somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: মিশন তক্ষক

০৩ রা মে, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভর সন্ধ্যেবেলায় গাছে চড়েছ বেশ ভালো কথা। কিন্তু টুঁ শব্দটি করো না বাছা। চুপ করে বসে থাক।
অন্ধকারে গাছের মগডাল থেকে গমগমে গলায় কে যেন বলল। ছোটন ভারি অবাক হয়ে যায়। কন্ঠস্বর মাঝবয়েসি কোনও লোকের বলেই মনে হল ওর। ও থতমত খেয়ে বলল, ক্বে ... কে আপনি?
কে আমি? না?
হ্যাঁ।
কেন তুমি তেওড়াপাড়ায় থাক না বুঝি ?
থাকি তো।
তাহলে? তাহলে তুমি রজব দারোগার নাম কখনো শোনোনি ?
ও। আপনিই রজব দারোগা? ছোটন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে। আরও বলে, আব্বার কাছে আপনার কথা শুনেছি। কিন্তু, আপনি এই সন্ধ্যেবেলায় গাছে চড়ে কি করছেন?
বলব। কিন্তু তার আগে বল তোমার বাবার নাম কি?
আমার বাবার নাম লতিফ মাস্টার।
ও, তুমি তেওড়াপাড়া হাইস্কুলের লতিফ মাস্টারের ছেলে?
হ্যাঁ।
বেশ। বেশ। আমি তোমার বাবাকে চিনি। বেশ ভালো মানুষ। খুশিতে ডগোমগো হয়ে বললেন রজব দারোগা।
কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন? রজব দারোগাকে ভর সন্ধ্যাবেলায় গাছের ওপর দেখে ছোটন কৌতূহল বোধ করে।
রজব দারোগা ফিসফিস করে বললেন, আমি চারিদিকে জাল ছড়িয়ে রেখেছি। এখন ওঁত পেতে আছি। জান তো, আজকাল তেওড়াপাড়ায় বড্ড গরু চুরি যাচ্ছে। আমার আবার খুঁটিমারীর বদুচোরকে কেমন সন্দ হয়। ওই যে দেখ, হ্যাঁ হ্যাঁ ... নীচে নীচে ... নীচে একখানা নধর গরু বেঁধে রেখেছি। এখন যদি বদু ব্যাটা আসে, তাহলেই সেরেছে। তাই বলছি টুঁ শব্দটি করো না বাছা। চুপ করে বসে থাক।
ছোটন নীচে তাকিয়ে দেখল ম্লান জ্যোস্নার আলোয় মাঠের কোণে একটি বাছুরসাইজের হাড় জিরজিরে গরু খুঁটির সঙ্গে বাঁধা। বেচারা 'হাম্বা' 'হাম্বা' করে ডাকছে। ওপাশে একটা পানাপুকুর। পানাপুকুরের পাড়ে ঘন কচুবন।ঝুপসি আঁধারে তারস্বরে ঝিঁঝি ডাকছিল।
রজব দারোগা ভোল পালটে এবার কঠিন হুঙ্কার ছাড়লেন, অ্যাই, ছেলে!
ছোটন কাঁপতে কাঁপতে বলল, জ্বী, জ্বী। স্যার।
তুমি এই ভর সন্ধেবেলায় লেখাপাড়া শিকেয় তুলে এই গাছের ওপর কি করছ?
জ্বী মানে, স্যার। খুঁটিমারীর বদমাশ শহীদুল আমার ঘুড়ি কেটে দিয়েছে, আমি কাটা-ঘুড়ির পিছন পিছন দৌড়ে দৌড়ে এখানে এসেছি। ওই ... ওই যে দেখুন স্যার আপনার মাথার ওপরে গাছের মগডালে আমার ঘুড়ি দোল খাচ্ছে।
ও, এই কেস। আচ্ছা। এই নাও তোমার ঘুড়ি। যাও বাছা । এখন গাছ থেকে নেমে পর । নইলে আমার গরুচোর বদু-মিশন ভেস্তে যাবে। তুমি ভালো মানুষের ছেলে। এসব চোরছ্যাঁচোড় ধরাধরির মধ্যে তোমার থাকার দরকার নেই বাপু।
ছোটন ঘুড়িটা নিয়েই সেদিন সুড়সুড় করে গাছ থেকে নেমে পড়েছিল।
তেওড়াপাড়া গ্রামের রজব দারোগার সঙ্গে ওর প্রথম মোলাকাত এভাবেই হয়েছিল। পরেও দূর থেকে রজব দারোগা কে অনেকবারই দেখেছে। বেশ মজার মানুষ রজব দারোগা । গায়ের রং ধবধবে ফরসা। মাথায় পাকা বেলের মতন একখানা টাক। মুখটি গোলপানা। সে মুখ সব সময় মসৃণ ভাবে কামানোই থাকে। নাকটি খ্যাদা, সেই খ্যাদা নাকের নীচে একখানা টুকরো ঘন কালো হিটলারি গোঁফ। উচ্চতায় রজব দারোগা কে বেঁটেই বলা যায়। শরীরের গড়নটি বেশ নাদুসনুদুস। ভুঁড়িটিও ভারি দৃষ্টি নন্দন। দেখে কোনও বিলাসী রাজার আমুদে মন্ত্রী বলেই মনে হয় ।
তেওড়াপাড়ায় মাস দুয়েক হল বদলী হয়ে এসেছেন রজব দারোগা । বাবার মুখে শুনেছে ছোটন, রজব দারোগা নাকি বেজায় কাজ=পাগল মানুষ। ছদ্মবেশ ধারণ করে রাতদিন হন্যে হয়ে চোরছ্যাঁচোড়ের পিছু পিছু ঘুরে বেড়ান । চোরবাটপার ধরাই রজব দারোগার একমাত্র নেশা। এবং পেশা।
তো, ছোটনও যে রজব দারোগার সঙ্গে অচিরেই এক গোপন মিশনে জড়িয়ে পড়বে তখন কে জানত ...

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল ছোটন। চারপাশে বিকেলের ম্লান আলো ছড়িয়ে ছিল। ছোটনের মন সামান্য বিষন্ন হয়েছিল। মনির আজও স্কুলে আসেনি। কি হল ওর। মনির ছোটনের সহপাঠী। প্রিয় বন্ধু। পূবপাড়ায় থাকে মনিররা, ওর বাবা বর্গা চাষী। বড় গরীব তারা। ওর বাবা মনিরকে পড়া ছাড়িয়ে দেয়নি তো? এই ভাবনায় কাতর হয়ে ওঠে ছোটন।
ছোটন হাঁটতে হাঁটতে আমবন, মির্দাবাড়ি, বাঁশবাগান, তেঁতুলতলা পেরিয়ে তেজলার খালের কাছে পৌঁছে গেল। সেই খালের ধারে একটা ঝাঁকড়া পাকুড় গাছ। সেই পাকুড় গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ছিল মনির। ছোটন তরতর করে এগিয়ে যায়। মনিরের কাঁধে হাত দিয়ে বলে, এখানে কি করছিস রে মনির?
মনির চমকে উঠে। তারপর ছোটনকে দেখে আশস্ত হল। বলল, তক্কে খুঁজতেছি।
তক্কে মানে তক্ষক? তা তক্ষক দিয়ে তুই কি করবি?
ধইরা একজনকে দিব। সে আমারে টাকা দিব।
টানা দিবে? কেন? কে তোকে টাকা দিবে?
মনির এদিক ওদিক চেয়ে বলল, কথাডা তুই কাউরে বলিস না ছোটন। লোকডার নাম কইল লোকমান।
কই থাকে?
জানি না। তয় তক্কে ধইরা আমি খানবাড়ির কিল্লার ফটকের কাছে গিয়া দিয়া আসি। লোকমানে আমার জন্য সেইখানে খাঁড়ায় থাকে।
আশ্চর্য! ছোটন অবাক হয়ে যায়। একটা তক্ষক ধরে দিলে তোকে কত দেয় লোকটা?
পাঁচশো টাকা।
বলিস কী! পাঁচশো টাকা! ও, এই জন্য তুই স্কুলে যাচ্ছিস না? সারাদিন তক্ষকের পিছনে ঘুরে বেড়াস?
মনির চুপ করে থাকে। মুখ তুলে পাকুড় গাছের দিকে তাকায়। কি যেন খোঁজে। তক্ষক সম্ভবত। ছোটন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনির গরীব ঘরের ছেলে। তক্ষক প্রতি পাঁচশো টাকা করে পায়। কম না। সহজে ওকে স্কুলে ফেরানো যাবে না। অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
ওদিকে আকাশে মেঘ জমছিল। অন্ধকার জমে উঠছিল। হাওয়া অশান্ত হয়ে উঠছিল। ছোটন বাড়ি ফিরে আসে।

রাতে বিছানায় শুয়ে ছোটনের ঘুম আসছিল না। ছটফট করছিল ও। তেওড়াপাড়া গ্রামের খানবাড়ি কেল্লাটি অনেক দিনের পুরনো। উঁচু প্রাচীরঘেরা ভাঙাচোরা কেল্লাবাড়ির ইট খসে পড়েছে। কেল্লাটা ঘিরে এ অঞ্চলে নানা কথা রটেছে। কেবল গাঁয়ের লোক কেন- কাকপক্ষীও নাকি দিনে দুপুরেও ওদিকে যায় না। মনির যা বলল তাতে মনে হচ্ছে খানবাড়ি কেল্লায় লোকজন থাকে। তারা তক্ষক কেনে। কিন্তু, কেন ?
ছোটন বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। বাড়িটা কেমন শুনশান করছে। দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে আসে ও। উঠানে ম্লান জ্যোস্নার আলো ছড়িয়ে ছিল। ছোটন হাঁটতে হাঁটতে তেঁতুলতলা, মালোপাড়া, মল্লিকদের বাঁশবাগান, নাটমন্দির, রথখোলা, রতনদিঘীর দক্ষিণ পাড়, আর পুরনো কবরস্থান পেড়িয়ে ধোপার খালের পাশ দিয়ে খানবাড়ি কেল্লার জঙ্গলের কাছাকাছি চলে এল। জঙ্গলে প্রচন্ড জোরে ঝিঁঝি ডাকছিল। সুগন্ধা নদীর দিক থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছিল। সুরুৎ করে কী যেন ওপাশে ঝোপের আড়ালে মিলিয়ে গেল। সরসর শব্দে গাছ থেকে কী একটা নেমে ছুটে পালাল। ছোটনের পিলে চমকে ওঠে। তবু ও এগিয়ে চলে ও। মনিরকে যে করেই হোক স্কুলের ক্লাসে ফেরাতে হবে ।সেই সঙ্গে ভেদ করতে হবে খানবাড়ির কেল্লার রহস্য।
পুরো কেল্লাটাই উঁচু প্রাচীরে ঘেরা। পুরো এলাকা একবার চক্কর মেরে দেখল ছোটন। খানবাড়ি কেল্লায় যারা এসেছে তারা মূল প্রবেশপথে লোহার নতুন ফটক তুলেছে। ওদিক দিয়ে ভিতরে ঢোকার উপায় নেই। দেয়াল ঘেঁষে একটা মস্ত জলপাই গাছ। ছোটনের মতন একজন ওস্তাদ গাছে চড়িয়ের তরতর করে সে গাছে চড়ে বসতে সময় লাগল না মোটেও। গাছে চড়ে বসতেই অন্ধকারে গমগমে কন্ঠস্বর ভেসে এল- মধ্যরাতে গাছে চড়েছ বেশ ভালো কথা। কিন্তু টুঁ শব্দটি করো না বাছা। চুপ করে বসে থাক।
কন্ঠস্বর পূর্ব-পরিচিত। ছোটন অবাক হল না। ফিসফিস করে বলল, আপনি এখানে?
উত্তর এল-রজব দারোগাকে ফালতু প্রশ্ন করো না বাছা। তুমি এত রাতে কেন এসেছ আগে সেইটে বল?
ছোটন ছোট্ট শ্বাস ফেলল। তারপর বলল, আজ আমি জানতে পেরেছি ওই কেল্লায় কারা যেন থাকে। যারা থাকে তাদের আমার সন্দেহজনক মনে হল।
কেন? তাদের তোমার সন্দেহজনক মনে হল কেন?
তারা আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে তক্ষক কিনছে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও ঘোরতর সন্দেহের ব্যাপার রয়েছে।
হুমম। তুমি সঠিক লাইনেই আছ বাছা । তুমিও মিশন তক্ষক এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছ।
মিশন তক্ষক?
হ্যাঁ। মিশন তক্ষক।
ছোটন বলল, আমি বুঝতে পারলাম না স্যার।
মিশনের শুরুতে সব বোঝা যায় না বাপু। তবে খানবাড়ি কেল্লার ওপর আমার জালও পাতা আছে।
ছোটন অবাক হয়ে বলল, বলেন কি স্যার! অত বড় জাল তেওড়াপাড়া থানায় আছে? কিসের জাল স্যার? দড়ি না নাইলনের?
ছেলে বলছে কি শোন। আচ্ছা, তুমি বাপু এ লাইনে নতুন। প্রথম প্রথম তোমার ভুলচুক হতেই পারে। এখন তুমি প্রাচীরের ওপাশে টুক করে নেমে সরেজমিনে সব দেখে এসে গে যাও। দেখে এসে আমার কাছে রিপোর্ট কর।
আমি একা যাব? আপনি যাবেন না? ছোটন জিগ্যেস করে।
আরে আমি এখন যাই কি করে বলো? অপারেশনের গোড়াতেই আমি যদি ধরা পড়ে যাই তাহলে ঘোর কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে না? তখন রজব দারোগাকে লোকে কি বলবে শুনি?
বুঝেছি। বুঝেছি। বলে জলপাইয়ের ডাল ধরে ছোট্ট দোল খেয়ে প্রাচীরের ওপর উঠে পড়ে ছোটন। বেশ প্রশস্ত প্রাচীর। এদিকওদিক চেয়ে উবু হয়ে বসে প্রাচীরের কিনার ধরে ঝুলতে থাকে। তারপর দেখেশুনে করে টুক করে লাফ দিয়ে ঝুপ করে নীচে পড়ল। ব্যথা তেমন পেল না। এসবে ওর অভ্যেস আছে। অল্পক্ষণ ঘাপটি মেরে থাকে ও। পায়ের তলার মাটি ভেজা । সন্ধ্যার পর সামান্য বৃষ্টি হয়ে গেছে। বাতাসে কাঁচা মাটির গন্ধ ভাসছিল। সেই সঙ্গে ভেজা ঘাসপাতার ঘন গন্ধ । অল্প অল্প করে এগোতে থাকে ও। আকাশে চাঁদের আলো ছিল। তবে প্রাচীরের ছায়া পড়েছে বলে চারধারে ঝুপসি ঝুপসি অন্ধকার। গাঢ় ছায়া। কিছু দূর এগোলে ইটের শক্ত চাতাল ঠেকল। ওপাশে আবার দেওয়ালও আছে। জায়গাটা কেল্লার কোনও কক্ষের ছাদ বলে মনে হল।
এই এই তুই কে রে ...কে যেন রীতিমতো হুঙ্কার ছাড়ল। ছোটনের পিলে চমকে ওঠে। কে যেন ওর কাঁধের কাছে শার্টের কলার খামছে ধরেছে। ছোটন টের পেল ধীরে ধীরে ও ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। দৈত্যের মতন চেহারার কেউ তাকে তুলে ধরেছে। ও শূন্যে দোল খাচ্ছে।
কি হয়েছে রে গাবু?
একটা নেংটি ইদুঁর ধইরেছি।
নেংটি ইদুঁর? বলিস কি?
এই দেখ না কেন? পা দুটো কেমন লাড়াচ্ছে। বলে গাবু খকখক করে হাসল। ভীষণ দূর্গন্ধ মুখে। রেগুলার দাঁতব্রাশ করে বলে মনে হয় না।
চল, ইঁদুরটাকে বসের কাছে নিয়ে যাই। তারপর মনের সুখে তোফা করি।
চল। চল।
গাবু নামক দৈত্যটা ছোটনকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে একটা ঘরে নিয়ে এল। তারপর মেঝের ওপর ধুপ করে ফেল। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল ছোটন। হাতে-পায়ের ছাল ছড়ে গেছে। ঝাঁকুনির ফলে মুখেচোখে অন্ধকার দেখছে। অন্ধকার সয়ে এলে দেখল বেশ বড়সরো ঘর। ঘর না বলে কেল্লার কক্ষ বলাই ভালো। ইলেকট্রিক আলো জ্বলে ছিল। ছোটন চারপাশে তাকাল। কালচে রঙের পুরু দেয়াল, মসৃণ মেঝে। উঁচু ছাদ। বেশ পরিস্কার ঘর। এটাই তাহলে বদমাশদের আস্তানা।
ঘরের মাঝখানে একটা কালো রঙের সোফা। তাতে সাদা রঙের পায়জামাপাঞ্জাবি পরা একজন মধ্যবয়েসি লোক বসেছিল । লোকটার গায়ের রং শ্যামলা। মাথায় ব্যাক ব্রাশ করা ঘন কোঁকড়া চুল। মুখে বসন্তের দাগ। লোকটা একটা চোখ পাথরের মনে হল । লোকটা সিগারেট টানছিল । লোকটা ছোটনকে ভালো করে দেখে বলল, কি নাম রে তোর?
ছোটন।
এই গাঁয়েই বাড়ি?
হ্যাঁ।
এখানে কি করছিলি তুই?
এখানে? তক্ষক বেচতে এসেছি স্যার। ছোটন বুদ্ধি করে বলল।
তক্ষক! লোকটা যেন চমকে উঠল।
হ্যাঁ তক্ষক । আমার এক বন্ধু বলল আপনারা নাকি ওর কাছ থেকে তক্ষক কেনেন?
তা কিনি। তা তুই তক্ষক ধরতে পারবি?
হ্যাঁ। পারব। মালোপাড়ার নাটমন্দিরের পিছনের পাকুড়জঙ্গলে অনেক তক্ষক আছে। আমি ধরে দিতে পারব।
বেশ। বেশ। তক্ষক ধরবি ভালো কথা। কিন্তু দিনের বেলায় যেখানে খানবাড়ি কিল্লার কাছে লোক ঘেঁষে না সেখানে তুই কোন্ সাহসে মাঝরাত্তিরে এলি ?
ছোটন চট করে উত্তর দিল, আজ দিনের বেলায় একবার ঘুরে গেছি স্যার। তখন কাউকে পাইনি । আপনারা আস্তানায় ছিলেন না মনে হয়।
বটে। লোকমান?
বস।
এটারে শক্ত করে বাঁধ।
লোকমানের বয়স একুশ-কুড়ির বেশি না। ফরসা। ছুঁচোমুখো চেহারা । পাকানো দড়ির মতন শরীর। সে কোত্থেকে দড়ি যোগাড় করে ছোটনকে কষে বাঁধতে লাগল। ছোটন ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল। একবার রজব দারোগার কথা মনে পড়ল। বিপদে ঠেলে দিয়ে দূর থেকে মজা দেখছে। যেই ভাবা অমনি এক অদ্ভূতুরে কান্ড ঘটল। মেঝের ওপর শুয়ে ছোটন সবিস্ময়ে দেখল ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে কক্ষটির একদিকের দেওয়াল একপাশে সরে গেল। সেখানে একটা দরজা । দরজায় রজব দারোগা দাঁড়িয়ে। হাতে একটা ছোট্ট রিভলবান। রজব দারোগার পরনে মালকোঁচা মারা লুঙ্গি আর ছেঁড়া গেঞ্জি। মনে হচ্ছে তেওড়াপাড়া গ্রামের মধু গোয়ালা। কেবল খ্যাদা নাকের নীচে পুরু হিটলারি গোঁফটাই বড্ড বেমানান ঠেকছে।
রজব দারোগা গর্জে উঠলেন, হ্যান্ডস আপ!
সবাই হাত তুলল। সেই সাদা রঙের পায়জামাপাঞ্জাবি পরা লোকটা হাত তুলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। গাবু নামক দৈত্যটা অবশ্য হাত তোলার সময় গতরের মাসলের জন্যই সম্ভবত খানিকটা গাঁইগুঁই করল অবশ্য। রজব দারোগা তার দিকে কটমট করে তাকালেন। দৈত্যটা সঙ্গে সঙ্গে কেমন মিইয়ে গেল। ছোটনের হাসি পেল।
রজব দারোগা হুইশেল বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে বুটের আওয়াজ তুলে ছ-সাতজন পুলিশ কক্ষে ঢুকল। প্রত্যেকের হাতেই উদ্যত রাইফেল। তাদের একজন রজব দারোগাকে স্যালুট করল। তারপর সেই অফিসার বলল, স্যার। দোতলায় একটা কক্ষে একটা ল্যাবরেটরি আছে। আমরা ওখান থেকে দুজন চাইনীজকে অ্যারেষ্ট করেছি। তারা বলছে তারা নাকি বিজ্ঞানী। কী সব কনট্র্যাক্ট সাইন করে নাকি হংকং থেকে এসেছে ।
হুমম। আচ্ছা, এখন তুমি ওর দড়ি কেটে দাও।
সেই পুলিশ অফিসার ছোটনের কাছে এলেন। তারপর ঝুঁকে বসলেন। ধীরে ধীরে ধারালো ছুরি দিয়ে দড়ি কেটে দিলেন। ছোটন উঠে বসল। হাতে পায়ে দড়ি কেটে বসে রক্ত চলাচল বন্ধ একেবারে হয়ে গিয়েছিল। লোকমানের দিকে কটমট করে তাকাল ছোটন । একটু হালকা করে বাঁধলে কি হত রে বদমাশ।
রজব দারোগা এবার কালো সোফার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, রমজান সিকদার। রমজান সিকদার। অনেক দিন পর তোমার সঙ্গে আমার আবার দেখা হয়ে গেল । শেষবার তুমি অল্পের জন্যে পালিয়ে গিয়েছিলে। শিবগঞ্জের মাজার রোডের একটা বাড়িতে তুমি জাল টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছিলে। এবার? এবার আমি তোমাকে চৌদ্দশিকের ওধারে পাঠাবই পাছাব । চিরজীবনের জন্য। কত জীবনই না তুমি ধ্বংস করেছ। দেশের কত সম্পদই না তুমি পাচার করেছ। দেহদ্রোহী! রাসকেল! উজবুক! এবার বল এখানে কি নখরামি করছ?
রমজান শিকদার বলল, আমি ক্যান্সারের অষুধ তৈরি করার চেষ্টা করছি।
ক্যান্সারের অষুধ না ছাই! রজব দারোগা গর্জে উঠলেন। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করছ। তক্ষকের মতো একটা নিরীহ ভীরু প্রাণি মেরে ফেলছ।
সেই পুলিশ অফিসার বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। নীচের কিল্লার একটা কক্ষে শত শত মরা তক্ষক দেখলাম। খাঁচায় অবশ্য শ’খানেক তক্ষক এখনও জীবিত আছে।
হুমম। এবার এদের নিয়ে যাও। দেখ, সাবধানে। যেন পালাতে না পারে।
একজন পুলিশ রাইফেল নল গাবুর পিঠে ঠেকিয়ে বলল, চল রে উজবুক। একটুও তেড়িবেড়ি করবি তো গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেব।
সবাই কক্ষ ছেড়ে চলে গেলে রজব দারোগা ছোটনের দিকে এগিয়ে এলেন। জিগ্যেস করলেন, তা কেমন লাগল বাছা মিশন তক্ষক?
ভালো। তবে শয়তানটা আমায় একটু জোরে বেঁধেছে এই যা।
রজব দারোগা দুলে দুলে হেসে উঠলেন। তাঁর ভুঁড়িখানি কেঁপে কেঁপে উঠল। হাসি থামিয়ে তিনি বললেন, থানায় নিয়ে উজবুকটাকে সেইরকম ট্রিক করা হবে । জামাই আদর আর কী! বলে আবার দুলে দুলে হেসে উঠলেন রজব দারোগা
ছোটন জিগ্যেস করল, কিন্তু আপনি দেয়াল ঠেলে এই ঘরে ঢুকলেন কীভাবে?
রজব দারোগা বললেন, বলছি। যে কোনও থানায় একটা এলাকার পুরনো দরদালান প্রাচীন অট্টালিকার গোপন নকশা থাকে। আমি তেওড়াপাড়া থানায় জয়েন করেই খানবাড়ির কেল্লার নকশাখানি বেশ করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি।
তাই নাকি ? বলেন কি-থানায় আবার পুরনো দরদালানের গোপন নকশাও থাকে?
থাকে । থাকে। সাধে কি পুলিসের চাকরি করছি ? এরকম গা ছমছম অ্যাডভেঞ্চার না থাকলে শুধু বসে বসে মাইনে নেওয়ায় সুখ আছে বলো ?
ছোটন মাথা নাড়ে।
কথা বলতে বলতে ওরা কক্ষের বাইরে চলে এল।
ঠিক সেই মুহূর্তে মিশন তক্ষকের সাফল্য ঘোষনা করেই যেন আশপাশ থেকে কতগুলি তক্ষক ‘তক্কে’, ‘তক্কে’ করে একসঙ্গে ডেকে উঠল আনন্দে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:০৬
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নেতানিয়াহুও গনহত্যার দায়ে ঘৃণিত নায়ক হিসাবেই ইতিহাসে স্থান করে নিবে

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৩৮

গত উইকেন্ডে খোদ ইজরাইলে হাজার হাজার ইজরাইলি জনতা নেতানিয়াহুর সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।
দেখুন, https://www.youtube.com/shorts/HlFc6IxFeRA
ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহুর এই হত্যাযজ্ঞ ইজরায়েলকে কতটা নিরাপদ করবে জনসাধারণ আজ সন্দিহান। বরং এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×