somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাম্প্রদায়িকতা আমাদের কোথায় নিয়ে চলছে! আপনি চুপ থাকলেও আমি থাকবো না

৩০ শে এপ্রিল, ২০১২ সকাল ১০:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি প্রায়সই বলে থাকি যে আমরা সাম্প্রদায়িক একটি রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছি। আমরা ভুলে যাই আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছিল একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ভর করে। কিন্তু সে চেতনা আজ অতীত। অনেকেই ব্লগে দেখেছেন, কোন হিন্দুকে আক্রমণ করা হলে আমি সে স্থানে গিয়ে প্রতিবাদ করি। কারণ আমি মনে করি, হিন্দুদেরও দেশ এটা। বৌদ্ধেরও দেশ, খ্রিষ্টানের দেশ। তাদেরও বলবার অধিকার আছে! এটা শুধু মুসলমানের একার অধিকার নয়।

২০০৯ সালের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। যে ঘটনার কথা সবার জানা উচিৎ। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছি তখন!

আমার জানা ছিল না যে, আমাদের ক্লাসের ছেলে মেয়েগুলো এত নিম্নমানের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এমনটা আশা করা যায় না। একটা ঘটনার মধ্যদিয়ে তাদের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছিল।

(ছাত্রলীগের খুব নাম করা হলের কিছু ছাত্র জড়িত ছিল বিধায় নাম-কাল-পাত্র আমাকে গোপন রাখতে হচ্ছে!)

সেকেন্ড ইয়ারের ফার্স্ট সেমিস্টার। খোশ মেজাজে শুরু করেছি কোর্স। আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে ছিল। তার নাম, আবীর। সে আবার পড়াশোনায় প্রচন্ড ভালো। প্রচন্ড মানেই ভয়ংকর! তুখোড় এই ছেলেটি ঠান্ডা মেজাজের ও স্বার্থপর টাইপের একটা ছেলে। তাই তাকে আমার কখনই ভালো লাগত না। কিন্তু ছেলেটির আচরণে রয়েছে এক প্রকারের সারল্য যা, সবার দৃষ্টিগোচর হত। আবীর কম কথার ছেলে, তার বন্ধু বলতে দুই তিনজন, আর তার সঙ্গী হলো বই।

ক্লাসে একবার একটা প্রেসেন্টেশন এসাইনমেন্ট আকারে দেওয়া হলো। আবীর কাজ পেলেই সেটা সেড়ে ওঠার জন্য উঠে পড়ে লাগত। আমাদের ক্লাসে আরেকটা ছেলে ছিল, সক্রিয় ছাত্রলীগের কর্মী। সেকেন্ড ইয়ার তো, গায়ে একটু জোর বেশি, ফুটানী বেশি আর কালে কিঞ্চিতে সে প্রায়সই মানুষকে হুমকি দিয়ে বেড়াত। ছেলের নাম শাহীন। শাহীন ছেলেটা, একদিন আমার সামনেই, আবীরকে বলছে, শোন তোর তো এসাইনমেন্টের কাজ শেষ, আমারে একটু দিস, ক্লাসটাস তো ঠিকমত করি না। তোরা হেল্প না করলে আর কে করবে!

আবীর কিছুটা অবাক হয়েছিল বটে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, আরেকজনের কাছ থেকে নে, আমি সাধারণত কাউকে এসব দেই না। শাহীন হঠাৎ করেই বদরাগী হয়ে যায়। সে বলল, দিবি না মানে, শালা তুই চিনোস আমি কে? একটা ফোন দিবো, আর এইখানে কেয়ামত হয়ে যাবে!

আবীর বলল, তোর যা খুশি তাই কর, আমি আমার এসাইনমেন্ট কাউকে দেখতে দেই না। এর উত্তরে শাহীনের বিশ্রী রকমের গালাগাল! সেদিন ক্লাস শেষ হয়েছিল বিকাল বেলা। ৪ টার সময় আমরা বের হলাম ক্লাসরুম থেকে। আবীর আর শাহীনের চেহারা থম থম। ক্যাম্পাস স্যাডোর সামনে এসে আমরা সবাই চা খাচ্ছিলাম। সেখান দিয়ে আবীর শাহবাগে যায়! আবীর হেটে যাচ্ছিল আমাদের সামনে দিয়েই। লেকচার থিয়েটারটা ক্রস করতেই আবীরকে ঘিরে ধরল কতগুলো ছেলে, তাদের প্রত্যেকের হাতেই রড!

আমাদের আর বুঝতে বাকি নাই কি হতে যাচ্ছে। আমি কিছু করতে গেলাম না। কিন্তু আমার বন্ধু সমীর ঘোষ এগিয়ে গেল। ছেলেটা লম্বা, ছিমছাম! দেখলেই মনে হয় ডানপীঠে ছেলে, গায়ে জোর আছে। সমীর ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। আবীরকে ঘিরে ধরা ছেলেগুলো তার সাথে কি বলছে, এখান থেকে বুঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু সমীরকে তাদের সামনে এগিয়ে যেতে দেখেই ছেলেগুলো বেপোরোয়াভাবে আবীরকে আঘাত করতে শুরু করে। এ সমেত, সমীর দৌড়ে আবীর আর ছেলেগুলোর মাঝখানে পড়ে। তিনচারটা রডের বাড়ি সমীরের গায়ে লাগে, ওর হাত বিশ্রীরকমের ভাবে ফেড়ে যায়।

ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই! আমরা তিন-চারটে ছেলে ক্যাম্পাস সেডোর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সমীর আবীরকে ধরে নিয়ে আসে। ঐ তিন-চারজন যুবক দৌড়ে প্রস্থান করে। কারও বুঝতে বাকি নেই, এ কাজ শাহীনই করিয়েছে। সমীর, ব্যাপারটা নিয়ে উচ্চ-বাচ্চ শুরু করে। শাহীনকে দেখে নেব, কালকে ক্লাসে আবীরকে সরি বলতে হবে, শালার সাহস কত।

নিতান্ত সাধারণ ছেলে আবীর মার, খেয়ে একেবারে চুপসে গেল। সে কিছুই বলছে না। শুধু থর থর করে কাপছে। আমরা এ-ও জিজ্ঞেস করছি। আর সমীর ওকে বার বার আশ্বস্ত করতে লাগল, যে ওর কিছু হবে না।

পরের দিন, দুপুরে ক্লাস ছিল। সমীর ঘোষ একটা বিপ্লবের মত ঘটিয়ে ফেলেছে! ক্লাসের সামনে দেখি অনেক ভিড়! সমীরের গলা শোনা যাচ্ছে, আর আসে-পাশের যে যার মত কথা বলছে। সমীর বলছে, শাহীনকে ক্ষমা চাইতে হবে। ক্লাসের অধিকাংশ ছেলে মেয়েরা শাহীনের বিপক্ষে চলে গেল! সমীরের কথায় সবাই অনড়। পারলে একেকজন শাহীনের চামড়া তুলে আনে। কেউ কেউ বলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসিপ্লিনারি কমিটিতে এটা নিয়ে কমপ্লেইন করবে।

অবস্থা, ছাত্রলীগ কর্মী শাহিনের একেবারে বিপরীতে প্রবাহিত হতে লাগল। আর এসবই সমীরের জন্য। আবীরকে কোথাও দেখতে পাচ্ছিলাম না। অবস্থা বেগতিক দেখে শাহিন একটা আজব কান্ড করে বসল। সে চিৎকার করে বলতে লাগল, ঠিকাছে, তোরা আমার বন্ধু না, তোরা একটা হিন্দুর বাচ্চা, মালাউনের কথামত আমারে ফাসাইতেছোস!

শাহিনেরও তো কিছু ফ্রেন্ড ছিল। যারা শাহিনের এরকম কাপুরষোচিত (আবীরকে মারা) আচরনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। তারা এবার একটা পয়েন্ট পেলো। তাদের মধ্যে সবাই প্রায়, সমীর একটা হিন্দু, ওর কথা কেন শোনা হবে, ও ইচ্ছা করেই ক্লাসকে বিতর্কিত করছে।

এমন অবস্থায়, সমীরের মুখ কালো হয়ে গেল। ক্লাসের কেউ কেউ বলতে শুরু করল, আচ্ছা ঠিক আছে, সমীরকে সরিয়ে অন্য কাউকে বলতে বলা হোক। যারা আগেরদিন স্পটে ছিল। আমাকেও অনেকে অফার করল! কিন্তু আমি কোনমতেই রাজি ছিলাম না। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম, যে ছেলেটা আবীরের জন্য এত কিছু করছে, যে ছেলেটা এটাকে একটা ইস্যু বানাতে সক্ষম হলো, তাকে ধর্ম নিয়ে খোটা দিয়ে একেবারে চুপ করিয়ে দেওয়া হলো! ক্লাসের কেউ একবারও বলল না, ও হিন্দু হইছে তো কি হয়েছে? সবাই বলতে লাগল, সমীরের স্থানে কোন মুসলমান কথা বললেই তো হয়!

এ যখন অবস্থা, আমি ক্লাসের বাইরে চলে আসলাম। এসে দেখি সমীর চলে গেছে। আমিও চলে গেলাম। আসলে আমার একেবারেই ভালো লাগল না বিষয়টা। এটা কেমন কথা হলো!

সমীরকে সেদিন আর কোথাও পেলাম না। খুজিও নাই সেভাবে অবশ্য। তার সামনে দাড়াতে খুব লজ্জা হচ্ছিলো! তার পরের এক সপ্তাহ জুড়ে সে ক্লাসে অনুপস্থিত ছিল। এরপর যখন আবার ক্লাসে আসা শুরু করল, আমি তাকে গিয়ে 'সরি' বললাম! কিন্তু তাতে কি? তার যে কষ্ট পাবার, তা তো সে পেয়েই গেছে!

শাহীন একজন মুসলিম, আবীর একজন মুসলিম আর সমীর একজন হিন্দু! শাহীন কি একজন মুসলমানের মত আচরণ করেছে? সমীর আর শাহীনের মধ্যে আপনি কাকে সাপোর্ট করবেন? শাহীনকে? সে মুসলমান তাই? নাকি সমীরকে, সে সত্যের পথে জোড়ালো প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল বলে!
একবার ভাবুনতো, এই ঘটনাটি যদি উল্টো হত, অর্থা একটা মুসলমানকে এভাবে অপদস্ত করা হত?

এইখানেই আমাদের সমস্যা। আমরা মনে করি মুসলমান মানেই ভালো মানুষ আর অন্য ধর্মের সবাই নিম্ন শ্রেনীর। তাদের কথা শুনিয়ে দিতে আমরা পিছপা হইনা! মানুষ ভালো না খারাপ, সেটা কি তার ধর্মের উপরে নির্ভরশীল? এখন আপনারাই বলেন!


১৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×