somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্তর বিক্রমপুরের ইতিহাস

০৭ ই মে, ২০১২ সকাল ৯:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ইতিহাস-সচেতন পড়ুয়া বাঙালির ব্যক্তিগত পাঠাগারে বাংলার ইতিহাসের যে বইটি অনিবার্য, সেই বইটি হল শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্তর বিক্রমপুরের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসের ওপর, গত দেড়শ বছরে, যতগুলি বই লেখা হয়েছে সার্বিক বিচারে শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্তর বিক্রমপুরের ইতিহাস তার অন্যতম। বইটির নাম বিক্রমপুরের ইতিহাস হলেও বইটিতে ‘প্রাচীন বৈদিক যুগ হইতে মুসলমান বিজয় পর্যন্ত’ বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। কাজেই এটি বাংলার ইতিহাসের ওপর একটি পূর্নাঙ্গ বই। তবে ঐতিহাসিক আলোচনা বিক্রমপুর কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে; যে কারণে বইটি আঞ্চলিক ইতিহাস হয়েও হয়ে উঠেছে বৃহৎ বাংলার মনোজ্ঞ ইতিহাস ।
বিক্রমপুরের ইতিহাস এর লেখক শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত সম্বন্ধে প্রথম কথাই হল তিনি একজন সুলেখক। তাঁর ভাষা ঝরঝরে। একজন উঁচুদরের সাহিত্যিক ইতিহাসের বই লিখলে কি রকম দাঁড়ায়-তারই অনন্য নজীর হয়ে রয়েছে বিক্রমপুরের ইতিহাস। লেখক বইটি যদিও তৎকালীন রীতি অনুযায়ী সাধু ভাষায় লিখেছেন, তথাপি কোথাও বিন্দুমাত্র আড়ষ্ঠতা নেই, পড়তে গেলে কোথাও আটকে যেতে হয় না। উদাহরণ দিই। বইটি লেখার কৈফিয়ৎ হিসেবে শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখেছেন: ‘সোনার শৈশবে মা ও দিদিমার মুখে যখন রামপালের কাহিনী শুনিতাম, সে গজারী বৃক্ষের কথা, রামপাল দীঘির কথা, বল্লাল রাজার যুদ্ধ, রানীদের অগ্নিকুন্ডে আত্মবিসর্জন, কেদার রায়ের জীবনোৎসর্গ; সে কাহিনী শুনিতে শুনিতে আত্মহারা হইয়া যাইতাম, আরও শুনিতে সাধ হইত, কিন্তু তাঁহারা আমার সেই সাধ পূর্ণ করিতে পারিতেন না, সেই শৈশবেই বিক্রমপুরের অতীত গৌরবের পূণ্য ইতিহাস আমার হৃদয়ে গাঢ়রূপে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। তারপর বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সে সুপ্ত বাসনা জাগরিত হইয়া আমাকে দেশের ইতিহাস রচনায় উদ্বুদ্ধ করে, তাহারি ফলে সাত-আট বৎসরের পরিশ্রমের পর নানা বাধা বিঘ্ন ও শোক-ঝঞ্ছার ভিতর দিয়া এতদিনে বিক্রমপুরের ইতিহাস জনসাধারণের নিকট উপস্থিত করিতে সক্ষম হইয়াছি।’ (প্রথম সংস্করণে গ্রন্থকারের নিবেদন। )
কি ঝরঝরে ভাষা! কাজেই বাংলাদেশের ইতিহাস জানার জন্য ৩৭৭ পৃষ্ঠার বইটি হাতে তুলে নিতে তরুণপ্রজন্মের তো দ্বিধা হওয়ার কথা না। সাধু ভাষায় লেখা ৩৭৭ পৃষ্ঠার একটি বই পড়া কি এমন কষ্ট! বইটি লেখার সময়, বইটির মাল মসলা সংগ্রহ করার সময় ঐতিহাসিক শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত অনেক কষ্ট করেছেন। রোদ-জল-বৃষ্টিতে ভিজে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভের বিক্রমপুরের গ্রামেগঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছেন, চোখে একটি ইতিহাস বই লেখার স্বপ্ন । এ প্রসঙ্গে শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখেছেন, ‘১৯১০ খৃষ্টাব্দে ‘বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি’ গঠিত হয়। দীঘাপাতিয়ার কুমার শ্রীযুক্ত শরৎকুমার রায় উহার প্রতিষ্ঠা করেন। বলা বাহুল্য যে ঐ সমিতির প্রতিষ্ঠার বহু পূর্ব হইতেই আমি বিক্রমপুরের গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হই।’ লেখক সে সময় বয়সে তরুণ। এবং সেই ভাগ্যবান তরুণটি ইতিহাস চর্চায় পরিবার থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন,‘আমার পিতা ও মাতা দুই জনেই ‘বিক্রমপুরের ইতিহাস’ প্রকাশ সর্ম্পকে একান্ত উৎসাহী ছিলেন। আমার সাহিত্যানুরাগ, আমার জনক-জননীর স্নেহে ও উৎসাহেই পরিবর্ধিত হইয়াছিল।’
সবচে আশ্চর্য এই যে ... ঐতিহাসিক শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ‘বিক্রমপুরের ইতিহাস’ বইটি লেখার একখানি আবেগপূর্ণ, কাব্যিক এবং ঐশ্বরিক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, যাতে তাঁর অনন্য এক মাতৃভক্তি প্রকাশ পেয়েছে। তিনি লিখেছেন: ‘আমার ন্যায় ক্ষুদ্র ব্যক্তির পক্ষে বিক্রমপুরের ন্যায় প্রাচীন ও ইতিহাস-বিখ্যাত প্রসিদ্ধ স্থানের ইতিহাস রচনা করিতে যাওয়া যে ধৃষ্টতা, তাহা বুঝিয়াও যে কেন আমি এমন গুরুতর কার্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম, তাহার উত্তর দিতে আমি অক্ষম। ছেলে মাকে ভালোবাসে, মায়ের কথা শুনিতে ও বলিতে তাহার ভালো লাগে, তার শৈশব-সুলভ সরলতাপূর্ণ বাক্য -বিন্যাসে সে মায়ের কতই না গুণ বর্ণনা করে এবং তাহাতেই তাহার তৃপ্তি হয় ; তেমনি আমার মাতৃভূমির প্রতি তরু, প্রতি লতা, প্রতি মসজিদ, প্রতি মঠ, প্রতি দেবালয়, ও প্রতি মৃত্তিকাকণার মধ্য হইতে বিশ্বজননীর যে চেতনাময় আহ্বান আমাকে তাঁহারি গুণ গানে হৃদয়ে প্রেরণা জাগাইয়া দিয়াছিল-ইহা কেবল তাহারি বিকাশ।’
এর আগেও একবার বলেছি যে বইটির নাম বিক্রমপুরের ইতিহাস হলেও বইটিতে ‘প্রাচীন বৈদিক যুগ হইতে মুসলমান বিজয় পর্যন্ত’ আলোচনা করা হয়েছে। নয়টি অধ্যায়ে লেখক তাঁর সময়কালে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ঐতিহাসিক আলোচনা করেছেন । পরবর্তীকালে বাঙালি ঐতিহাসিকগণ অনেক তথ্যই পুনমূল্যায়ন করেছেন, তা সত্ত্বেও বইটি আজও অম্লান। বইটির প্রথম অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় ‘বঙ্গদেশ ও বিক্রমপুর’; দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক আলোচনার বিষয় ‘প্রকৃতি-পরিচয়’; তৃতীয় অধ্যায়ের বিষয় ‘জনসংখ্যা জাতি ও ধর্ম’; চতুর্থ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয় ‘প্রাচীন ইতিহাস’; পঞ্চম অধ্যায়ে লেখক মূল আলোচনায় প্রবেশ করেছেন। কেননা, এ অধ্যায়ের আলোচনার বিষয় ‘স্বাধীন বঙ্গরাজ্য -রাজধানী শ্রীবিক্রমপুর;‘ষষ্ঠ অধ্যায়ে লেখক আরও গভীরে প্রবেশ করেছেন। এ অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়: ‘বিক্রমপুরের স্বাধীন বর্মরাজাগণ-রাজধানী শ্রীবিক্রমপুর’। সপ্তম অধ্যায়ে সেনরাজাদের নিয়ে আলোচনা করেছেন ‘স্বাধীন সেনরাজবংশ -বিজয়সেন -বিক্রমপুর’ শিরোনামে। অষ্টম অধ্যায়টি অনেকের কাছেই চিত্তাকর্ষক ঠেকবে। কেননা, এই অধ্যায়ের আলোচনার বিষয়: ‘সেন রাজত্বের শেষ যুগ - মুসলমান-বিজয়’; নবম অর্থাৎ সবশেষ অধ্যায়ের শিরোনাম: ‘রাজধানী শ্রীবিক্রমপুর -রামপাল’।
ঐতিহাসিক শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত গভীর প্রজ্ঞায় এবং সুললিত ভাষায় বাংলার প্রাচীন ইতিহাস জীবন্ত করে তুলেছেন বলেই তাঁর রচিত ‘বিক্রমপুরের ইতিহাস’ বইটি বাঙালি পাঠকসমাজে একটি আকর গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। উপরোন্ত, দুটি মানচিত্র এবং তিরিশটি চিত্র বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে।
আরও একটি আশ্চর্যের বিষয় এই যে ... ঐতিহাসিক শ্রীযোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত বাংলার ইতিহাস কে ‘পূণ্য ইতিহাস’ আখ্যা দিয়েছেন। প্রথম সংস্করণের উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন: ‘মাতৃভূমির এ -পূণ্য ইতিহাস উৎসৃষ্ট করিয়া কৃতার্থ হইলাম।’ ‘বিক্রমপুরের ইতিহাস’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩১৬ অর্থাৎ ১৯০৯ সালে । বইটির দ্বিতীয় সংস্করন বেরিয়েছিল ১৯৩৯ সালের অক্টোবর মাসে। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশি প্রকাশনা সংস্থা ঘাস ফুল নদী ‘বিক্রমপুরের ইতিহাস’ বইটি প্রথম প্রকাশের সুদীর্ঘ নব্বই বছর পর পুনঃপ্রকাশ করেছে । অফসেট কাগজে ছাপানো ঝকঝকে অক্ষরের ৩৭৭ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ২৭৫ টাকা।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১২ সকাল ৯:৩৩
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×