somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাল হাদীসঃ ইসলাম ও ঈমানের নিঃশব্দ ঘাতক

১১ ই মে, ২০১২ রাত ১২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোটবেলায় একটা হাদীস আমাদের স্যাররা খুব বলতেন, “বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র”। সম্ভবত স্কুলের কোথাও এ হাদীসটি লেখাও ছিলো (এখনও অনেক স্কুলে আছে)। আমরা সবাই ছোটবেলায় ভাবতাম কি সৌভাগ্যবান সে সকল বিদ্বানেরা, যাদের কলমের সামান্য চালনা সে ব্যক্তির ত্যাগকে ম্লান করে দেয়, যে নিজের জীবনকে আল্লাহর জন্য বিলিয়ে দিয়েছে। তবে মনের মধ্যে ছোট্ট একটি খটকা কখনও কখনও দানা বাঁধতো যে, যে লোকটা আল্লাহর পথে নিজের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ বিকিয়ে দিলো, সে এতো বোকা কেন? সে যদি বিদ্বান হয়ে যেত তাহলে তো তার মর্যাদা আরো অনেক বেড়ে যেত।

ধীরে ধীরে এই হাদীসটি নিয়ে আমার খটকা বাড়তে লাগলো যখন দেখলাম বিদ্বান হিসাবে এ সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং আমাদের শিক্ষকগণ যাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তাদের নাম হলো শামসুর রাহমান, সুফিয়া কামাল, শওকত ওসমান, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, আহমদ শরীফ, হুমায়ুন আহমেদ প্রমুখ, যাদের কেউ রবীন্দ্র সঙ্গীতকে কুরআনের চেয়ে মধুর বলেছেন, কেউ আজানের ডাককে বেলেল্লা বেশ্যার ডাকের সাথে তুলনা করেছেন, কেউ আল্লাহ আর তাঁর রাসুলকে সরাসরি অস্বীকার করেছেন, কেউবা আল্লাহ আর তাঁর রাসুলকে হেয় করে কিছু বলাকে নিজের স্মার্টনেস আর উন্নত রুচির প্যারামিটার বানিয়ে নিয়েছেন। একসময় দেখলাম আল্লাহ কুরআনে শহীদদের মর্যাদাকে সর্বোচ্চ বলেছেন, তখনও ভেবেছি রাসুলের এই হাদীসের অন্য ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে, যেহেতু তিনি যা বলতেন তা আল্লাহ থেকে পাওয়া ওহীর মাধ্যমেই বলতেন। তাই একদিন যখন জানতে পারলাম “বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র” এটি একটি নির্জলা মিথ্যা কথা যা রাসুলের নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে, তখন আকাশ থেকে পড়েছিলাম আর ভেবেছিলাম- হাদীসও জাল হয়? আল্লাহু আকবর, এ তো ভয়ংকর ব্যাপার।

ধীরে ধীরে জাল হাদীসের কিছু স্বরূপ আল্লাহর করুণায় জানতে পারলাম আর আশ্চর্য হলাম এই ভেবে যে, জীবনে যা হাদীস হিসাবে লোকমুখে শুনে এসেছি তার বড় একটা সংখ্যাই জাল হাদীস বা রাসুলের নামে মিথ্যাচার।

জাল হাদীসের বিস্তার লাভ সাহাবাদের সময় প্রায় হতেই পারেনি, কেননা তাঁরা কোন হাদীস শুনলে তার সাক্ষী হাজির না করে গ্রহণ করতেন না। উমার বিন খাত্তাব যখন খলিফা তখন বিখ্যাত সাহাবা উবাই বিন কা’ব তাঁকে রাসুলুল্লাহ সাঃ এর একটি হাদীস শুনান। উবাই এর চরিত্র ও আমানতদারী ছিলো সমস্ত উম্মাহর কাছে প্রশ্নাতীত, তবুও উমার ওই হাদীসটি শুনে উবাইকে বললেন, “তুমি যে কথাটি রাসুলুল্লাহ সাঃ থেকে শুনেছো তার সাক্ষী নিয়ে এসো, নইলে আমি তোমাকে ভীষণ শাস্তি দেব”। আল্লাহর কৃপায় উবাই সাক্ষী পেয়ে গেলেন এবং উমারের কাছে এনে সাক্ষ্য দেয়ালেন। উমার তারপর হাদীসটি গ্রহণ করলেন। হাদীস জাল হওয়া মূলতঃ শুরু হয় সাহাবাদের পরের তাবেয়ীদের সময় থেকে যার ভয়াবহ রূপ দেখা যায় কুফা নগরীতে। আবু বকর, উমার, উসমানকে হেয় করার জন্য শিয়ারা তাদের বিরুদ্ধে জাল হাদীস তৈরী করল, আবার কট্টর কিছু সুন্নী আবু বকরদের অতিরিক্ত মর্যাদা প্রকাশ করে শিয়াদের বিপরীত জাল হাদীস বানালো। কিছু চক্রান্তকারী নগন্য কাজের বিনিময়ে অবিশ্বাস্য ফজিলত বর্ণনা করে মানুষকে দীনের প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হলো। এক সময় এমন অবস্থা দাঁড়ালো যে, মানুষ নিজের সামান্য পার্থিব লাভের জন্য রাসুলের নাম দিয়ে মিথ্যাচার শুরু করলো। যেমন, কেউ হয়তো বাজারে বেগুন বিক্রি করতে গিয়েছে কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত দেঝা গেলো তার বেগুন সামান্যই বিক্রি হয়েছে। সে তখন চীৎকার করে মানুষকে ডেকে বলল, “শোন সবাই, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন-বেগুনে আছে সব রোগের শিফা”, ব্যস অমনি তার বেগুন সব বিক্রি হয়ে গেলো।

হাদীস সংকলন মূলতঃ শুরু হয়েছে রাসুলুল্লাহ সাঃ এর মৃত্যুর প্রায় দু'শ বছর পর থেকে। যখন থেকে হাদীস সংকলন শুরু হয়েছে ততদিনে লক্ষ লক্ষ জাল হাদীস মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে, কোন হাদীস সত্য আর কোনটা জাল তা আলাদা করাও মুশকিল হয়ে পড়লো। এহেন অবস্থায় হাদীস সংকলনকারী প্রখ্যাত মুহাদ্দীসগন বিশুদ্ধতার নানা মানদন্ড নির্ধারণ করলেন এবং তা ব্যবহার করে হাদীস সংকলনের কাজ করতে লাগলেন। তবে ইতিমধ্যেই অনেক জাল হাদীস সম্বলিত কিতাবও ছড়িয়ে পড়েছিলো। এহেন অবস্থায় ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম মানব ইতিহাসে কারো কথা বা কাজের বর্ণানার সবচেয়ে বিশুদ্ধতম উপায় উদ্ভাবন করে রাসুলুল্লাহ সাঃ এর হাদীস লিপিবদ্ধ করতে সক্ষম হন, এমনকি নন মুসলিম গবেষকদেরও যার বিশুদ্ধতা নিয়ে সন্দেহ নেই। এক ইমাম বুখারীর সাড়ে ছয় লক্ষ হাদীস মুখস্থ ছিলো যার মধ্যে মাত্র সাড়ে ছয় হাজার তিনি তাঁর সম্পাদিত হাদীস গ্রন্থ ‘সহীহ বুখারী’ তে সংকলন করেছেন।

জাল হাদীস এমনই ভয়াবহ একটি ফিতনা যে, এটি ইসলামের বিশুদ্ধতাকে মানুষের কাছে পৌঁছাতে না দিয়ে মানুষকে গোমরাহীর অতল গহবরে নিক্ষেপ করে। একটি জাল হাদীস মানুষ যখন আমল করে তখন একটি সত্য হাদীসকে তাকে বাদ দিতে নয়, যার ফলে জাল হাদীস আমল করলে সুন্নত প্রতিষ্ঠা না হয়ে বিদ’আত (ইসলামে নতুন আবিষ্কৃত বিষয়) প্রতিষ্ঠিত হয় যার পরিণতি হলো জাহান্নাম। হাদীস জানা বা মান্র ক্ষেত্রে তার সত্যতা ও তার সূত্র জানা অত্যন্ত জরুরী এ কারণে যে, রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমার উপর মিথ্যা আরোপ করল, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে খুঁজে নেয়”। (বুখারী, মুসলিম)।

সুতরাং আমাদের মনে রাখতে হবে, নিশ্চিত না হয়ে রাসুল সাঃ এর নামে কোন হাদীস বলা বা জাল হাদীস প্রচার বা আমল করার পরিণতি জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নয়।

আল্লাহ আমাদের জাল হাদীসের ফিতনা থেকে আশ্রয় দিন এবং হাদীসের বিশুদ্ধতা জেনে তা মেনে চলার সুযোগ দিন।

পরিশিষ্ট-১


বাংলাদেশে প্রচলিত আরো কিছু জাল হাদীস-

• দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ
• যার পীর নেই তার পীর শয়তান
• জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীনে হলেও যাও
• মুহাম্মাদ সাঃ কে সৃষ্টি না করলে আমি দুনিয়া সৃষ্টি করতাম না
• পাগড়ি পরে নামাজ পড়লে ৭০ গুন বেশী সওয়াব
• সর্বপ্রথম মুহাম্মাদ সাঃ এর নূরকে তৈরী করা হয়েছে

পরিশিষ্ট-২
জাল হাদীস সম্পর্কে জানার জন্য পড়ুন-

• জাল হাদীসের ইতিবৃত্তঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
• জয়ীফ ও জাল হাদীসের সংকলনঃ নাসিরুদ্দিন আলবানী
• প্রচলিত জাল হাদীস
৬টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গাজার যুদ্ধ কতদিন চলবে?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্যামুয়েল ব্যাকেট এর ‘এন্ডগেম’ | Endgame By Samuel Beckett নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা

লিখেছেন জাহিদ অনিক, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৮



এন্ডগেম/ইন্ডগেইম/এন্ডগেইম- যে নামেই ডাকা হোক না কেনও, মূলত একটাই নাটক স্যামুয়েল ব্যাকেটের Endgame. একদম আক্ষরিক অনুবাদ করলে বাংলা অর্থ হয়- শেষ খেলা। এটি একটা এক অঙ্কের নাটক; অর্থাৎ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামে ভুল থাকলে মেজাজ ঠিক থাকে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৫


বেইলি রোডে এক রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে একজন একটা পোস্ট দিয়েছিলেন; পোস্টের শিরোনামঃ চুরান্ত অব্যবস্থাপনার কারনে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডকে দূর্ঘটনা বলা যায় না। ভালোভাবে দেখুন চারটা বানান ভুল। যিনি পোস্ট দিয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×