somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের কথিত সমুদ্রবিজয়.....

২১ শে এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ১২:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেন্টমার্টিনে তিন যুগের স্বীকৃত অধিকার হারাল বাংলাদেশ
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে সরকার সমুদ্র বিজয়ের দাবি করলেও বাস্তবে বাংলাদেশ হারিয়েছে বেশি। বিশেষ করে সেন্টমার্টিন দ্বীপের ওপর বাংলাদেশের তিন যুগের স্বীকৃত আইনি অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল সরাসরি মিয়ানমারের দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে সেন্টমার্টিনকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সীমানার বাইরে ধরে রায় দিয়েছেন। এতে বঙ্গবন্ুব্দ শেখ মুজিবুর রহমানের সময় থেকে সেন্টমার্টিনের ওপর স্বীকৃত আইনি অধিকার বাংলাদেশ হারালো বলে মনে করেন সমুদ্রসীমা আইন বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন ড. রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি মেরিটাইম ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির প্রতিষ্ঠাতা এবং সিঙ্গাপুর ইনস্টিটিউট অব আর্বিট্রেটরস ও চেম্বার অব মেরিটাইম আর্বিট্রেশনের সদস্য। রায়টি বিশ্লেষণে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা রায়ে সেন্টমার্টিন ইস্যুতে বাংলাদেশ নিজেদের দাবি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে পারেনি। কেবল মিয়ানমারের যুক্তির বিরোধিতা করে সেন্টমার্টিনের ওপর আইনি অধিকার হারিয়ে এসেছে। রায়ের ওপর ড. রেজাউল করিমের
বিশ্লেষণ নিয়ে আমার দেশ-এ ধারাবাহিক রিপোর্ট করছেন স্টাফ রিপোর্টার মাহাবুবুর রহমান। আজ পডুন চতুর্থ পর্ব।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে সেন্টমার্টিনের ওপর বাংলাদেশের আইনি অধিকার খর্ব হয়েছে। সেন্টমার্টিন ইউনিয়নকে ভূখণ্ডের মূল সীমানার বাইরে ধরেই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। টেকনাফকে সর্বশেষ সীমানা ধরে ২০০ নটিক্যাল মাইল সমুদ্রসীমা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশকে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে মিয়ানমারের সঙ্গে একটি সমঝোতার মাধ্যমে সেন্টমার্টিনের ওপর বাংলাদেশের অধিকার স্বীকৃত হয়। তখন মিয়ানমারকে সেন্টমার্টিনের নিকটবর্তী টেরিটরিয়াল সাগরে জাহাজ চলাচলের অধিকার দেয়া হয়। সময়ের আবর্তে ১৯৮৩ সালে সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একটি ইউনিয়ন পরিষদ হিসেবে যাত্রা শুরু করে।
গত ১৪ মার্চ ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল’ অব দ্য সি (ইটলজ)-এর রায়ের ভাষ্যমতে, আদালতে বাংলাদেশের দাবি ছিল, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সমুদ্রসীমা টেরিটরিয়াল সি এলাকায় উভয় দেশের সম্মতিতে ১৯৭৪ সালে ৭টি বিন্দু দ্বারা অঙ্কিত এবং ২০০৮ সালে পুনঃস্বাক্ষরিত এবং স্বীকৃত রেখা বরাবর হবে। সে অনুযায়ী সেন্টমার্টিনকে মূল ভূখণ্ডের অংশ ধরেই বাংলাদেশের এজেন্টরা সমুদ্রসীমা নির্ধারণের দাবি জানান।
কিন্তু মিয়ানমার ১৯৭৪ সালের সমঝোতা ও ২০০৮ সালে তা পুনঃঅনুমোদনকে অগ্রাহ্য করে। এর জবাবে বাংলাদেশের এজেন্টরা তেমন কোনো যুক্তি তুলে ধরতে পারেননি। বাংলাদেশ সেন্টমার্টিন দ্বীপের আইনগত মর্যাদা রক্ষা করতে পারেনি। এতে সেন্টমার্টিনের ওপর বিগত ৩৭ বছরের অধিকারও বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে গেছে। সীমারেখা না মানার মিয়ানমারের আবদার এবং ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক তা মেনে নেয়া সঠিক হতে পারে না।
এ বিষয়ে খোদ টাইব্যুনালের রায়ে ভিন্নমত প্রদানকারী বিচারক এন্থনি লাকি বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপটি জনঅধ্যুষিত। এখানে ব্যাপকভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। বহু বিদেশি পর্যটক দ্বীপটিতে বেড়াতে আসেন। দ্বীপটিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও উপকূল রক্ষীবাহিনীর ঘাঁটি রয়েছে। কাজেই কনভেনশনের ১২১ ধারা মোতাবেক সেন্টমার্টিন একটি দ্বীপ এবং এ কারণেই সীমানা নির্ধারণে দ্বীপটি সমুদ্রের ১২ নটিক্যাল মাইল পাওয়ার পূর্ণ অধিকার রাখে। কনভেনশনের ১২১ ধারা অনুসারে বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যে।
মূলত সমুদ্রে প্রকৃতির দান হিসেবে প্রাপ্ত সেন্টমার্টিনের ওপর আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা খুবই সহজ ছিল। এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল মিয়ানমারের তুলনায় অধিক ঘনবসতিপূর্ন হওয়ায় প্রকৃতিই সেন্টমার্টিন দ্বীপ তৈরি করে দিয়ে অধিক সংখ্যক মানুষের জন্য উপযুক্ত সমুদ্রসীমা এবং সম্পদ আহরণের উপায় করে দিয়েছে।
মামলার মূল রায়ের অনুচ্ছেদ ২৯৮ থেকে ৩১৯ পর্যন্ত বিশেষভাবে সেন্টমার্টিন দ্বীপের আলোচনা থাকলেও রায়ের আরও শতাধিক অনুচ্ছেদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বিষয়বস্তু হলো সেন্টমার্টিন দ্বীপ। বাংলাদেশ এই দ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক উপাদান হিসেবে উল্লেখ করে বলেছে, এ দ্বীপকে বাদ দিয়ে যে কোনো সীমা নির্ধারণ প্রচেষ্টা অবশ্যই সমতাভিত্তিক নয়। বাংলাদেশের এ দাবি ট্রাইব্যুনাল গ্রহণ করেনি। এরপরও ইটলজ-এর রায়কে সরকার বিজয় বলে উল্লাস করছে। সেন্টমার্টিনের বিষয়ে সাধারণভাবে যে প্রশ্নগুলো তৈরি হয়েছে তার মধ্যে প্রথমেই চলে আসে ১৯৭৪ সালের সমঝোতার ফলে আনক্লোজের আর্টিকেল ১৫-এর অধীনে যরংঃড়ত্ষরপ ঃরঃষব তৈরি রয়েছে কিনা? অথবা তিন যুগ ধরে উভয়পক্ষের মেনে অসার ফলে ঃধপরঃ ধমত্ববসবহঃ তৈরি হয়েছে কিনা?
দ্বিতীয়ত, আনক্লোজের আর্টিকেল ১২১ অনুযায়ী সেন্টমার্টিনের আইনগত মর্যাদা কি? এ দ্বীপ টেরিটরিয়াল সি, এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন ও কনটিনেন্টাল সেলফ-এর অধিকার রাখে কিনা?
মিয়ানমারের বক্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশ তার উপকূলের বর্ণনায় সেন্টমার্টিন দ্বীপের উল্লেখ করেনি, সুতরাং তা বাংলাদেশের তটরেখার অবিচ্ছেদ্য অংশ বিবেচিত হতে পারে না। মিয়ানমার আরও বলেছে, মাত্র ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি দ্বীপের কারণে বাংলাদেশ ১৩,০০০ বর্গ কিলোমিটারের সমুদ্রসীমা লাভ করবে, যা সুস্পষ্ট সমতার পরিপন্থী।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের এ দাবি মেনে নিয়ে তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সেন্টমার্টিন দ্বীপের আইনগত মর্যাদা প্রত্যাখ্যান করে সমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, আনক্লোজ আর্টিকেল ১২১ অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা কোনো সমতার অজুহাতে বাতিলযোগ্য নয়, বরং আইনি মর্যাদা নিরূপণের পর সমতাভিত্তিক সমাধান কাম্য।
আশ্চর্য যে, ট্রাইব্যুনাল এ বিষয়টিতে অনুচ্ছেদ ৩১৭-তে ভুল এবং মিথ্যা (আর্টিকেল ১২১ থাকার পরও বলেছে এ বিষয়ে কোনো সাধারণ আইন নেই। .... সমতাভিত্তিক সমাধান উদ্দেশ্য) এবং ৩১৮ ও ৩১৯ অনুচ্ছেদে, স্ববিরোধী বক্তব্য (এ মামলায় সেন্টমার্টিন দ্বীপ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য............ কিন্তু ............. এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন ও কনটিনেন্টাল সেলফের সীমা নির্ধারণে ট্রাইব্যুনাল এ দ্বীপকে বিবেচনা করবে না) প্রদান করেছে, আমরা মনে করি এটি
ওঈঔ এর আর্টিকেল ৩৮ এর এবং ইটলজ বিধির অধীন পর্যাপ্ত কারণ দেখিয়ে রায় দেয়ার নীতির পরিপন্থী হয়েছে।
লক্ষ্যণীয় হলো যে, আর্টিকেল ১৫ অনুযায়ী আমাদের ঞধপরঃ অমত্ববসবহঃ রয়েছে এবং ৩৭ বছরের ঐরংঃড়ত্রপ ঃরঃষব-ও ছিল সেখানে ট্রাইব্যুনাল আমাদের ৩৭ বছরের ভোগ করে আসা অধিকার বাতিল করে দিল এবং আমাদের একটি ঊয়ঁরঃধনষব ঝড়ষঁঃরড়হ দিতে চাইল (যদিও আর্টিকেল ১৫-এ এরূপ সমতার উল্লেখ নেই।) অপরদিকে এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন ও কনটিনেন্টাল সেলফের ক্ষেত্রে আনক্লোজ-এ ঊয়ঁরঃধনষব ঝড়ষঁঃরড়হ পরিষ্কার উল্লেখ থাকলেও ট্রাইব্যুনাল আমাদের ঘাড়ে অনেকটা জোর করে সমদূরত্ব চাপিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু একটু চেষ্টা করলে সেন্ট মার্টিনের ওপর বাংলাদেশের স্বীকৃত অধিকার বহাল রাখা সম্ভব ছিল। রায়ের ৩১৭নং অনুচ্ছেদে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, ‘একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধানে পৌঁছনই হলো মূল লক্ষ্য’। ন্যায়সঙ্গত সমাধানের পথ তো প্রকৃতিই বাংলাদেশের পক্ষে করে দিয়েছে। তাছাড়া আনক্লোজ-এর পার্ট-৮ (জবমরসব ড়ভ ওংষধহফং)-এর আর্টিকেল ১২১ অনুযায়ী সেন্ট মার্টিনের আইনগত মর্যাদা দাবির সুযোগ ছিল।
এক্ষেত্রে ভিন্নমত প্রদানকারী বিচারক এন্থনি লাকি তার ৬৪ পৃষ্ঠার নোটে বলেন, আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের (আইসিজে) সিদ্ধান্ত অনুসারে কৃষ্ণসাগরের সীমানা নির্ধারণ (রোমানিয়া বনাম ইউক্রেন) মামলার রায় এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। প্রশ্ন হলো, সমুদ্রসীমা নির্ধারণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি কোনো বিশেষ অবস্থার কিনা। একেক দ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থা একেক রকম। সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি সার্পেন্ট দ্বীপের মতো নয়। আইন অনুযায়ী, দ্বীপটি কোনো বিশেষ অবস্থার দ্বীপ নয়। কাজেই এ মামলার রায়ে দ্বিখণ্ডক রেখার সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেন্ট মার্টিন দিয়ে শুরু করতে হবে (স্টার্টিং পয়েন্ট)। তার মতে, ১৯৭৪ সালের সম্মতি ও ২০০৮ সালের অনুমোদিত মাইনুট চুক্তিতে পরিণত নাও হতে পারে। তবে এগুলোকে উপেক্ষা করা যায় না। মাইনুটগুলোকে প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এ কারণে যে, গত ৩৪ বছর ধরে এ চুক্তি ছিল এবং তারা তা মেনে চলেছে। আমার মনে হয়, এসব প্রমাণাদি এটাই প্রমাণ করে, অনুমোদিত মাইনুটের আলোকে ন্যায়সঙ্গত সমাধানের জন্য একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়া যেত। চুক্তির বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন সুস্পষ্ট। আমার মত হচ্ছে, অনুমোদিত মাইনুট একটি মৌন চুক্তি যাতে বলা হয়েছে, ১৯৭৪ সালে ৭ দফার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। দুটি দফায় সামান্য সংশোধন করে ২০০৮ সালে এটি আবারও নিশ্চিত করা হয়েছে। শুধু ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মিয়ানমার আগে নির্ধারিত সীমা মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানায়। বাংলাদেশ বলছে, গত ৩৪ বছর ধরে যে সীমানা সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলা হয়েছে সে ব্যাপারে একপক্ষীয়ভাবে মিয়ানমার মত পরিবর্তন করতে পারে না।
ট্রাইব্যুনালের আরেক বিচারক জঁফরমবহ ড়িষভত্ঁস অত্যন্ত দুঃখ করে বলেছেন, রায়ের ২৩৫ অনুচ্ছেদে ট্রাইব্যুনাল যে কোন পদ্ধতিতে শেষ পর্যন্ত একটি সমতাভিত্তিক সমাধানে পৌঁছাই উদ্দেশ্য বলে উল্লেখ করলেও এই রায় স্বচ্ছতা এবং যৌক্তিক সম্ভাবনা তৈরির অভাবে এই মামলার রায়টি আন্তর্জাতিক আইনের উত্স হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে। এই রায় আইনের স্থির না থেকে ক্রমাগত উন্মুক্ত উত্কর্ষ সাধনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেছে। বৈজ্ঞানিক তথ্য ও প্রমাণ সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত না হওয়ায় এই রায় উপযুক্ত কারণ দ্বারা সমর্থিত হয় নাই।
কনভেনশনের আর্টিকেল ৭৪ ও ৮৩ এর ব্যাখ্যা যথার্থ হয়নি। ট্রাইব্যুনাল সমভিত্তিক সমাধানের কথা বললেও সেন্টমার্টিন দ্বীপের ক্ষেত্রে প্রকৃত সমতার সমাধানটি কি? ট্রাইব্যুনাল সমতা বলতে কোন কোন বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েছে এবং কোন বিষয়কে বাদ দিয়েছে- তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল। ভবিষ্যত্ বিচারকগণের জন্যও তার দরকার ছিল। কেন একটি সিদ্ধান্তই অনিবার্য এবং সমতাভিত্তিক এবং এর বিকল্প অন্য কিছু নয়- তা প্রতিষ্ঠিত করতে এ রায়ে ট্রাইব্যুনালের আরও সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন ছিল। সেন্টমার্টিন দ্বীপ ১২ মাইল টেরিটরিয়াল সাগর এর অধিকার পেলে আর্টিকেল ১২১ মতে কেন এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন ও কন্টিনেন্টাল সেলফ পাবে না? সব মিলিয়ে এই রায়টি জ্ঞানগর্ভ হয়েছে কিনা সে প্রশ্নে বিচারক বিস্মিত হয়েছেন। তিনি মনে করেন, অধিকতর যৌক্তিক সুবিবেচনা থাকলে হয়ত সেন্টমার্টিন দ্বীপকে এমনভাবে অবরুদ্ধ হতে হতো না।
ইটলজ-এর ১৬নং মামলায় অন্যতম বিচারক চীনের তযরমঁফ এধড় মামলার মূল রায়ের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে ৪৬ পৃষ্ঠার একটি পৃথক মতামত লিপিবদ্ধ করেছেন। ওই পৃথক মতামতের ৩১ পৃষ্ঠা হতে ৩৪ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ৭৩ থেকে ৮২নং অনুচ্ছেদে তিনি সেন্টমার্টিন দ্বীপের বিষয়ে তার মতামত তুলে ধরতে গিয়ে মূল রায়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপের বিষয়ে গৃহীত সিদ্ধান্তকে স্ববিরোধী, ভুল এবং অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেন। বিচারক বলেন, ট্রাইব্যুনাল একদিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক বাস্তবতা বলে উল্লেখ করেছেন এবং পাশাপাশি এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন ও কন্টিনেন্টাল সেলফের সীমানা নির্ধারণে এই দ্বীপকে বিবেচ্য করেননি। এটা সুস্পষ্ট স্ববিরোধিতা। তিনি বলেন, সাগরের পরিমাণের দিকে তাকিয়ে ভূমিকে অস্বীকার করা যায় না, কারণ আন্তর্জাতিক আইনের সাধারণ কথা হলো- ভূ-খণ্ডের আলোকে সাগর বিবেচ্য হয়।
বিচারক জিকু কাউ মনে করেন, অন্তত তিনটি কারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপ এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। আর সেগুলো হলো : এক. এটা বলার অপেক্ষা রাখে না কনভেনশনের ১২১নং আর্টিকেলের ১ম ও ২য় অনুচ্ছেদ মতে সেন্টমার্টিন দ্বীপ শুধু ১২ নটিক্যাল মাইলের টেরিটরিয়াল সাগরই নয়। বরং এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন ও কন্টিনেন্টাল সেলফ-এর অধিকারও রয়েছে।
দুই. এই দ্বীপের আকৃতি, জনসংখ্যা, কৌশলগত গুরুত্ব, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড থেকে মাত্র সাড়ে চার নটিক্যাল মাইলের মধ্যে অবস্থানের কারণে সীমানা নির্ধারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে কোনোমতেই উপেক্ষা করা যায় না।
তিন. এটা বাংলাদেশের ভূখণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং সীমারেখা নির্ধারণ এলাকার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত।
অপরদিকে, সেন্টমার্টিনকে এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোন ও কন্টিনেন্টাল সেলফ-এর অধিকার দিলে মিয়ানমারের সমুদ্র এলাকা সঙ্কুুচিত হবে এই অযুহাতে দ্বীপটিকে সমুদ্রের দিকে তার আইনগত অধিকার না দেয়া এবং বাংলাদেশকে তার অধিকার এবং স্বার্থ থেকে বঞ্চিত করাকে তিনি মুদ্রার শুধু একপিঠের দিকে তাকানো বলে মন্তব্য করেছেন। এই সিদ্ধান্তকে ভুল, অগ্রহণযোগ্য বলে এর জোরালো বিরোধিতা করেছেন।
সেদিন হয়ত দূরে নয়, সেন্টমার্টিনের জেলে সম্প্রদায় তাদের শত বছরের মাছ ধরার অধিকার হারানো এবং এর ফলে সৃষ্ট আর্থিক ক্ষতিপূরণের জন্য ইটলজ/আইসিজে তে এই মামলার পক্ষগুলোর বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করবে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সাধারণ পরিচিতি : সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত একটি প্রবাল দ্বীপ। এটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ হতে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। প্রায় ১০০ থেকে ১২৫ বছর আগে এখানে লোকবসতি শুরু হয়। বর্তমানে এখানে ৭ হাজারেরও বেশি লোক বসবাস করে। দ্বীপের লোকসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এখানকার বাসিন্দাদের প্রধান পেশা মাছ ধরা। পর্যটক ও হোটেল ব্যবসায়ীরাই প্রধানত তাদের কাছ থেকে মাছ কেনেন।
দ্বীপটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এখানে প্রতিদিন তিনটি লঞ্চ টেকনাফ থেকে আসা-যাওয়া করে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বর্তমানে বেশক’টি ভালো আবাসিক হোটেল আছে। বাংলাদেশ সরকারের একটি ডাকবাংলো আছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার ও উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। এ দ্বীপের তিন দিকের ভিত শিলা যা জোয়ারের সময় তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে। এসব মিলে সেন্ট মার্টিনের আয়তন হবে প্রায় ১০-১৫ বর্গ কিলোমিটার। এ দ্বীপটি উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৫.৬৩ কিলোমিটার লম্বা। দ্বীপের প্রস্থ কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার। দ্বীপটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অগণিত শিলাস্তূপ আছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের গড় উচ্চতা ৩.৬ মিটার। সেন্ট মার্টিনের পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার প্রবাল প্রাচীর।
ভৌগোলিকভাবে এটি তিনটি অংশে বিভক্ত। উত্তর অংশকে বলা হয় নারিকেল জিনজিরা বা উত্তর পাড়। দক্ষিণ অংশকে বলা হয় দক্ষিণ পাড় এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে দক্ষিণ-পূর্বদিকে বিস্তৃত একটি লেজের মতো এলাকা। সঙ্কীর্ণতম অংশটি গলাচিপা নামে পরিচিত। দ্বীপের দক্ষিণে ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তনের ছোট দ্বীপ আছে যা স্থানীয়ভাবে ছেড়াদ্বীপ নামে পরিচিত। সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখি আছে বলে জানা যায়। দ্বীপে কেওড়া বন ছাড়া প্রাকৃতিক বন বলতে যা বোঝায় তেমন কিছু নেই। দক্ষিণ দিকে কিছু ম্যানগ্রোভ গাছ আছে। নারিকেল গাছও রয়েছে প্রচুর। প্রচুর নারিকেল পাওয়া যায় বলে স্থানীয়ভাবে একে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়ে থাকে। সেন্ট মার্টিনের প্রাচীন নাম ছিল জাজিরা। স্থানীয় লোকদের মতে, আরব বণিকরা দিয়েছিল এ নাম। পরে জাজিরা স্থানীয় লোকদের মাধ্যমে নারিকেল জিঞ্জিরা বলে খ্যাত হয়ে ওঠে। কোনো এক সময়ে ইংরেজরা একে সেন্ট মার্টিন নামে অভিহিত করে বলে জানা যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ১২:২১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×