somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বীর মুক্তিযোদ্ধা তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩১ শে মে, ২০১২ দুপুর ২:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন।

মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর, বীর উত্তম
দুঃসাহসী বীরযোদ্ধা
মুক্তিযুদ্ধকালে ৮ নম্বর সেক্টর ছিল যুদ্ধবহুল গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টর। এর আওতাধীন এলাকা ছিল বৃহত্তর যশোর ও কুষ্টিয়া জেলা এবং ফরিদপুর ও খুলনা জেলার অংশবিশেষ। ১৯৭১ সালের ১১ আগস্ট থেকে এই সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ওই এলাকায় বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয় মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুরের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। দুই-তিনটি যুদ্ধ তাঁর নেতৃত্বেই হয়। এর মধ্যে খুলনা জেলার শিরোমণির যুদ্ধ অন্যতম। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করলেও খুলনায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা সেদিন আত্মসমর্পণ করেনি। ১৬ ডিসেম্বর রাতে সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের বর্ণনা আছে মুক্তিযুদ্ধকালে ওয়ার করসপনডেন্ট মুসা সাদিকের লেখায়। তিনি লিখেছেন:
‘...যশোর-খুলনার প্রবেশদ্বার শিরোমণিতে ট্যাংক নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মুখোমুখি হন মঞ্জুর (মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর) ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১০৭ ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ খান।
‘রাত নয়টায় শিরোমণির মাটি গর্জে উঠল। শীতের বাতাস বারুদে ভারী হয়ে গেল। কামান ও ট্যাংকের গোলায় তেতে-পুড়ে ফেড়ে ফেড়ে যাচ্ছে শিরোমণির মাটি। আগুনে ঝলছে উঠছে আকাশ। ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠছে ঘরবাড়ি।
‘মিসরের বুকে রোমেল-মন্টগোমারীর সেই বিশ্বখ্যাত আল-আমিন ট্যাংক ব্যাটলের কথা বহুবার পড়েছি। চাক্ষুস দেখলাম শিরোমণির ট্যাংক ব্যাটল। সেই বিভীষিকাময় রাতে কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিকসহ আমি ছিলাম শিরোমণিতে।
‘রাত যত বাড়ছিল, যুদ্ধের তীব্রতা তত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। গোলার আঘাতে গাছপালাও ভেঙে পড়তে থাকে। ক্যাজুয়ালিটির পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। এই দীর্ঘ রক্তাক্ত মরণযুদ্ধের সমাপ্তি টানার জন্য মঞ্জুর নিজের ওপর রিস্ক নিলেন।
‘রাত চারটা ৫০ মিনিট। মেজর মঞ্জুর ইন কমান্ড। তাঁর সামনে ২৫টির বেশি পাকিস্তানি ট্যাংক, ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ ইন কমান্ড।
চারদিকে কামানের গোলা, ট্যাংকের গর্জন। তার মধ্যে দিয়ে এসএলআর উঁচিয়ে একজনের হাত সবার আগে উঁচু হয়ে ছুটছে। সেটি কমান্ডো মেজর মঞ্জুরের। মেঘের মতো তাঁকে জড়িয়ে উল্কার মতো ছুটছে তাঁর জানের জান সুইসাইডাল ঝটিকা কমান্ডোরা। তাঁদের সামনে পড়ছে কামানের গোলা, পেছনে পড়ছে ঝলকানো বারুদের দলা। এঁকেবেঁকে, কাত হয়ে, গড়িয়ে, লাফিয়ে অবিশ্বাস্য একটা গোলাকার মাংসপিণ্ডের মতো হয়ে তিনি তাঁর কমান্ডোদের নিয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলেন।
‘ততক্ষণে তাঁর (মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর) নির্দেশ অনুযায়ী মিত্রবাহিনীর দুটি ট্যাংক (টি-১৬০) শিরোমণির মেইন রোড এবং ডান দিক থেকে পাঁচটি ট্যাংক মাটি কামড়ে ছুটল তাঁদের পেছনে। ফ্রন্ট লাইনে কমান্ডো কলামটা যত লম্বা পা ফাঁক করা যায়, লাফিয়ে ছুটে গেল কমান্ডার মঞ্জুরের গতিপথ লক্ষ করে।
‘হায়াৎ খানের কামানের গোলা, ট্যাংকের গর্জন আর মর্টার শেলিংয়ের ট্যাংক বূহ্যের মধ্যে বজ্রের কড়কড়ে আওয়াজে উল্কার বেগে ঢুকে গেলেন মঞ্জুর তাঁর সুইসাইডাল স্কোয়াড নিয়ে। পাকিস্তানি কর্নেল ব্রিগেডিয়ারদের বিস্ময় ঘোর কাটতে না কাটতে চোখের নিমেষে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল হায়াৎ খানের ডিফেন্স। দুর্ভেদ্য বাংকার ভেঙে চৌচির। জ্বলন্ত ফোরম্যান ট্যাংক থেকে বেরিয়ে ভীতবিহ্বল সব হানাদার আত্মসমর্পণ শুরু করেছে।
‘চোখে না দেখলে এটা কীভাবে সম্ভব হলো কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। সেই জন্যই বোধ হয় ভারতের দেরাদুন আর্মি একাডেমি ও ব্রিটিশ স্যান্ডহার্টস আর্মি একাডেমিসহ অন্যান্য দেশের আর্মি একাডেমিতে ট্যাংক ব্যাটল অব শিরোমণির ওপর একটা চ্যাপ্টারই পড়ানো হয়।’
মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তানের (তখন পশ্চিম পাকিস্তান) শিয়ালকোটে। একটি ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুলাই মাসে সেখান থেকে কয়েকজনসহ পালিয়ে ভারতে আসেন। এক বয়ানে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মানসিক দিক থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এতে যোগ দেওয়ার জন্য। পালানোর পথ খুঁজছিলাম। অবশেষে সে সুযোগ হয় ২৬ জুলাই। অনেক পথ পেরিয়ে আমি ৭ আগস্ট কলকাতায় আসি।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুরকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৮।
মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর ১৯৮১ সালের (৩০ মে) চট্টগ্রামে সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনায় (২ জুন) নিহত হন। তখন তাঁর পদবি ছিল মেজর জেনারেল এবং জিওসি হিসেবে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন।
মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুরের পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার কামালপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মো. নাজিবুল্লাহ, মা শামসুন নাহার। স্ত্রী মাহফুজা মঞ্জুর। তাঁদের দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা বর্তমানে আমেরিকায় বসবাস করছেন।
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, দশম খণ্ড, আমাদের সংগ্রাম চলবেই, অপরাজেয় সংঘ।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×