somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতির রাঙামাটি

২৮ শে এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ১:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেশ ক’বারই রাঙামাটি গিয়েছি। প্রথমবার রাঙামাটি যাওয়ার স্মৃতি মনে পড়ে। আবছা। ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়ি সম্ভবত। ছোট খালার বিয়ে হয়েছে। খালুর পোস্টিং চট্টগ্রামের রাউজান। আব্বার সঙ্গে রাউজান গেছি। বেড়াতে। গ্রীষ্মকালই হবে। গায়ে কড়া রোদ লাগত মনে আছে। আর সবকিছু খুব নির্জন ছিল। ঘাস ও লতাপাতার গন্ধও পেতাম স্পষ্ট করে। মনে আছে ...
ছোট টিলার ওপর একতলা বাড়ি। বাড়ির নীচে ঢাল। সেই ঢালে গাছপালা। কলাগাছ। বাড়ির বাইরে একটা টিউবওয়েল। সেই টিউবওয়েল চেপে ট্যাঙ্কিতে পানি তুলতে হত। আমি খুব সকালে উঠে দারুণ উৎসাহে টিউবওয়েল চাপতাম। তাতে আমার বাহুর মাসল বেশ শক্ত হয়ে উঠেছিল। পরে স্কুলের বন্ধুদের দেখিয়েছিলাম ইউনিফরমের হাতা গুটিয়ে । বন্ধুরা সব টিপেটিপে দেখেছিল।
এক সকালে আমি আর আব্বা রাঙামাটি রওনা হলাম। রাঙামাটি সম্বন্ধে আমার তখনও তেমন স্পষ্ট কোনও ধারণা ছিল না। কেবল জানতাম যে ... রাঙামাটিতে উঁচু উঁচু অনেক পাহাড় আছে; মনে করতাম রবীন্দ্রনাথের ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ’...গানটা ওই রাঙামাটিকে নিয়েই; আরও মনে করতাম, রবীন্দ্রনাথ রাঙামাটিতে বসে গানটি লিখেছিলেন। আব্বার সঙ্গে সেই বিখ্যাত জায়গায় যাচ্ছি।
সকালে নাশতার টেবিলে ছোটখালা বললেন, দুলাভাই, এই গন্ডগোলের মধ্যে ইমন কে নিয়ে রাঙামাটি যাবেন? শান্তিবাহিনী কয়েকদিন আগেও থানা অ্যাটাক করেছে।
আব্বা কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন। চায়ে চুমুক দিলেন। পেশায় আইনজীবি বলেই কিনা কে জানে- আব্বা গম্ভীর মানুষ। ছোটখালাও আর কিছু বলার সাহস পেলেন না।
কিন্তু আমি আজ বেশ বুঝতে পারি যে আব্বা অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই তাঁর একমাত্র পুত্রকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন । হয়তো ভেবেছিলেন, জীবনের তো নানা রূপ ... ভবিষ্যতে পুত্রটি কি দেখে না দেখে ... বালক বয়েসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখলে ও জীবনের ওপর কখনও বিশ্বাস হারাবো না ...
আমি আর আব্বা টিলা থেকে নেমে সরু পিচ রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ালাম। রোদের বেশ কড়া ঝাঁঝ ছিল। রাস্তার পাশে লালমাটির টিলা। ওপর থেকে বড় বড় সবুজ লতা ঝুলে আছে। বাতাসে দোল খাচ্ছে। চারধার কী নির্জন! কী নির্জন! হয়তো কোনও পাহাড়ি পাখি ডেকে উঠেছিল, যা আজ আমার আর মনে নেই ...
ধুলো উড়িয়ে একটা সবুজ রঙের রংচটা মুড়ির টিন এসে থামল। তখনকার দিনে, অর্থাৎ সত্তর এবং আশির দশকে ঢাকায় সদরঘাট-রামপুরা রুটে যে রকম বাস চলত বাসটা ঠিক সেরকম। আমি আর আব্বা উঠলাম। সৌভাগ্যক্রমে বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম। বাসযাত্রীরা ছিল মিশ্র ধরণের। তার মানে-বাসযাত্রীদের মধ্যে বাঙালিও ছিল, আদিবাসীও ছিল। তবে সবার মুখ সামান্য গম্ভীর। হয়তো শান্তিবাহিনীর আক্রমনের আশংকায় । আব্বাকে নির্বিকার দেখলাম । আমিও যথা সম্ভব নির্বিকার থাকার চেষ্টা করছিলাম হয়তো।
বাস চলছে। প্রথম ঘন্টায় বাসের জানারার বাইরের দৃশ্য একই রকম ছিল মনে আছে। খুব একটা বদলায় নি। সরু পিচরাস্তার দু’পাশে ছোট ছোট টিলা। টিনসেডের ঘর। ছোট ব্রিজ। পাহাড়ি নালা। কোন্ এক স্টপেজে বাস থেমেছে। স্থানীয় ভাষায় হইচইয়ের মধ্যে ঝুড়ি ভরতি কাঁকরোল উঠল বাসের ছাদে। কয়েকজন আদিবাসী উঠেছে। তাদের সঙ্গে মুরগী ভরতি খাঁচা। তারই কক ককককানি। আমার ভালোই লাগছিল।
মাঝখানে একবার বাস থামল। বাসে কয়েকজন আর্মি উঠে তল্লাসী চালাল। আমি শান্তিবাহিনীর সদস্য নই। তবুও আমার বুক দুরুদুরু করে উঠল। আমাকে যদি ধরে নিয়ে যায়? না, আমাকে ধরে ওরা রাখতে পারবে না। আমি তো ‘ব্যাটম্যান’। সেসব দিনে বিটিভে খুব ‘ব্যাটম্যান’ দেখতাম।
এরপর ধীরে ধীরে দু’পাশের দৃশ্য বদলে যেতে লাগল। একপাশে খাঁড়া পাহাড়, আরেক পাশে গভীর খাদ। অনেক নীচে কলাগাছ, আনারসের ক্ষেত আর সরু নদী চোখে পড়ে। আর বিপদজনক সব বাঁক। বারবার মনে হচ্ছিল আমার ... বাস যদি খাদে পড়ে যায়। আমার বুক দুরুদুরু করতে লাগল। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিল আমার ...বাসটা রাস্তায় চলছে না, আকাশে ভাসছে। ভাবছিলাম কারা এত উঁচুতে রাস্তা বানাল? এত উঁচুতে রাস্তা বানানোর কি দরকার? যদি বানায় তো এত সরু করে বানিয়েছে কেন? আরও চওড়া করে বানালে কি হত?
আর রাঙামাটি যাওয়ারই-বা কি দরকার! রাঙামাটি কি খুব দরকারি জায়গা যে ওখানে না গেলেই নয়? ধীরেসুস্থে হাতির পিঠে কিংবা নৌকায় গেলেই তো হয়।
হঠাৎ একটা বাঁকের পর বহু নীচে রোদের আলোয় নদীসহ ঝলমলে একটা শহর চোখে পড়ল।
রাঙামাটি!
এরপর বাস গোঁ গোঁ করতে করতে এঁকেবেঁকে নীচে নামতে লাগল। আমার তখনও টেনশন কমে না। সে যাই হোক । বাস যখন থামল তখন একটা নতুন দেশে পৌঁছে গেলাম। চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে তো আমার ছেলেবেলা থেকেই পরিচয়। উঁচু নীচু রাস্তার জন্য ওই শহরটা আমার প্রিয়। কিন্তু রাঙামাটির উঁচু নীচু পাহাড়ি রাস্তার কাছে সে তো নস্যি। চট্টগ্রাম শহরে তাও রিকশা চলে, রাঙামাটিতে স্কুটার বা বেবি ট্যাক্সিই একমাত্র ভরসা।
শহরে লোকজন কম। তেমন দালানকোঠাও চোখে পড়ল না। (আমি সত্তরের দশকের শেষের দিকের কথা বলছি এবং আমাদের কয়েক ঘন্টার ওই সংক্ষিপ্ত সফরে বৌদ্ধমন্দিরের দিকে যাওয়া হয়নি) ... রাস্তায় আদিবাসী এবং রঙীন চীবরধারী বৌদ্ধভিক্ষু চোখে পড়ল। তাই হয়তো ভেবেছিলাম ... কি আছে এই শহরে যে অত ঝুঁকি নিয়ে আসতে হয়?
হাঁটতে-হাঁটতে বাজার মতন একটা জায়গায় এলাম মনে আছে। নীচে বিস্তীর্ণ একটি হ্রদ। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেকার কথা লিখছি। অনেক কিছু মনে আছে, আবার অনেক কিছুই মনে নেই। এই যেমন-কী খেয়েছিলাম, সেই দরকারি কথাই মনে নেই। আব্বা কি আমাকে কলা কিনে দিয়েছিলেন? কিংবা বিস্কিটের প্যাকেট? আব্বা কি কোনও টিস্টলে বসে চা খেয়েছিলেন? দুপুরে আমরা কি ভাত খেয়েছিলাম? এতদিন পরে সেসব কথা আর আমার মনে নেই!
তবে একটা বেশ মজার ঘটনা মনে আছে। আবছা। আমি আর আব্বা টলটলে হ্রদ আর দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশ, পাহাড়ের রং, পানির রং-এসব মিলিয়ে বেশ মনোরম দৃশ্য। আমার বালক-চোখে সবই ভালো লাগছিল। কিন্তু একটু পর আমার মন যে বিষাদে ছেয়ে যাবে কে জানত! পাশে হাফহাতা শার্টপরে এক মাঝবয়েসি ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাঙালি। একটু আগেই আব্বার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ভদ্রলোক বললেন, আপনার ছেলে কি ছবি আঁকতে পারে?.
না। আব্বা মাথা নাড়লেন। আব্বাকে কেমন কুন্ঠিত মনে হল। একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন।
ভদ্রলোক বললেন, আমার ছেলে চমৎকার ছবি আঁকতে পারে। বলে ভদ্রলোক ছেলের নাম বলে ঘটা করে ছেলের গুণকীর্তন করতে শুরু করে দিলেন। আমিও আরষ্ট বোধ করি। ছিঃ, রাস্তার লোকের কাছে আব্বার সম্মান ধুলায় লুটাল। আমি কেন যে ছবি আঁকতে পারি না। রাঙামাটি বেড়ানোর আনন্দ কেমন ম্লান হয়ে এল।
আমি এখনও মাঝেমাঝে ভাবি সেই ছবি আঁকিয়ে ছেলে এখন কই ... পৃথিবী বিখ্যাত চিত্রকর হয়েছে নাকি? আবার ভাবি ... হতেও তো পারে। আর সেরকম হলে তো আমার তো জানার কথাও নয় ...
দুপুর আবার ফেরার জন্য বাসে উঠলাম। সন্ধ্যা নামলে নাকি বিপদ ...শান্তিবাহিনীর চোরাগোপ্তা আক্রমন শুরু হবে। সেনাবাহিনীর অনেকগুলি হাফট্রাক চোখে পড়ল। এখানে ওখানে তল্লাশী চালাচ্ছে। বাস চলেছে। আমি দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছি। আকাশে আর পাহাড়ে রোদ ঝলমল করছিল। হয়তো ভাবছিলাম ... এ দেশটা এত সুন্দর ... এখানে কেন এত অশান্তি ...
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ২:১৬
১৮টি মন্তব্য ১৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৮

আজ (১০ মে ২০২৪) রাত দুইটা দশ মিনিটে নিউ ইয়র্কের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হবার কথা। এর আগেও পশ্চিমের দেশ আমেরিকা ও কানাডায় গিয়েছি, কিন্তু সে দু’বারে গিয়েছিলাম যথারীতি পশ্চিমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×