somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ওয়ান ম্যান পার্টির মিনিস্টারঃ দিলীপ বড়ুয়া:D

১৭ ই মে, ২০১২ রাত ৩:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দেশের নিঃসঙ্গতম বাম রাজনৈতিক নেতা দিলীপ বড়ুয়াকে কেউ বুঝল না। তার ত্যাগ-তিতিক্ষা, তার প্রেম, তার নিষ্ঠাকে কেউ আমলে নিল না। তিনি যে কত বড় নেতা—কেউ পাত্তা দিল না। না হয় নিজ জেলার বাসিন্দা ড. ইউনূসকে নিয়ে একটু তিতা কথা বলেছেন, আর অমনি সবাই কথার রামদা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দিলীপদার দুঃখও কেউ বুঝল না। তার মূল্য ও কৃতিত্বও কেউ বুঝল না। সৈয়দ আশরাফুল, আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাসমন্ত্রী শাজাহান খান কত উল্টোপাল্টা বললেন। কই, কেউ তো তাদের ওইভাবে লাল চক্ষু দেখাল না। শুধু দিলীপ বাবু বললেই দোষ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বললে দোষ হয় না, তার কথার মুক্ত কচ্ছ মন্ত্রীরা বললে দোষ হয় না—শুধু দাদা বললেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়। একইরকম দুর্ভাগ্য দেখেছি সুরঞ্জিতদার ক্ষেত্রেও। কেউ কেউ সুটকেসভর্তি টাকা নিলেও দোষ হয় না, আর দাদার এপিএস, না ভাড়াটে ভৃত্যর কাছে টাকার ব্যাগ পাওয়ার পর তা নিয়ে কত হৈ চৈ। দাদাকে কী অপমানটাই না করা হলো। কী লাঞ্ছনা! ৫০ বছর বর্ণাঢ্য রাজনীতির শেষে এখন কিনা তিনি ঘর থেকে বেরুতেই লজ্জা পাচ্ছেন। কী কষ্ট, কী দুঃখ! এই বীভত্স অসম্মান একদমই সহ্য করার মতো নয়। আমি গভীরভাবে সহানুভূতি প্রকাশ করছি দিলীপদার জন্য। থাকল সহমর্মিতাও। নগণ্য একজন সংবাদকর্মী হিসেবে টুকটাক তাকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সরল সাধারণ নিরীহ তার জীবন। বর্তমান জমানায় যে কোনো রাজনীতিবিদের কাছে কোটি টাকাও কোনো বিষয় নয়, অথচ মন্ত্রী হওয়ার আগে ৫০০ টাকার জন্য হন্যে হয়ে ছুটতে দেখেছি আমরা অনেকে। তার গাড়ি ছিল না, হেঁটে চলতেন। রিকশা-বাসে চড়েই জীবন। রাজনৈতিক সংসার নির্বাহ করেছেন সর্বদানে। সর্ব অনুগ্রহে। আওয়ামী লীগ-বিএনপি বাছ-বিচার করেননি। মান্নান ভূঁইয়ার কাছে গেছেন। খালেদা জিয়ার শরণ নিতে তাকে দেখেছি। একইসঙ্গে শেখ হাসিনার আনুকূল্য নিতেও কার্পণ্য করেননি।
প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের আধুনিক রাজনীতির ইতিহাসের তিনি নগর বাউল। তাকে নষ্ট রাজনীতির নষ্ট প্রবাহের মাঝে বিরল প্রজ বৈষ্ণব বা বোষ্টম বললেও অত্যুক্তি হয় না। এই গোসাইয়ের কদর করেছেন সবাই। কারও দরজা তার জন্য বন্ধ ছিল না। সবাই হয়তো মহাসমারোহে তার সমাদর করতেন না সত্য, আবার রাজনীতির এই বোষ্টমকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেননি কেউ—সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও বিশিষ্ট একটি অবস্থান তিনি রক্ষা করেছেন সযত্নে। দিলীপদার এই অতুলনীয় দিকটি কেউ দেখল না।
শুধু অনুগ্রহ ও ভালোবাসাকে পাথেয় করেননি দাদা। কখনও কখনও নিগ্রহ, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যকে তিনি উদারভাবে নিয়েছেন। অবহেলা, অসম্মান করে তার বৈষ্ণব মনকে দমানো যায়নি। বাম ছাত্ররাজনীতির সেই উত্তাল জমানায় প্রয়াত মান্নান ভূঁইয়ার সঙ্গীয় স্বজন ছিলেন একসময়। অতিঘনিষ্ঠ। সেই ঘনিষ্ঠতা ও আত্মার আত্মীয়তা রক্ষা করে গেছেন সব সময়। মান্নান ভূঁইয়া পরবর্তীকালে বিএনপির মহাসচিব, দুঁদে মন্ত্রী। মন্ত্রীর বাড়ি ও দফতরে গেলে একটু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হতে হয়, সেটা সবারই জানা। দিলীপ বড়ুয়াও জানতেন। তিনি জানতেন, এখন মন্ত্রীর কাছে গেলে তাকে তাড়িয়ে দেয়ার ভাবভঙ্গি করা হতে পারে। মুখে না বলে হয়তোবা আরদালিকে দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হতে পারে—মন্ত্রী হওয়া একটা মস্ত ব্যাপার।
দাদা ওসবের পরোয়া করেননি। বোষ্টমকে সবকিছু পরোয়া করলে চলে না। সচিবালয়ে সকালবেলা ঢুকেছেন। কোনোমতে পাস জোগাড় করেছেন, মান্নান ভূঁইয়ার চেম্বারে ছুটে গেছেন। কিন্তু মন্ত্রীর দেখা পাওয়া সহজসাধ্য নয়। তাকে রুমে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়নি। তাতে কি! তিনি ধৈর্য হারাননি। অধৈর্য হলে নিঃসঙ্গ বাম-চারীর চলে না। তিনি কোনো এপিএস, পিআরও, এমনকি তারও অধস্তন কোনো রাষ্ট্রকর্মচারীর কক্ষে বসে থেকেছেন। বসে বসে দেখেছেন, মন্ত্রী হওয়ার জাঁকজমক। তার চোখের সামনে দিয়ে আনন্দে হেসে হেসে পাতিনেতা-পুতিনেতা—এই কালকের ছুকড়ি ছাত্রনেত্রীরা দল বেঁধে ক্ষমতার সুবর্ণ কঙ্কন দেখিয়ে মন্ত্রীর দরবারকক্ষে ঢুকেছে, অথচ তার অনুমতি মেলেনি। তাকে কেউ বলেনি, মন্ত্রীজী আপনাকে ডাকছেন।
ক্লেশহীন মুখে তিনি সহ্য করে গেছেন সবকিছু। হয়তো বড়জোর মনে মনে বলেছেন, একদিন মন্ত্রী হলে আমিও...।
কোনো কোনো দিন দেখা করাই হয়নি মন্ত্রীর সঙ্গে। নিরাশ হননি। পরদিন আবার এসেছেন। অপেক্ষা করেছেন। তার এই ত্যাগ-তিতিক্ষা রাজনীতির ইতিহাসে কেউ কোনোদিন লিখবে না। বেশিরভাগ দিন ঠায় পড়ে থাকতেন।
সচিবালয়ে এপিএস-তস্য অধস্তন রাজকর্মচারীর কক্ষে বসার দুর্ভাগ্য যাদের হয়েছে, তারা নিশ্চয়ই জানেন—এসব কক্ষে কী হয়!
এরা রাজা-উজির মারে। অশ্রাব্য সব সংলাপ পাড়ে। প্রতিপক্ষকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ঠাট্টা-মশকরা করে। দাদা সেই রুচিহীন কক্ষে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন। কদর্য কথাবার্তা শুনে নাক-মুখ সিঁটকাননি। তাকে এটা-সেটা বলে রুম থেকে উঠিয়ে দেয়ার চেষ্টাও হয়েছে। কেউ পরোক্ষভাবে অপমানসূচক কথাও বলেছে। ‘হালায় এইখানে কী চায়—তোপখানায় কোনো কাম নাই। আইজকা তো মান্নান ভাই মানিব্যাগ নিয়াই আসে নাই।’ দাদা মুখ বুজে সব সয়েছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছেন। অবশেষে মন্ত্রী যখন বেরিয়েছেন, দাদা তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে গেট পেরিয়েছেন সচিবালয়ের। আবার পরদিন মন্ত্রীর সঙ্গে সামান্য একটু হাঁটার সুখটুকুর জন্য ধরনা দিয়েছেন সেখানেই। দাদার বাউলা জীবনযাপন নিয়ে কত কথা তখন শুনেছি, জেনেছি। বিকাল ও সন্ধ্যার জগিংটা সেরে নিতেন তোপখানা-পল্টনের বিচ্ছিন্ন আড্ডা এবং নানা জায়গায় ঢুঁ মেরে। তার এই যে সুবর্ণ কান্তি চেহারা, ফিট স্মার্ট তারুণ্য-ভরা শরীর—তার রহস্য এখানেই। তিনি তো কেবল মান্নান ভূঁইয়া—বিএনপির মন্ত্রীর দফতরে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বিএনপি সরকারে বলে তাদের পেছনে ঘুরঘুর করছেন, এমন অভিযোগ করার কোনো সুযোগ ছিল না। তিনি ওয়ার্কার্স পার্টির গলি, মেনন সাহেবের বাম ক্লাব রাজনীতির সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে থাকতেন—বক্তৃতার সুযোগ পেলে দু-চার কথাও বলতেন। তারপর একাকী পথ চলা। সঙ্গী-সাথী কেউ নেই। সঙ্গীয় কোনো নেতা নেই। কর্মীটর্মীর বালাই নেই। নিঃসন্তান পিতার মতো একদম ঝাড়া হাত-পা। সাম্যবাদী দল (এমএল) একেবারেই নিজস্ব সম্পত্তি। কারও সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারা করেননি। দলে আরও নেতা থাকলে উটকো ঝামেলা। ক’দিন বাদে বাদেই নানা গ্রুপবাজি; দলে ভাঙ্গন। কর্মী থাকলে আরও সমস্যা। অফিস রাখতে হয়। চা-নাস্তা খাওয়ার পয়সা দিতে হয়। সেজন্য চান্দাবাজি করতে হয়। দাদা এসবের মধ্যে একদম জড়াননি।
ঢাকাই রাজনীতির জনারণ্যে নিঃসঙ্গ শেরপার মতো একাই পথ চলেছেন নিশঙ্ক নিশ্চিন্ত চিত্তে। সাম্যবাদী দল সাইনবোর্ডখানা দিলীপ বড়ুয়া নামটার সঙ্গেই ওতপ্রোত যুক্ত। একেবারে কাঁঠালের আঠা দিয়ে লাগানো। তিনি স্নবিশ নন। তার মোটেই নাক-উঁচু ভাব ছিল না। একমাত্র জামায়াত বাদে সবার সঙ্গেই ছিল তার অন্তরঙ্গ সখ্য। আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায় ছিল না। তাতে কি! তিনি তো মান্নান ভূঁইয়ার কাছে কোনো দাসখত দিয়ে আসেননি। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যেতেন কখনও সুধাসদন, কখনও কোনো আওয়ামী লীগ নেতার বাসাতে। তিনি কোথাও হাজির হলে দুটো অস্তিত্বের জানান পাওয়া যেত। দিলীপ বড়ুয়া যেমন এসেছেন, সঙ্গে আস্ত একখানা দলও চলে এসেছে।
রাজনীতির এই বন্ধুর পথে দাদা একাই একশ’। ওয়ান ম্যান আর্মির মতো ওয়ান ম্যান পার্টি। একটা মাত্র মানুষ—তিনি কত বড় মাপের হলে আস্ত একটা দলকে একা কাঁধে বয়ে বেড়াতে পারেন, একা চালিয়ে নিতে পারেন, সেই মহত্তম দিকটা কেউ মূল্যায়ন করল না। প্লিজ বেয়াদবি নেবেন না। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। বাঙালির সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তার কথাই যদি ধরি—আওয়ামী লীগে যদি শুধু বঙ্গবন্ধু একাই থাকতেন আর কোনো নেতা নেই, কর্মী নেই। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, আওয়ামী লীগ নামে একটা দল আছে, তা কেউ জানত না। শেখ মুজিব নামে কোনো নেতাকে কেউ চিনত না।
বঙ্গবন্ধুর জন্যও যা ছিল দুঃসাধ্য- দাদা সেই অসাধ্যকে সাধন করেছেন। তিনি যেমন সাম্যবাদী দলকে মহাজোট সরকারে মন্ত্রিত্বের কোটা পাওয়ার যোগ্য দলে পরিণত করেছেন, তেমনি একক প্রয়াসে দিলীপ বড়ুয়ার মতো একজন নেতারও জন্ম দিয়েছেন।
প্রবীণ আইনজীবী রফিক-উল হকের কথায় খুব কষ্ট পেয়েছি। তিনি সেদিন বয়ান করলেন—গুণীজনের মান রাখতে হয়। অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করার ‘ছবক’ও দিলেন সৈয়দ আশরাফ ও মীর্জা ফখরুলকে। অথচ নিজে কী করলেন? দিলীপ বড়ুয়ার এই অতুলনীয় গুণাবলি ও কৃতিত্বকে অগ্রাহ্য ও খাটো করে বললেন, দাদা নাকি ড. ইউনূসের নখের যোগ্যও নন। কী বেদনাদায়ক তাচ্ছিল্য! ‘নখ’ মানুষের শরীরের বর্জ্য পদার্থ। আমরা নিয়মিত নখ কর্তন করে বর্জন অব্যাহত রাখি। আমাদের এমন গুণধর দাদা কিনা তার দৃষ্টিতে শরীরের বর্জ্যের চেয়েও তুচ্ছ।
আমি এখানে মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনাকে সশ্রদ্ধ চিত্তে সাধুবাদ জানাতে চাই, তার উদারতার প্রশংসা করতে চাই। দেশের প্রবীণ ও সেরা আইনজীবীর দৃষ্টিতে যা বর্জ্য, নখের চেয়েও তুচ্ছ—হাসিনা তার যোগ্য মূল্যায়ন করেছেন, উকিলের মন্ত্রণায় কান দেননি। তিনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতির এমন একটা বাউলা-বোষ্টম মানুষ। সমাজের উঁচুতলার প্রভাবশালীদের শত গঞ্জনা, লাঞ্ছনা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য যিনি বছরের পর বছর সহ্য করে চলেছেন ক্লেশহীন দুঃখহীন চিত্তে। রাজনীতি কি শুধু গডফাদার সন্ত্রাসীরাই করবে, তারাই মন্ত্রী হবে—সে কেমন কথা। শেখ হাসিনা তার উদার শক্তিমত্তা— চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন—তিনি এমন ক্ষমতাদাত্রী, তিনি ছুঁয়ে দিলে ছাইও হতে পারে সোনা। নখ-তুল্য বর্জ্য হতে পারে মন্ত্রী।
তিনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে দেখেছিলেন—এমন একটা বৈষ্ণব রাজনীতিকের যথার্থ মূল্যায়ন করছে না জনগণও। তারাও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। জনগণ ভুল করলেও হাসিনা ভুল করতে পারেন না। জনগণের ভুলকে যিনি শুধরে দিতে পারেন তিনিই প্রকৃত নেতা। দিলীপদা সাত্ত্বিক মানুষ সত্য—কিন্তু তিনি যে তার সাম্যবাদী কীর্তনে ভোটারদের ভজাতে চাননি, তা কিন্তু বলা যাবে না। তিনি চেষ্টা করেছেন, জনগণের কাছে গেছেন। তার বাড়ির কাছের এলাকা মিরসরাই সংসদীয় আসনে ভোটের লড়াইয়ে লড়ে গেছেন। রাজনীতি করবেন, আবার ভোটারদের কাছে যাবেন না, সে হয় না। ১৯৯৬ ও ২০০১—পরপর দুই নির্বাচনেই তিনি হাজির হয়েছেন জনগণের অনুগ্রহের সামনে। ১৯৯৬ সালের কথাই ধরি। চেয়ার প্রতীক নিয়ে সংসদের চেয়ারে বসতে চাইছিলেন তিনি। ওই আসনে ভোটার ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার ৩৪৩। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৭০৩ জন ভোট দিলেন। দিলীপদা সেই ভোটের বাক্সে তার জনপ্রিয়তার দাঁত বসাতে পেরেছিলেন বৈকি, ৫৭৭টি ভোট পড়েছিল তার পকেটে। জামানত খুইয়েছেন। কত কষ্টের টাকা। তা ছিনতাই করে নিল নির্বাচন কমিশন। দাদা অদম্য। তিনি ভাঙতে পারেন, কিন্তু মচকানোর পাত্র নন।
’৯৬-এর নির্বাচনে মোট ভোটের শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ ভোট পেলেও লজ্জা তাকে কাবু করেনি। জনগণকে দেখে নেয়ার প্রত্যয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে আবার বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেন মূর্খ ভোটারদের সামনে। এবার মিরসরাই আসনে ২ লাখ ২৪ হাজার ৮৩ ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ৭২ হাজার ভোট দেন। বিষয়টি দুঃখজনক বৈকি। এবার দেখা গেল—তার জনপ্রিয়তার পারদ নিম্নমুখী। তিনি ভোট পেলেন ৩০৭টি, আগের বারের চেয়ে ২৭০ ভোট কম।
দাদা সর্বদা মার্কসবাদ-লেনিনবাদী রাজনীতি ও আন্দোলনে জড়িত। তিনি মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টি যাচাই করেও কোনো গ্রহণযোগ্য সূত্র খুঁজে পেলেন না। বিভ্রান্ত ও বিপন্ন বোধ করতে থাকলেন। মার্কসীয় দর্শনে বৈষ্ণবপনার কোনো স্থান নেই। দিনের বেলা মান্নান ভূঁইয়া, রাতে সুধাসদন—এই বাউলা রাজনীতিই তার কাল হলো! যা তবুও আগেরবার ৫৭৭টি সমর্থন পেয়েছিলেন, সেখান থেকে ২৭০টি কাটা পড়ল কেন? ২৭০ জন মানুষ কি তবে তার ঢাকার খবর জেনে গিয়ে সটকে পড়েছে। এটা ঠিক, দাদা চারদলীয় জোটের সরকারের সচিবালয়ে নিত্য গিয়ে পড়ে থাকতেন বটে, কিন্তু আনুগত্যের পাল্লাটা সুধাসদনেই বেশি ছিল।
২০০৮-এর নির্বাচনে যখন অনেকেই আশঙ্কা করছিলেন, দাদার বাক্সে দাদার নিজের ও বৌদির ভোট ছাড়া অন্য ব্যালট অনিশ্চিত—ঠিক তখন শরণদাত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার আবির্ভাব। অনুগ্রহ-ধন্য হলেন তিনি। তিনি মওকা পেয়েছিলেন এবং নিখুঁত নিশানায় বলটি ফেলেছিলেন। এই লোকশ্রুতি অনেকেরই জানা, তবুও প্রসঙ্গের কারণে বলছি আবারও। তক্কে-তক্কে ছিলেন দাদা। বৈষ্ণব হলেও বিষয়বুদ্ধির হুঁশ হারাননি। ওয়ান ম্যান পার্টি নিয়ে সগৌরবে শরিকানা পেয়েছেন মহাজোটে। মেনন-ইনুর সঙ্গছাড়া তেমন একটা হন না। তোপখানায় ওয়ার্কার্স পার্টি, বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে জাসদ ইনুর অফিসের কাছে-পিঠে আঠার মতো থাকছেন, কখন কি ঘটে যায়! মহাজোট নেত্রী শরিকদের তখন ছিটেফোঁটা দু-একটা আসন দিতে গিয়ে পেরেশান। বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটা টিকিট আর নৌকার স্টিকার বিলাতে নানারকম চাপ ও দুশ্চিন্তার শিকার হচ্ছেন তিনি। মেনন চাইছেন বরিশালে, ইনু চাইছেন কুষ্টিয়ায়। আসন তো আর মোয়া-মুড়কি নয়, চাইলেই দেয়া যায়।
এইসব উটকো শরিককে মন্ত্রিত্বের টোপ দেয়া হলো। বলা হলো—আসন স্যাক্রিফাইস করলে টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রিত্ব পাকা। ইনু, মেনন ওয়ানম্যান পার্টি করেন না। তারা বললেন, ভোটের রাজনীতি না করলে তাদের দল টেকানো মুশকিল। কর্মীরা তা মানবে না।
ইনু-মেননকে কোনোভাবেই রাজি করানো গেল না। তারা নাছোড়বান্দা। মেননকে বরিশালে দেয়াই যাচ্ছিল না। অনেক কষ্টে ঢাকার নবসৃষ্ট আসনগুলোর একটা দিয়ে তবুও রক্ষে।
দিলীপদাদাও ছিলেন মহাজোটের বাম ডেলিগেশনে। তিনি মিরসরাইবাসীর বেইমানির কথা হাড়ে হাড়ে মনে রেখেছিলেন। তিনি আগ বাড়িয়ে মোক্ষম মওকায় মোক্ষম চালটি চাললেন। বললেন, নেত্রীর জন্য তিনি উত্সর্গ করতে প্রস্তুত। মন্ত্রিত্বের শিকা’র নীচে তিনি উত্সর্গ করলেন মিরসরাইয়ের আরেকটি শোচনীয় বিপর্যয়কে। তারপর বাকিটা ইতিহাস। দিলীপ বড়ুয়া প্রমাণ করে দিলেন— বাংলাদেশের বাম ক্লাব পলিটিক্সে সবচেয়ে বড়া খেলোয়াড় কে! ব্যারিস্টার রফিক-উল হক যাই বলুন—কী আসে যায়, জো জিতা ওহি সিকান্দার। রাশেদ খান মেনন এর আগেও এমপি হয়েছেন, এবারও নৌকার স্টিকার নিয়ে বৈতরণী পার হলেন। হাসানুল হক ইনু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আরেকজান্ডার ভাবতেন নিজেকে। আকারে যাই হোক—দু’জনেরই স্বীকৃত ক্লাবঘর—ঠিকানা রয়েছে। সেখানে কর্মীরা আসে-যায়। কিন্তু ওরা কেউ রাজনীতির বাসরঘরের বেড়ালটি মারতে পারেননি। সেটি মাহেন্দ্রক্ষণে ঠিকই খাটের পায়ায় বেঁধে এক কোপে মেরে রেখেছিলেন এই ওয়ান ম্যান পলিটিশিয়ান। মেনন-ইনু কত মান-অভিমান করলেন। হায় হায়—হুতাশ করলেন। মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেন, কোনো কাজই হলো না। আজীবন রাজনীতি করেও তাদের মন্ত্রী হওয়া আর এ জীবনে হলো না।
ব্যারিস্টার হাসে, হাসুক; তাকে নোখের অযোগ্য বলে বলুক, কী আসে যায় তাতে? দিলীপ বড়ুয়া যা পেয়েছেন, যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় পেয়েছেন, তা দু-চারটা নোবেল পুরস্কারের চেয়ে অনেক বড়। ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন সত্য। সৈয়দ আশরাফ যাই বলুক, হরিলুটের বাতাসা হিসেবে সেটি ইউনূস পাননি।
এই নোবেলটি পেতে দিনের পর দিন ক্লান্তিহীন পরিশ্রম করতে হয়েছে। দিনের ২৪ ঘণ্টার ১৮-১৯ ঘণ্টা লড়েছেন। মাঠে-ঘাটে ছুটে বেড়িয়েছেন। লাখ-কোটি মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকে লাখ লাখ দরিদ্রকে সংগঠিত করেছেন। এদের সিংহভাগ সদস্যের জীবনে সচ্ছলতা ও পরিবর্তন এনে দিয়েছেন। দাদনের করাল গ্রাস থেকে মানুষকে রক্ষা করেছেন। ১০ টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার মৌসুমি চমক দেখিয়ে বলা নেই, কওয়া নেই, বাজিমাত করতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি হিরো সাজতে গিয়ে প্রমাণ করেছেন, রাতারাতি অর্থনীতির হিরো হওয়া যায় না।
আর ড. ইউনূস আন্তর্জাতিক হিরো হলেও কোনো শর্টকাট পথে সেটা বাগাতে পারেননি, তাকে খাটতে হয়েছে। দীর্ঘ একটা জীবন ধরে পদে পদে লড়াই করে দারিদ্র-দাদনবিরোধী যুদ্ধে তিলে তিলে জীবনীশক্তি ক্ষয়ের বিনিময়ে পেয়েছেন নোবেল নামক সম্মান।
মন্ত্রিত্ব ড. ইউনূসের কাছে তুচ্ছ হতে পারে, ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের কাছে তাচ্ছিল্যের হতে পারে, কিন্তু দিলীপ বড়ুয়ার কাছে অতি মহার্ঘ, অতি মর্যাদার—অতি মূল্যবান। ৩০৭টি ভোট পাওয়ার যোগ্য একটা মানুষ কী অনায়াসে শুধু সময়ের কাজটি সময়মত করে ইনু-মেননের মতো বাঘা বামপন্থীদের পেছনে ফেলে মন্ত্রিত্ব হাসিল করলেন—এটা সাম্প্রতিক রাজনীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। একা একটা মানুষ, কর্মীহীন নেতাহীন এক ব্যক্তির এক পার্টি নিয়ে জয় করে দেখালেন মন্ত্রিত্ব—দাদার এই সেকেন্দারীর উপযুক্ত মূল্যায়ন হচ্ছে না, এটা সত্যিই পরিতাপের।
তাছাড়া তিনি আদতে নিজ জেলার বাসিন্দা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় কিছু বলতে চাননি, বলার যোগ্যও নন তিনি। কারও বিরুদ্ধে কিছু বলার মতো লোক তিনি নন। কাউকে ক্ষেপিয়ে দেয়ার কম্মো’টি তার পছন্দের নয়। তিনি ভালোবাসেন সবাইকে খুশি রাখতে। জগতের সব মানুষ সুখী হোক— তারপরও নিতান্তই বাধ্য হয়ে দশ-চক্রের ফেরে তিনি দুটি কথা না হয় বলেছেন—এটুকু না বললে চলে না। দল নেই, জন নেই, কর্মী নেই— তালপাতার সেপাই হয়ে দিব্যি একটা মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন—ওই মন্ত্রীর তখত্খানা রক্ষা করতে ওরকম একটু না বললে চলে না। কখন আবার চেয়ারখানা মহাজোট নেত্রী জব্দ করেন—সেই টেনশনে কিছু তেল সব সময় ঠোঁটের আগায় সবাইকে রিজার্ভ রাখতে হয়। সবাই রাখেও। দেশে কে এমন প্রতাপশালী আছেন- দুই নেত্রীকে তেল দিয়ে চলেন না- শুধু দিলীপদা দিলেই দোষ!

সুত্রঃ আমার দেশ
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×