somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের সীমার জন্য একটা স্কুল প্রয়োজন

২৪ শে মে, ২০১২ সকাল ১০:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
প্রতিদিন সবাই উৎকন্ঠা থাকে। অপেক্ষায় করে। সীমার জন্য একটা স্কুল পাওয়া গেল কি? এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা। পাওয়া যাবে তো, তার উৎকন্ঠা। কিন্তু ১৩ দিনেও এর একটির জবাব মেলেনি।

নুসরাত,কলি, পাপিয়া,ঝিলিক, রিমন,তুষার,নাদিম,সুমি, জাকিরসহ ২১জন মিলে অর্ধশত স্কুল খুঁজে ফেলেছি। লক্ষ টাকা গুরু দক্ষিণা নেওয়া স্কুল থেকে শুরু করে মাগানার প্রাইমারি স্কুল যেখানেই হোক সীমার জন্য একটি আসন। ‘ডানে বায়ে ঘুরে বেড়াই, মেলান যদি প্রভু।’ কিন্তু ধানমন্ডি, ঝিগাতলা, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর, রায়ের বাজার কোথাও সীমার জন্য স্কুল নেই। অন্ধ, মূক, বধির, সুস্থ, সাদা-কালো, মেধাবি-মেধাহীন, মনযোগী-অমনোযোগী, বিত্তবান-বিত্তহীন সব শিশুর জন্য স্কুল আছে এই শহরে। আছে নাচের, গানের, আাঁকার আর কত রকম স্কুল। শুধু একটা স্কুল নেই সীমার জন্য।

কত স্কুলে যে আমার গেলাম! যখন বলি একটা বাচ্চা ভর্তি করব। অনেকেই রাজি হয়। কিন্তু সীমার ছবিটা দেখে পরক্ষণেই বলে না ভর্তি সম্ভব নয়। কেউ কেউ বিনয়ের সঙ্গে বলে “ আসলে হয়ে কী! বছরে মাঝামাঝি আমরা ভর্তি করি না।” আবার কেউ সহানুভ’তি দেখিয়ে বলে “গ্রাম মেয়ে! বুঝেনই তো এখানে প্রতিযোগীতায় পারবে না।” যাদের বিষয়িক বুদ্ধি ভালো, তারা বলেন “আরে ভাই! এত টাকা খরচ করে পড়িয়ে লাভ কি বলুন তো?” আরেকজন আরো এককাঠি সরেস। যে কিনা স্কুলের মালিক। তার ভান্ডারে আছে ডজনখানিক দেশ দেখার অভিজ্ঞতা। তিনি পরামর্শ দিলেন, সীমার জন্য একটা স্কুল খুলে ফেলবার। আশ্বাস দিতেও কার্পন্য করেননি। বলেছেন, প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবেন। স্কুল খোলা পরই আমরা বুঝব কেন সীমাকে ভর্তি করা হয়নি। সীমার জন্য স্কুল না পেলেও বিনামুল্যে এমন হাজারও উপদেশ পাচ্ছি।

এখন সীমার কথা বলি। স্কুলে কাশ টুতে পড়ে। বয়স মাত্র নয়। চোখ বন্ধ করলেও, ভেসে ওঠে লাল টুকেটুকে জামা পড়া একটি দুরন্ত শিশুর মুখচ্ছবি। বুদ্ধিদীপ্ত, দুষ্টুমিভরা এক জোড়া চোখ। কিন্তু আমাদের সীমা এমন নয়। হয়ত এমনই হওয়া কথা ছিল। কিন্তু ওর বয়স যখন নয়, তখন তার পাষন্ড বাবা ও চাচা এসিড ঢেলে সীমা ও তার মায়ের মুখ জ্বলসে দেয়। ওর সুশ্রী চেহারার লাবন্যটুকু কেড়ে নিয়েছে এসিড। এরপর পদ্মায় মেঘনায় অনেক জল গড়িয়েছে। মাতৃক্রোড় হারিয়ে, সীমা এখন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্কুলের আবসিক ছাত্রী।

সীমার মা মীরা। সংসার হারিয়েছেন অনেককাল আগেই। নিজেও এসিডদগ্ধ। সব মেনে নিয়েছেন। শুধু এখন একটিই চাওয়া। নিজের মেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চান। এই আকুতিই তার কন্ঠে। বলেন, “ইদানিং ঘুমের মাঝে মেয়েটাকে বেশি বেশি স্বপ্নে দেখি। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সারা রাত আর ঘুম আসে না। আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে কেমন লাগে। মনে হয় মেয়েটার কাছে ছুটে যাই রাতেই। প্রায়ই ভাবি মেয়েটাকে ঢাকায় নিয়ে আসব। কিন্তু এই শহরে তো কোন স্কুলে সীমারে স্কুলে ভর্তি করব না”।


আমার প্রবাসী বন্ধু এটম রহমান নিজের মাকে দেশে ফেলে হাজার মাইল দুরে থাকেন। তাই সীমার ও তার মায়ের কষ্টটা খুব করে বুঝেন তিনি। এই কষ্টের অবসান করতে চান। তাই নিজেই উদ্যোগ নিয়ে স্কুল খুজে বের করে সীমাকে ঢাকায় নিয়ে আসতে চান। সেই অনুযায়ী চেষ্টাও করছেন। সীমার মায়ের জন্য ঢাকায় বাসস্থান ও কর্মসংস্থান দুই-ই খুব কঠিন নয়। কিন্তু সব উদ্যোগ আটকে গেছে, কেন না সীমার জন্য দুই কোটি মানুষের রাজধানীর কোন স্কুলেই একটি আসন নেই। অনেক চেষ্টা করেও পাওয়া যায় না। প্রতিবন্ধী স্কুল হয়ত সীমাকে ভর্তি করাবে। কিন্তু একটাই প্রশ্ন একজন স্বাভাবিক বুদ্ধির শিশুকে কেন ভর্তি হতে হবে বিশেষ শিশুদের স্কুলে?

সবাই মিলে রোজই স্কুল খুঁজি। ভাবি হয়ত পরের স্কুলেই একটা আসন হয়ে যাবে সীমার জন্য। অষ্ট্রেলিয়ায় ফোন করে, এটম ভাইকে বলতে পারব “ভাই...! স্কুলটা আমি পেয়ে গেছি সত্যি। এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না।” আমি জানি এটম ভাইও এই কথা শুনতে অধীর অপেক্ষায় আছেন।তার বিশ্বাস আমরা আমরা সীমা পূরনে একটা স্কুল খুঁজে পাবই। এই বিশ্বাস নিয়ে আমাদেরও সকাল শুরু হয়। আমরা স্কুল খুঁজি। আজও খুঁজব।

এই শহরে সভা সেমিনারে আমিও চিৎকার করেছি বহুবার বলেছি অধিকার! অধিকার! শতবার পড়েছি পাঠ বই, পত্র-পত্রিকাতে। সভা সেমিনার, ভাষণে শ্লোগানে কতবার শিক্ষাকে দেখেছি অধিকারের মোড়কে। আমার সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭এ একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা দানের কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ১৯ (১) সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতার নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষা (বাধ্যতামূলক করণ) আইন, ১৯৯০. ( ১৯৯০ সনের ২৭ নং আইন ). [১৩ ফেব্রুয়ারী,, ১৯৯০]. প্রাথমিক শিা বাধ্যতামূলক করণকল্পে প্রণীত আইন৷. যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষা
বাধ্যতামূলক করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়;. সেহেতু এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল :-. সংপ্তি শিরোনামা. ১৷ এই আইন প্রাথমিক শিা (বাধ্যতামূলক করণ) আইন, ১৯৯০ নামে অভিহিত ...

বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ ও ১৯৮১ সালে প্রাথমিক শিা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৯০ সালে জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রাথমিক শিা (বাধ্যতামূলককরণ) আইন পাস করে।


এদেশের সংবিধান,আইনে সুস্পষ্ট করে না ছলে শত শত বার লিখা আছে সীমার অধিকারের কথা। কিন্তু আজ কোন আইন, অধিকারই সীমার জন্য স্কুলের সন্ধান দিতে পারছেনা। তারপরও আমাদের স্কুল খোজার দলটা ক্রমেই বড় হচ্ছে। এক সময় হাজার ব্যস্ততার মাঝেও বিদেশ থেকেই নানাভাবে এটম রহমান একাই সীমার জন্য যে স্কুলটা খোঁজ বেড়িয়েছেন। আজ সেই দলে অনেক বড়। প্রতিদিনই একজন না একজন যুক্ত হয় কাল রাতে এসে যুক্ত হয়েছেন ইটিভির সাঈদ মুন্না, সমকালের আমার বন্ধু রাজিব আহাম্মদ। দলটা এখন প্রায় ত্রিশ ছুঁয়েছে। আমরা সীমার স্বপ্নপূরনে একটা স্কুল খুঁজে বের করার স্বপ্ন দেখি। এই নগরে একটা স্কুল খুঁজে পেতেই হবে।



আমরা বিশ্বাস করি ইট-পাথরের এই শহরের সবগুলো মানুষের হৃদয় এখনও পাথর হয়ে যায়নি। এই হাজারো সীমাবদ্ধতার মাঝেও আমরা একটা স্কুল পাব। কারো দয়া কিংবা করুনায় নয়। সীমা তার সাংবিধানিক অধিকার, মানবিক অধিকার বলে মাথা উচুঁ করে স্কুলে যাবে। সীমার পরশে আমাদের সমাজ প্রতিবন্ধী মানসিকতা থেকে মুক্তি পাবে।

বি :দ্র : সীমা এবং মীরাকে (সীমার মা) এসিড নিক্ষেপের অপরাধে নিম্ন আদালত যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মানুষগুলো উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে ভাল আছে।

সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১২ বিকাল ৪:১০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×