somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সত্যজিত রায়ের ডকুমেন্টারী SIKKIM

৩১ শে মে, ২০১২ বিকাল ৫:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আপনারা সবাই জানেন যে কিছুদিন আগে সত্যজিত রায়ের ” “সিকিম" নামের একটি তথ্যচিত্র মুক্তি পেয়েছে । সত্যজিত রায় এই ডকুমেন্টারীটি ১৯৭১ সালে বানালেও নানা কারণে প্রায় ৪০ বছর আটকে থাকে । স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় “সিকিম” নামের এই ডকুমেন্টারীটির নির্মাণকাজ শুরু ও শেষ করা হয় । “সিকিম” শেষ করার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে একটি ডকুমেন্টারী তৈরি করতে চেয়েছিলেন সত্যজিত । কিন্তু যত্ন নিয়ে বানানো “সিকিম” ভারত সরকার নিষিদ্ধ করে দিলে সত্যজিত রায় বেদনাহত পরবর্তী পরিকল্পনা স্থগিত করেন । রাজস্থানের ধ্রুপদী সংগীতশিল্পী এবং ইলোরার নৃত্যশিল্পীদের নিয়েও তথ্যচিত্র করার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। সেগুলোও হয়ে ওঠেনি।

১৯৭৫ সাল পর্যন্ত হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত সিকিম একটি স্বতন্ত্র একটি দেশ ছিল । রাজতন্ত্র অধ্যুষিত এ দেশ চীন ও ভারত কর্তৃক আক্রমণ ও দখলের ঝুঁকিতে ছিল সে সময়। রাজতন্ত্রের সর্বশেষ শাসক পালডেন থনডাপ নামগিয়াল দুটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় এ চলচ্চিত্রটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। উলিস্নখিত দেশ দুটির আক্রমণের আশঙ্কা হ্রাস করার নিমিত্তে তিনি সিকিমকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার অভিপ্রায়ে এই মাধ্যমকে উপযুক্ত বলে মনে করেন। আর পাঠকদের আকর্ষণ করার জন্য গ্যাংটকসহ সমগ্র সিকিমের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যশোভা উপস্থাপনের জন্যও রাজা ছবি বানানোর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছিলেন। নতুন করে মুক্তি পাবার আগে, কোনো দর্শক, কোনো চিত্রসমালোচক দেখতে পাননি। কেবল সিকিমের রাজ পরিবারের সদস্যরা উপভোগ করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। তবে নির্মাতা সত্যজিৎ রায় ছবিটির শুরু ও শেষ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছিলেন। সূচনার সাত মিনিট এবং সমাপনী দৃশ্যের ব্যাপারে তিনি বেশ সন্তুষ্ট হতে পেরেছিলেন এবং এ জন্য উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, "একটি ঝুলরশির রাস্তা ধরে দুটি মালবাহী গাড়ি পরস্পরকে সামনে রেখে এগোচ্ছিল। যখন গাড়ি দুটি একেবারে মুখোমুখি হয়ে গেল, আমি ঠিক তক্ষুণি একটি টেলিগ্রাফের তার কেটে সামনে ফেলে দিলাম। সে সময়টায় বৃষ্টি ঝরছিল এবং বৃষ্টির দুটো ফোঁটা বাঁকা হয়ে নিচে পড়ল টুপ করে। সাত মিনিটের এই দৃশ্যটি বড় কাব্যিক। শেষাংশটাও বেশ জীবন্ত, আশা উদ্দীপক। এক দঙ্গল শিশু, যাদের মুখ সুখে ভাসছে, হাসছে, ধূমপান করছে, গান গাইছে, মতোয়ারা আনন্দে খেলাধুলা করছে। পুরো আবহের মধ্যে আনন্দময়তার ঔজ্জ্বল্য প্রস্ফুটিত হয়েছে।"

সত্যজিত রায়ের প্রথম সাত মিনিট ও শেষ ক্যেক মিনিট নিয়ে উচ্ছ্বাসের যৌক্তিকতা রয়েছে । সিকিমের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই সাত মিনিটে । ও হ্যাঁ, এই তথ্যচিত্রের ধারাবর্ণনা করেছিলেন সত্যজিত নিজে । তাঁর ভরাট কণ্ঠে, বলিষ্ঠ ইংরেজীতে ধারাবর্ণনা এই ডকুমেন্টারীটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য । ডকুমেন্টারীটি শুরু করা হয়েছে এক দল বৌদ্ধ ভিক্ষু একটি বিশেষ ধরণের বাঁশি বাজাচ্ছে । এরপরে সাত মিনিটে সিকিমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুন্সিয়ানার সাথে উপস্থাপন করা হয়েছে । ১৯৭১ সালে ধারণ করা কোন ডকুমেন্টারীর এমন কাজ সত্যিই অবাক করে দেয়ার মত । ছবিতে ধারাবাহিকভাবে উঠে এসেছে সিকিমের ভৌগলিক অবস্থান ও বৈচিত্র্য, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, সিকিমের স্থানীয় ও নেপালী জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, কিভাবে তারা পাহাড়ী ধসের মোকাবেলা করে, রাজা চোগিয়েল ও তাঁর পূর্বপুরুষদের জীবনী ও লাইফস্টাইল, সিকিমের বাজার এলাকা, স্কুলগামী শিশু, ইত্যাদিও পর্যায়ক্রমে উঠে এসেছে তথ্যচিত্রে । এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এমন কি ছিল এই তথ্যচিত্রে যে এটি পরবর্তীতে ভারত ও সিকিম সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হয়?

(পাহাড়ি রাস্তা)




(কাঞ্চনজংখা)

সপ্তম শতকে বৌদ্ধগুরু রিপকের ভাবাদর্শে সিকিম রাজ্যটি গড়ে ওঠে। রিপক ভবিষ্যতবাণী করেন, কয়েক শতাব্দী পরে সিকিমে রাজতন্ত্র গঠিত হবে। তের শতাব্দীতে পশ্চিম তিব্বতের রাজকুমার খিয়াম কোনো এক রাতে ভাগ্যান্বেষণে দক্ষিণে অবস্থিত সিকিমে যাত্রা করেন। তার পঞ্চম বংশধর রাজপুরুষরা ১৬৪২ সালে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং ফুন্টসগ নামিয়াল হলেন সিকিমের প্রথম রাজা। ১৭১৭-৩৩-এর দিকে পশ্চিমের নেপালি ও পূর্বের ভুটানিদের দ্বারা সিকিম নানাভাবে আক্রান্ত হয়। নেপাল সিকিমের তিরান নগরীসহ বেশির ভাগ এলাকা দখল করে। ব্রিটিশরাজ এই আক্রমণ ঠেকাতে পাল্টা আক্রমণ চালায়। ফলে ১৮১৪ সালে গুর্খা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এভাবে নানান উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ১৮৯০ সালে ব্রিটিশরাজ সিকিমের অভিভাবকত্ব গ্রহণ এবং পরবর্তী কয়েক দশকের জন্য সিকিমকে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রদান করে। ১৮৮৭ সালে ভারত ভাগের সময় ভোটের মাধ্যমে সিকিম ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু সিকিমের অভিভাবকত্ব ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর অধীনে হস্তান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। পররাষ্ট্র, সেনাবাহিনী, কূটনীতি এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভারতের কর্তৃত্ব ছাড়াই সিকিম স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য হিসেবে পরিচালিত হয়। ১৯৫৫ সালে সিকিমে নির্বাচনের দাবি ওঠে এবং সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদে নেপালিদের সংখ্যাধিক্য দাবি করা হয়। কিন্তু ১৯৭৩ সালে সংঘটিত দাঙ্গার ফলে সিকিম ভারতের সাহায্য চাইতে বাধ্য হয়। মহারাজা চোগিয়াল তখন জনপ্রিয়তা হারাতে থাকেন। ১৯৭৫ সালে ভারতীয় সংসদে সিকিমে ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব পেশ করা হয়, যে প্রস্তাবের প্রধান হোঁতা ছিলেন সিকিমেরই অন্যতম প্রধান নেতা লেন্দুপ দর্জি এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাজি। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ১৬ মে সিকিমকে বাইশতম অঙ্গরাজ্য হিসেবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

১৯৯৬ সালে প্রকাশিত একটি সাক্ষাতকারে সত্যজিৎপুত্র সন্দীপ রায়, যিনি এই ছবির শুটিংয়ের সময় তাঁর বাবার সঙ্গে সিকিম গিয়েছিলেন, তিনি 'সিকিম' ছবিটির শুটিং পর্বের কিছু কথা ওই পত্রিকায় তুলে ধরেন।

১৯৬৯-৭০ সালের কথা। সেই সময় খুব বেশি পর্যটক সিকিম ভ্রমণে যেত না। সিকিমের রাজধানী ও প্রধান শহর গ্যাংটক ছিল আজকের তুলনায় বেশ ফাঁকা। তখন বিদেশি পর্যটকরা ভারতে বেড়াতে এলে পাহাড়ে বেড়ানোর জন্য প্রধানত দর্জিলিংকেই বেছে নিতেন। তাই গ্যাংটক তখনো পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে সেভাবে গড়ে ওঠেনি। স্বাভাবিকভাবেই সিকিমের রাজা-রানী চেয়েছিলেন, পর্যটকদের কাছে সিকিম আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠুক। তাই রাজপরিবারের পক্ষ থেকে সত্যজিৎ রায়ের কাছে পস্তাব এসেছিল সিকিমের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের। সন্"্বীপ রায় এ জন্য এটিকে তথ্যচিত্র না বলে 'প্রোমোশনাল ফিল্ম' বলে উলেস্নখ করেছেন।

সত্যজিৎ রায় রাজা-রানীর কাছ থেকে ছবি নির্মাণের অনুরোধ পেয়ে সেখানে আদৌ কোনো ভালো ছবি নির্মাণ করা যায় কি না, তা পর্যবেক্ষণের জন্য সিকিম দেশটি ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নিলেন। সন্দীপ রায় জানাচ্ছেন, 'তখন সিকিম ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন দেশ। তাই সাধারণ ভারতীয়রা সিকিম যাওয়ার সুযোগ পেত না বললেই চলে। সুতরাং সিকিম সম্পর্কে তখনো ভারতীয়দের ধারণা খুব স্পষ্ট ছিল না। অথচ এমন সব প্রাকৃতিক দৃশ্য, এমন সব আশ্চর্য বৌদ্ধমঠ ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন আর প্রাচীন উৎসব এবং মানুষজন ছিল_এখনো আছে_ভারতের মধ্যে কোথাও এগুলোর জুড়ি মেলা ভার। তা ছাড়া আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, ছোট্ট দেশ হলে কী হবে, সিকিমের পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ একেবারে চার রকমের। এত কম দূরত্বের মধ্যে এত বেশি বৈচিত্র্য খুব কম জায়গাতেই পাওয়া যায়।'

(চলবে)

তথ্যসূত্রঃ ইত্তেফাক, সানন্দা
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০১২ সকাল ১১:১২
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×