যাসটররা বাংলাদেশি।
ওহ্ । ছেলেমেয়ের মুখে বারবার বাংলাদেশ বাংলাদেশ শুনে বিষন্ন বোধ করছেন মিসেস ইরফানি। আজ শাওয়ার নিয়ে কাজ হবে না।

মিসেস ইরফানি জানার কথা নয় ১৯৬৭ সালে লুজিয়ানার নিউ অর্লিয়েন্সে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সালমান খান আর্ন্তজালিক শিক্ষাজগতে কি তুমুল আলোরণ ফেলে দিয়েছে। স্বয়ং বিল গেটস সালমান খান এর ভক্ত। তবে ফারহানও একটা ভুল করেছে। সে ভেবেছে ঢাকায় সালমান খান-এর বাড়ি আছে। আসলে সালমান খান এর বাবা ঢাকার নন, বরিশালের ...


পরদিন সকালে শতকত এল।
মিসেস ইরফানি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা জেমস কে বলত? মিউজিক করে।
ওহ জেমস ম্যাডাম। জেমস বাংলাদেশের ফেমাস ব্যান্ড মিউজিশয়ান ম্যাডাম।
তার পোস্টার কি পাওয়া যাবে?
হ্যাঁ। যাবে। নিউ মার্কেটে।
তাহলে আমাকে এনে দিও তো।
ঠিক আছে ম্যাডাম। দেব।
আর সালমান খানের ... মিসেস ইরফানির কথা শেষ হল না। শওকত বলল, সালমান খান না ম্যাডাম। সালমান শাহ । আচ্ছা ওনার পোস্টারও এনে দেব।
কথাটা শুনে মিসেস ইরফানি কে কেমন হতভম্ব দেখাল।

সবচে বড় চমক এল মাজিদ ইরফানির পার্টনারে বাড়িতে।
পার্টনারের নাম সৈয়দ দিদারুল আহসান। মাঝবয়েসি ডাঁকসাইটে ব্যবসায়ী। অলিভা গ্রুপ অভ কোম্পানির চেয়ারম্যান। তার সঙ্গেই বাংলাদেশে সিরামিক্স ইন্ড্রাষ্টিতে জয়েন্ট ভেঞ্চারে বিনিয়োগ করেছেন মাজিদ ইরফানি। সিরামিক্স কারখানাটি গাজীপুরে কোনাবাড়ি।
বারিধারায় এসকর্ট হোটেলের পাশে সৈয়দ দিদারুল আহসান- এর আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির সামনে লন, নীলজলের সুইমিংপুর। গ্যারেজে একটি কালো রঙের মার্সিডিস সি ক্লাস, দুটি বি এম ডাবলিউ এক্স সিক্স এবং একটি পোরশে নাইন নাইন সিক্স।
গেট দিয়ে ঢুকতেই একটি কুচকুচে কালো ডোবারম্যান পিনসার ঘেউ ঘেউ করে স্বাগত জানাল। অবশ্য চেইন ধরে রেখেছিল দারোয়ান সিদ্দিক। মিসেস ইরফানি বিরক্ত হলেন। তিনি কুকুর-টুকুর বরদাস্ত করেন না।
সৈয়দ দিদারুল আহসান- এর স্ত্রী ওয়াহিদা অতিথিদের অর্ভ্যথনা জানালেন। মাঝবয়েসি ফরসা হাসিখুশি মহিলা। অবশ্য উর্দু জানে না, তবে কাজ চালিয়ে নেয়ার মতন ইংরেজি জানেন। বারবার বললেন, বাচ্চাদের নিয়ে এলেন না। বাচ্চাদের নিয়ে এলেন না।
মিসেস ইরফানি হাসলেন। সবুজ রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছেন। ফরসা কপালে এসে পড়েছে লালচে চুল। সবুজ রঙের ওড়না ঘোমটার মতন পরেছেন।
ওয়াহিদা দম্পত্তির দুই ছেলে এক মেয়ে। ফাহিম, রূপম আর রুমানা। বড় মেয়ে রুমানা পড়ছে লন্ডনে; এখন অবশ্য ঢাকায়। রুমানার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। খুব চটপটে তরুনি। মিসেস ইরফানি মুগ্ধ হলেন।
ফাহিম আর রূপম সেই তুলনায় লাজুক। ওদের একজন ওলেভেল, অন্যজন এলেভেলে পড়ে। মেহমানদের মুখ দেখিয়ে তিনতলায় চলে গেল টেবিল টেনিস খেলতে।
ডিনারে ওয়াহিদা এন্তার আয়োজন করেছেন। সাদা পোলাও, মোরগ পোলাও, কাশ্মীরি বিরিয়ানি, গরুর মাংসের চাপ, চিকেন ফ্রাই, পনির চিকেন কাবাব, ডাক রোস্ট, পিজিয়ন রোস্ট উইথ হানি, গরুর মাংসের দোপেঁয়াজা, গরুর মাংসের কোরমা, খাসির মাংসের দই রেজালা, চিকেন ক্যাশোনাট সালাদ, মটর পনির, বোরহানী, লাচ্ছি, ফালুদা, দই, চমচম আর কাউনের গুড়ের পায়েস।
মিসেস ইরফানি মুগ্ধ এবং তৃপ্ত। ওয়াহিদা কে জিজ্ঞেস করলেন, শেফ কি ইন্ডিয়ান বহিন?
রুমানা বলল, না, না আন্টি। আমাদের বাবুর্চি সোলায়মানের বাড়ি বরিশাল। অবশ্য বহুদিন ধরে ঢাকা থাকে ।
ওহ। আর আপনারা এটাকে কি বলেন?
রুমানা বলল, ও এটা? আন্টি এটা হল কাউনের গুড়ের পায়েস।
আমাকে রেসিপি দিও তো ।
রুমানা বলল, আচ্ছা। মাজেদা কে জিজ্ঞেস করে দেব।
মাজেদা কে?
আমাদের মেইড। এটা ও রেঁধেছে । ও কুমিল্লার মেয়ে ...
ওহ্।

সৈয়দ দিদারুল আহসান তার পার্টনারের স্ত্রীর সম্মানে গজল সন্ধ্যার আয়োজন করেছেন।তিনি এমনিতেও গানবাজনা পছন্দ করেন। সময় পেলেই বাড়িতে মজলিস বসিয়ে দেন।
তো, আজকের শিল্পীর নাম সেলিম দেওয়ান ওরফে সজল। তিরিশ বছর বয়েসি উদাসী গম্ভীর গায়কের গায়ের রংটি শ্যামলা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। পরনে ঘিয়ে রঙের রেশমি পাঞ্জাবি। সেলিম দেওয়ান- এর জন্ম পুরনো ঢাকায়। চমৎকার গজল আর কাওয়ালি গায়। নজরুলগীতিটাও ভালো গায়। ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর শিষ্য সেলিম দেওয়ান; ওস্তাদজীর আজীমপুরের বাড়ি গিয়ে একটানা বারো বছর তালিম নিয়েছে ।
সেলিম দেওয়ান সঙ্গে আজ তবলা সঙ্গত করবে সাব্বির খান। তুখোর হাত তার। সন্তুরে সালাউদ্দীন সান্তুনু। হারমোনিয়ামে শিল্পী নিজেই বাজাবেন ।
সেলিম দেওয়ান মেহদি হাসানের ‘রাফতা রাফতা ওহ মেরি’ গানটা দিয়ে শুরু করলেন।
মিসেস ইরফানি মুগ্ধ হয়ে শুনলেন।
এরপর সেলিম দেওয়ান গাইলেন জাগজিৎ সিং -এর ‘হোস ওয়ালন কো খাবার কায়া।’
মিসেস ইরফানি মুগ্ধ হয়ে শুনলেন। ওয়াহিদাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, ওনাকে কি আপনারা ইন্ডিয়া থেকে এনেছেন বহিন?
ওয়াহিদা বললেন, না না। সেলিম দেওয়ান ঢাকার ছেলে।
ওহ্। ঢাকার ছেলে।
সংগীতশিল্পীরা সাধারণত চতুর এবং রসিক হয়ে থাকে। সেলিম দেওয়ানও তার ব্যতিক্রম নয়। গান গাইবার সময় সেলিম দেওয়ান-এর চোখ দুটি আধবোজা থাকলেও তিনি শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া ঠিকই খেয়াল করেন। তিনি ঠিকই বুঝেছেন পাকিস্তানি ভদ্রলোকটি গানবাজনার ঠিক সমঝদার নন এবং কিছুটা মরমরা। তবে পাকিস্তানি মহিলাটি গানবাজনা ভালোবাসেন। সেলিম দেওয়ান অন্যান্য সংগীতশিল্পীর মতোই শ্রোতার মন বুঝে গান সিলেক্ট করেন। কাজেই অত্যন্ত দরদ দিয়ে একটা পাকিস্তানি ক্লাসিক গান ধরলেন সেলিম দেওয়ান,

তু জাহান খাহিন ভি যায়ে/ মেরা পেয়ার ইয়াদ রাখনা ...

গান শেষ হল।
ড্রইংরুমের সবাই দেখল-মিসেস ইরফানি কাঁদছেন ...
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুন, ২০১২ রাত ১০:৫৬
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আল্লাহর সাহায্য

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৫ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৪০



দুই মেয়ের পরীক্ষা বিধায় আমার স্ত্রীকে লক্ষ্মীপুর রেখে আসতে গিয়েছিলাম। বরিশাল-মজুচৌধুরীর হাট রুটে আমার স্ত্রী যাবে না বলে বেঁকে বসলো। বাধ্য হয়ে চাঁদপুর রুটে যাত্রা ঠিক করলাম। রাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডয়েজ ভেলে'র প্রকাশিত এই প্রামাণ্যচিত্রটি বেশ উদ্বেগজনক

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৫ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন বাহিনী থেকে প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকান্ডে যুক্ত সৈনিকদের ইউ.এন. এর পিস কিপিং মিশনে পাঠানোর বিষয়ে ইউ.এন. এর কর্মকর্তাগণ বেশ উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে ডয়েচ ভেলে ক'দিন আগেই একটি প্রামাণ্যচিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

নজরুলের চিন্তার কাবা প্রাচ্য নাকি পাশ্চাত্য?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে মে, ২০২৪ ভোর ৫:০৫


কাজী নজরুলের বড় বিপত্তি তিনি, না গোঁড়া ধর্মীয় লোকের কবি আর অতিমাত্রায় বামের কবি, না হোদাই প্রগতিশীলের কবি। তিনি সরাসরি মধ্যপন্থীর। অনেককেই দেখি নজরুলের কিছু কথা উল্লেখ করে বলেন কাফের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘূর্ণিঝড় রিমাল সর্তকতা।

লিখেছেন কাল্পনিক_ভালোবাসা, ২৬ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩

প্রিয় ব্লগারবৃন্দ,
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় রিমাল প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে এবং ইতিমধ্যে বাংলাদেশের উপকূলের দিকে এগিয়ে আসছে। সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোর ব্লগারদের কাছে যদি স্থানীয় ঝড়ের অবস্থা এবং ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে চিরতরে যুদ্ধ বন্ধের একটা সুযোগ এসেছিল!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৬ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৩


মনে হয় শুধু মানুষের কল্পনাতেই এমন প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন সম্ভব- যদি বাস্তবে হত তবে কেমন হত ভাবুন তো?
প্রত্যেকটি দেশের সমস্ত রকমের সৈন্যদল ভেঙে দেওয়া; সমস্ত অস্ত্র এবং সমর-সম্ভার, দুর্গ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×