বাংলাদেশপক্ষের অদূরদর্শী কূটনীতিরই পরিচায়ক
ভারত সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী কিংবা কূটনীতিকদের কাছ থেকে বাংলাদেশের মানুষ একটি কথা দীর্ঘ দিন থেকে বারবার শুনে আসছে। ভারত বলে আসছেÑ বাংলাদেশের ক্ষতি করে এমন কিছুই ভারত সরকার করবে না এবং বাংলাদেশকে দেয়া সব অঙ্গীকারই ভারত পূরণ করবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এর সম্পূর্ণ উল্টো। সেই ফারাক্কা বাঁধ মাত্র কয়েক মাসের জন্য পরীক্ষামূলক চালু করে, তা আর কোনো দিন বন্ধ না করে ভারত বাংলাদেশকে পানিতে মারার, ভাতে মারার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল তা আজো অব্যাহত রয়েছে। ভারত তার ১৮টি নদীর মধ্যে আন্তঃসংযোগ খাল সৃষ্টি করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর পানি প্রত্যাহার কিংবা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে। ভারতের কোনো কোনো রাজ্যের সেচ প্রকল্প ও পানির অন্যান্য চাহিদা মেটানোর যে মহাপরিকল্পনা, তাও এ প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। ভারতের এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ যে প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়বে এবং এর ফলে যে বাংলাদেশে বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের ক্ষতির কথা বাদ দিলেও কার্যত এই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ভারতের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে, সেখানে সৃষ্টি করবে নানা ধরনের পানি ও পারিবেশিক সমস্যাÑ ভারতের বিভিন্ন মহল তা এখন খোলাখুলিই উচ্চারণ করছে। যদিও ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারত সরকারকে বাধ্য করতে এক রায় জারি করেছেন। সে যা-ই হোক, ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে আমাদের বঞ্চিত করছে অনেকটা একগুঁয়েমি মনোভাব প্রদর্শন করে। সর্বশেষ তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতেও গড়িমসি করছে। কথা দিয়েও ভারত এ চুক্তি সম্পাদন করছে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের চাহিদা না মিটিয়ে বাংলাদেশকে তিস্তার এক ফোঁটা পানিও দেবেন না বলে খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছেন।
ভারত বাংলাদেশকে কোনো কিছু দিতে যত নেতিবাচক অবস্থানেই থাকুক, আমরা কিন্তু ভারতকে সব কিছু দিতে দাতা হাতেমের ভূমিকা পালন করে চলেছি বরাবর। সর্বশেষ খবর হচ্ছে, ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মতানৈক্যের কারণে তিস্তার পানিবণ্টনে অগ্রগতি না হলেও ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্টে সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। সম্প্রতি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ সরকার নদী, রেল ও সড়কপথে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য আনা-নেয়ার প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা জরুরি ভিত্তিতে সম্পন্ন করতে রাজি হয়েছে। উৎস দেশ ভারতের সহায়তায় আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিডি) নির্মাণ এবং আশুগঞ্জ নদীবন্দরের মাধ্যমে ট্রানশিপমেন্ট শুরু করতেও রাজি রয়েছে। এ ছাড়া যাত্রী ও পণ্যবাহী মালামাল চলার জন্য দুই দেশ দ্রুততার সাথে মোটর ভেহিক্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট চূড়ান্ত করতেও একমত হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত উন্নয়ন সহযোগিতা রূপরেখা চুক্তি বাস্তবায়নে গত সোমবার দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশনের (জেসিসি) প্রথম বৈঠক শেষে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় এ রূপরেখা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
উল্লেখ্য, মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে ‘তিস্তা না হলে ট্রানজিট নয়’Ñ এমনই অবস্থানে অটল ছিল বাংলাদেশ সরকার। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির মুখে তিস্তাচুক্তি স্বাক্ষরে দিল্লি অপারগতা প্রকাশ করলে বাংলাদেশ সরকার পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে সম্মতিপত্রে সই করা থেকে বিরত থাকে।
আমরা বারবার বলে আসছি, ট্রানজিটের বিষয়টিকে তিস্তাচুক্তির সইয়ের ব্যাপারে একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। কিন্তু ট্রানজিট দেয়া বা না দেয়ার বিষয়টির সাথে তিস্তাচুক্তি সইয়ের বিষয়টিকে এক করে দেখা যাবে না। কারণ, তিস্তার পানি আমাদের অধিকার, আর ট্রানজিট দেয়া-না-দেয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করে বাংলাদেশের ওপর। ট্রানজিট দেয়ার ফলে বাংলাদেশের যদি কোনো সমস্যা না হয় এবং অর্থনৈতিকভাবে আমরা লাভবান হই, তবেই ট্রানজিটের ব্যাপারে বাংলাদেশ সম্মত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ তিস্তাচুক্তি না করে ট্রানজিটে সম্মতি দেয়ায় সে কৌশলটিও আমরা হাতছাড়া করলাম। মোট কথা, ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় বিষয়াবলি নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছতে আমরা বারবার কূটনৈতিকভাবে কৌশলী হতে ব্যর্থ হচ্ছি, আর এতে করে বাংলাদেশকে আমরা কার্যত দুর্বল অবস্থানেই ঠেলে দিচ্ছি।
সংগৃহীত----
সৌজন্যে------নয়াদিগন্ত