somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সক্রেটিস - পর্ব ২

০২ রা জুন, ২০১২ রাত ১০:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সক্রেটিস - পর্ব ১

শায়মা আপিকে কথা দিয়েছিলাম, আমি সক্রেটিস নিয়ে লিখবো। সেই কথা রাখতেই এই লেখা শুরু করা। এর আগে আমরা সক্রেটিস এর জম্ম পরিচয় পেয়েছি, এবার সক্রেটিসকে চেনার চেষ্টা করবো।

আমরা যে সক্রেটিস কে দেখতে পাই, তিনি কখনো ঘরে থাকেন না, গৃহকর্মে তাঁর সময় কাটে না, কোনোরকম বৈষয়িক উচ্চাকাঙ্ক্ষার নিমিষের জন্যে তাঁর মনো্যোগ অধিকার করে না। তাকে আমরা সব সময় ঘরের বাইরে দেখতে পাচ্ছি; দেখতে পাচ্ছি এথেন্সের পথে-ঘাটে, বাজারে, সাধারণ মানুষের মধ্যেম সামাজিক অনুষ্টান উৎসবে।

বিমূর্ত দর্শনচিন্তা বলতে যা বোঝায়, সক্রেটিস তা কখনো করার চেষ্টা করেন নি। তাঁর জীবনের সবটাই কাজ। তাঁর চিন্তাও এই দিক থেকে তাঁর কাজ। সক্রেটিসের একটা বড়ো শিক্ষাই হলো জ্ঞান ও কর্ম এক অর্থাৎ জ্ঞান যদি কর্মে রূপান্তরিত না হয় তাহলে তাকে জ্ঞান বলাই যাবে না এবং যদি কর্ম জ্ঞান ব্যতিরেকে হতে থাকে, তাহলে তা অকর্ম বা দুষ্কর্ম।

দার্শনিক বলতে যে আকাশচারী, স্বপ্নভুক, এলোমেলো, অপ্রস্তুত, বিপর্যস্ত, আধপাগলা মানুষের ধারণার চল আছে, অন্তত সক্রেটিস তার মূর্তিমান প্রতিবাদ। তবু এই অবাস্তব কল্পনাচারী দার্শনিকের ধারণা সক্রেটিসও হয়তো দিয়েছেন। তাঁর পোষাক ছিলো নোংরা এলোমেলো, চলাফেরা ছিলো হাস্যকর, আবার আচরণও হয়তো অন্যদের কাছে স্বাভাবিক মনে হতো না।

যেমন প্লেটোর সিম্পোজিয়ামে আরিস্টোডেমাস এর বর্ণনা অনুযায়ী সক্রেটিস যে বেশ রসিক ছিলেন তার একটা নমুনা দেয়া যাক।
তার বর্ণনাটা এমন;
আমি সক্রেটিসকে দেখলাম, এইমাত্র স্নান সেরে বের হলেন, আর পায়ে জুতা! এ-দুটোই তাঁর পক্ষে অসাধারণ ঘটনা। তাই আমি জিজ্ঞাস করলাম, 'আরে! যাচ্ছ কোথায়? বড় যে সাজগোজ!' তিনি বললেন, আগাথনের ওখানে যাচ্ছি, ভোজে। বেশি লোকের ভিড় আমার ভালো লাগে না; তাই কালকে ভোজসভায় যাই নি, আজ যাবো বলে কথা দিয়েছি। আর সাজগোজের কথা বলছ, অমন সুপুরুষের সাথে দেখা করতে গেলে নিজের চেহারাটাও সম্ভবমতো দুরস্ত করে নিয়েই যাওয়া উচিত।'

যদিও আরিস্টোডেমাস দাওয়াত পায় নি, সক্রেটিস তাকে নিয়েই রওনা দেন। এবং পথে নিজ চিন্তায় পিছিয়ে পরেন। আরিস্টোডেমাস অপেক্ষা করছে দেখে সক্রেটিস তাকে দেরি না করে এগিয়ে যেতে বলেন। পরে সক্রেটিস কে পাশের বাড়ির ঢোকবার দরদালানের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এমনও দেখা গেছে কখনো কখনো কোনো একটা বিষয়ে মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত একাকী কোনো স্থানে নিশ্চলভাবে- কি রাত কি দিন- তিঁনি দাঁড়িয়ে থেকেছেন। সূর্যের প্রখরতা, বরফের ঠান্ডা হীম শীতলতা কিছুই তাঁর চিন্তার বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি।

সক্রেটিস এর সহনশীলতার দিতে গিয়ে তাঁর শিষ্য আলকিবিয়াডিস একটি সামরিক অভিজানে সক্রেটিসের বর্ণনা দিচ্ছেন এভাবেঃ তাঁর সহনশক্তি এককথায় ছিলো বিস্ময়কর। সরবরাহ থেকে বিযুক্ত হয়ে যখন আমাদের উপোস করতে বাধ্য হতে হচ্ছিলো- যুদ্ধকালে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে- তখন সক্রেটিস শুধু আমাকে কেন, যে কাউকে সহিষ্ণুতার পরীক্ষায় অতিক্রম করে যেতেন। বস্তুত এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে কারো তুলনা চলে না।ঠান্ডা সইবার ক্ষমতা তাঁর ছিলো অসাধারণ। একবার প্রচন্ড বরফপাত হলো। এ অঞ্চল্টায় আসলেই শীত বড় মারাত্মক, প্রত্যেকে হয় গৃহবন্দী থাকতেন, না হয় বিপুল পরিমাণ কাপড়চোপড় পরে বাইরে বেরুতেন এবং অবশ্যই প্রত্যেকের পায়ে মজবুত জুতো, বেল্ট বা পশম দিয়ে পা-জোড়া পুরোপুরি ঢাকা। এইরকম অবস্থায় বরফের উপর সৈনিকদের চেয়ে ভালো কুচকাওয়াজ করতেন। এইজন্যে অন্যেরা তাঁকে বিষদৃষ্টিতে দেখতো, কারণ মনে হতো সক্রেটিস তাদের অবজ্ঞা দেখাচ্ছেন।

আর একটা ব্যাপার তাঁর বাল্যকাল থেকেই লোকের জানা ছিলো। তিনি নাকি একটি 'কন্ঠস্বর' শুনতে পেতেন। সক্রেটিস বলতেন এটা তাঁর কাছে 'দৈব সংকেত'। তিনি সত্যিকার কন্ঠ শুনতে পেতেন, না কোনো একটা সংকেত পেতেন সেটা তেমন পরিস্কার নয়। তবে সক্রেটিস এটাকে অনন্য ব্যাপার বলে মনে করতেন, ভাবতেন এই দৈব সংকেত একমাত্র তিনিই পান। সংকেত তিনি যখন তখন পেতেন। মজার কথা হচ্ছে এই 'কন্ঠস্বর' বা 'সংকেত' তাঁকে কোনো কিছু করার জন্যে প্ররোচিত করতো না, বরং কোনো কোনো কাজ করা থেকে তাঁকে বিরত রাখতো। তার মানে, এই 'কন্ঠস্বর' বা সংকেত নিষেধসূচক।

এই 'কন্ঠস্বর' শুনতে পেতেন কেবল সক্রেটিস নিজে। কিন্তু যখন তাঁর বয়স পয়ত্রিশ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা হচ্ছে ডেলফির এ্যাপোলো-মন্দিরের দৈববাণী। সক্রেটিসের এক শিষ্য চেয়ারেফন উৎসাহের আধিক্যে ডেলফির এ্যাপোলো-মন্দিরে জিজ্ঞাস করে বসলেন, সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞানী কেউ আছেন কিনা। পার্নাসাস পাহাড়ের সানুদেশে প্রাচীন ডেলফি শহরের এই এ্যাপোলোর প্রত্যাদেশ স্থানটি তখন খুবই বিখ্যাত। যাই হোক, চেয়ারেফনের প্রশ্নের জবাবে দেবী পাইথিয়া জানিয়ে দিলেন সক্রেটিসের চেয়ে জ্ঞানী আর কেউ নেই। এই ঘটনা তাঁর জীবনকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দেয়। এর পরে তিনি তাঁর জীবনের প্রধান কর্ম কি হবে তা স্থির করে নেন এবং বাদি জীবন সেই কর্মেই উৎসর্গ করেন। ডেলফির দৈববাণীর মধ্য দিয়েই কিন্তু সক্রেটিসের 'ডায়ালেকটিক পদ্ধতি'র সূত্রপাত ঘটে।

এইবার বলি 'ডায়ালেকটিক পদ্ধতি'টি কি? সক্রেটিস তাঁর বিখ্যাত 'ডায়ালেকটিক পদ্ধতি' ইলীয় দার্শনিক জেনোর (Xeno) কাছ থেকে পান। এ্যারিস্টটল জেনোকে 'ডায়ালেকটিক পদ্ধতি'র প্রকৃত আবিস্কর্তা বলেছেন। 'ডায়ালেকটিক পদ্ধতি' হচ্ছে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আলোচনা। 'ডায়ালেকটিক' শব্দের অক্ষরিক অর্থ কথোপকথন-কলা। এই পদ্ধতি বিশেষ নিয়মকানুন দিয়ে বাঁধা ছিলো। প্রশ্নের জবাব দিতে হতো স্বল্পতম কথায়, যা প্রশ্ন করা হতো একমাত্র তারই জবাব দিতে হতো-বাড়তি কথা বলা যেত না। তত্ত্ব আলোচনার এই পদ্ধতিটি সক্রেটিসের খুবই পছন্দ হয়। পরবর্তীকালে এই 'ডায়ালেকটিক পদ্ধতি' 'সক্রেটীয় পদ্ধতি' নামে বিখ্যাত হয়েছে। সক্রেটিস এর হাতে এই পদ্ধতি মারাত্মক হাতিয়ার হিসেবে দেখা দেয়।

যে কোনো একটি বিষয় বেছে নিয়ে সক্রেটিস সরাসরি স্বীকার করতেন যে ঐ বিষয়ে তিনি কিছুমাত্র জ্ঞান রাখেন না। যার বা যাদের সঙ্গে তিনি আলোচনায় বসতেন, তাদের কাছে নিজের অজ্ঞানতা দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করার পরেই শুরু হতো কথোপকথন বা প্রশ্নোত্তরের তলোয়ার খেলা। অজ্ঞানতা থেকে সক্রেটিস প্রশ্ন করতেন, জবাব পেলে খুশি হতেন এবং তার পরই, যে উত্তরটা পেতেন সেটা সম্পর্কে সামান্য দ্বিধা প্রকাশ করতেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রকাশ হয়ে পড়তো যে উত্তরকারী বা উত্তরকারীরা নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানের যে দাবি করছেন, সে দাবি নিতান্তই অসার। সক্রেটিসের মতোই উত্তরকারীরাও অজ্ঞানতার অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছেন।

আচ্ছা আজ এই পর্যন্তই থাক। সামনে সপ্তাহে আবার কিছু লিখবো। চলতে থাকবে.।.।
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×