somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমাদের শেকড়, রবিন্দ্রনাথ ও ঠাকুরবাড়ি।

১৯ শে এপ্রিল, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যারা ভীষণরকম রবিন্দ্রবিরোধী তাদের এই লেখাটা পড়তে কোন দোষ নেই, আর যারা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমাদের সাহিত্য তথা শেকড় কল্পনা করতে পারেন না মূলত তাদের জন্য আমার কিছু প্রয়াস এখানে সন্নিবিসিত। কারো ভালো লাগতে পারে অথবা নাও পারে, ব্যক্তি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে আমার লেখা শুরু করলাম। যাদের আরও বেশি অমত থাকবে তাঁরা অনুগ্রহ করে লিঙ্ক গুলতে ক্লিক করতে পারবেন[/su


আমাদের শেকড়, রবিন্দ্রনাথ ও ঠাকুরবাড়ি।


বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মেছিলেন ১৮৬১ সালে, আর পরলোকগমন করেন ১৯৪১ সালে। ইতিহাস সবারই জানা যে তিনি ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও পৃথিবীর নামকরা ছোট গল্প লেখিয়েদের অন্যতম।
পরিচয় পর্বে আর উল্লেখ্য যে কলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর বাড়িতে তিনি জন্মেছিলেন। যেখানে ভারতবর্ষের আর নামকরা অনেক মহর্ষি জন্মেছিলেন। নামকরা চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, ব্রাহ্ম ধর্মের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর , গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ।
রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ইংরেজদের অনেক আনুকূল্য লাভ করেন, পরবর্তীতে তার পৃষ্ঠপোষকতায় রাম মোহন রায় ব্রাহ্মধর্মের প্রচার শুরু করেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও ব্রাহ্মধর্মের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, গোঁড়া হিন্দু ধর্মের বিপরীতে একেশ্বরবাদী ধর্মের গোড়াপত্তন করতে যেয়ে তাদের অনেক শ্রম ও সাধনা ব্যায় করতে হয়েছিল, কিন্তু ঠাকুর বাড়ির সবায় প্রগতিশীল ও কুসংস্কার মুক্ত ধর্ম পালন সত্ত্বেও কিভাবে বাড়ির সকল পুরুষের নামের শেষে হিন্দুদের পরম শ্রেষ্ঠ দেবতা “ইন্দ্র” এর নাম যোগ হয়েছিল তা বিস্ময়কর! একি ভাবে বাড়ির সকল নারীর নামের শেষে “দেবী” যোগ করা হয়েছিল, যেমনঃ যোগমায়া দেবী, কাদম্বরি দেবী, সুনয়না দেবী প্রমুখ।

ছোট বেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা বিকশিত হতে থাকে, আধুনিক সাহিত্যের চর্চা বাড়িতে আগে থেকেই ছিল, চাচাদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে বিলেতের অনেক প্রকাশনা ও সাময়িকী তার হাতে এসেছিল। এ থেকে তিনি তার মেধা শানিত করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাছাড়া বিলেত থেকে আগত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ কলকাতায় এসে ঠাকুর বাড়িতেই যাতায়াত করতেন বেশি, সেই সুত্রে তাদের সান্নিধ্য তিনি লাভ করতেন।
আইন পড়তে তিনি বিলেত গেলেন এবং ফিরেও এলেন, বাবা দেবেন্দ্রনাথ ভাবলেন অন্যকিছু। তারমধ্যে তিনি শক্তিমান এক জমিদারের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিলেন। সে জন্য অনেক কে ডিঙ্গিয়ে তিনি রবিন্দ্রনাথকেই মনোনীত করলেন কুষ্টিয়া অঞ্চলের জমিদার, এক্ষেত্রে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ অন্য রকম অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, কাছ থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্রিয়া কলাপ দেখতে পেরেছিলেন, যাদের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল গরিব মুসলমান চাষি। এইখানে তিনি আরেকটি অসাধারণ বিষয়ের সাথে পরিচিত হতে পেরেছিলেন, সেটা হল লালন দর্শন । যেটা তাকে গীতাঞ্জলী লিখতে (???) সাহায্য করেছিল।

শাহজাদপুর- কুষ্টিয়া অঞ্চলের জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের অত্যাচার তৎকালীন কলকাতাই কাঙ্গাল হরিনাথ সম্পাদিত পত্রিকায় এসেছিল, ঠাকুর বাড়ির এই মহরশি-জমিদারদের কটাক্ষ করে হরিনাথ লিখেছেন “ ধর্মমন্দিরে ধর্মআলোচনা আর বাহিরে আসিয়া মনুষ্য শরীরে পাদুকা প্রহার- একথা আর গোপন করিতে পারিনা।“ ( অশোক চট্টোপাধ্যায়- প্রাক ব্রিটিশ ভারতীয় সমাজ, পঃ ১২৭, ১৯৮৮)
কাঙ্গাল হরিনাথ ছিলেন অত্যাচারিত, ভুক্তভোগী ও নির্ভীক সাংবাদিক। তিনি তখনকার গ্রাম বার্তা প্রকাশিকায় এসব সাহসের সাথে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি আর লিখেছেন, “ ইত্যাদি নানা প্রকার অত্যাচার দেখিয়া বোধ হইল পুষ্করিণী ও জলাশয়াস্থ মৎসের যেমন মা-বাপ নাই; পশু পক্ষি ও মানুষ , যে জন্তু যে প্রকারে যেমন ইচ্ছা মৎস্য ধরিয়া ভক্ষন করে, তদ্রুপ প্রজার সত্ত্ব হরন করিতে মহর্ষি জমিদারেরা অনন্য। (অপ্রকাশিত ডায়েরি- কাঙ্গাল হরিনাথ, চতুষ্কোণ, আষাঢ়, ১৩৭১)

হরিনাথের এসব লেখার জন্য ইংরেজ প্রশাসন তথা লেফতেন্যান্ত গভর্নর মিঃ ক্যাম্বেল সেখানকার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দেবেন্দ্রনাথের পরামর্শে বদলি করলেন। ( অশোক চট্টোপাধ্যায়- প্রাক ব্রিটিশ ভারতীয় সমাজ, পঃ ১২৮)
জমিদারীর এমন এক অশান্ত সময়ে রবীন্দ্রনাথ এলেন হাল ধরতে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তার ১৪ নম্বর পুত্র রবিন্দ্রনাথকেই এই পরিস্থিতে রাজ্য সামলানোর যোগ্য লোক হিসেবে মনোনীত করলেন, এ এক আশ্চর্য বিষয়। অত্যাচার, শোষণ, চাবুক, চাতুরি, প্রতারনা- কলাকৌশলে রবীন্দ্রনাথই কি যোগ্যতম ছিলেন তার পিতার বিবেচনায়? অনেকের মতে তার পিতৃদেব ভুল করেন নি।
অনেকেই হয়ত জানেন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উছিলায় জমিদারদের কর দিতে হত, যা অনেক হৃদয় বিদারক। গরুর গাড়িতে মাল আনা নেওয়া করলে রাস্তায় ধুলো উড়ত, তাই এই করের নাম ছিল “ধুলট”,
প্রজা নিজের জায়গায় গাছ লাগালেও কর দিতে হত তার নাম ছিল “চৌথ”, আখের গুড়ের জন্য ছিল “ইক্ষু কর”, ভাগাড়ে মরা গবাদি পশু ফেলতে লাগত “ভাগাড় কর”, নৌকায় লাগত “কয়ালি”, ঘাটে নৌকা ভিড়লে লাগত “খোটা গাড়ি কর”, জমিদারদের সঙ্গে দেখা করার কর ছিল “নজরানা” জমিদার জেলে গেলে তাকে ছাড়াতে লাগত “গারদ সেলামি কর”- এই যখন একটা জমিদারীর স্বরূপ তাহলে সেখানে কেমন করে বিশ্ব কবি তার জীবনের বেশ কয়েকটি বছর এই অমানবিকতার সাথে জড়িত ছিলেন? এ প্রশ্ন রবীন্দ্র দর্শনের বিরধিতার জন্যয় নয়- এ প্রশ্ন খুব সাধারন জিজ্ঞাসু মনের প্রশ্ন নয়কি?
ঠাকুর বাড়ির এমন শঠ ও দ্বিমুখী নীতির অনেক প্রমান পাওয়া যায়, যেমন রাজনারায়ন বসু তার আত্মচরিত তে লিখেছেন, “ ব্রাহ্ম হওয়া সত্ত্বেও দেবন্দ্রনাথ তার বাবার শ্রাদ্ধ করেছিলেন হিন্দু রীতিতে, রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন অনুষ্ঠানে পৈতে নেওয়া নিয়ে একটা গল বাধে, ব্রাহ্ম রীতিতে তার কিছু বিধি নিষেধ ছিল, কিন্তু সেখানে তা মানা হয়নি। এমনকি অনুষ্ঠানে আমার উপবেশন করা নিয়ে আমাকে শুদ্র বলে গালি দিতেও তাদের কার্পণ্য হয়নি”
ঠাকুর বাড়ির আরেক শঠতা হল হিন্দুশভা তৈরি করা। এই সভাটিই ১৮৬৯ সালে জাতীয় সভা হিসেবে রুপ লাভ করে। নবগপাল মিত্র ন্যাশনাল পেপারে লেখেন যে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের বাদ দিয়ে এই সভাকে জাতীয় সভা বলা যায়না। তারপর মনমোহন বসুর তিব্র বিরোধিতায় তা আর গৃহীত হয়নি, এবং তাতে দেবেন্দ্রনাথের প্রস্রয় ছিল।

ঐতিহাসিকদের মতে হিন্দু -মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপিত হয়েছিল অই জাতীয় সভাকে কেন্দ্র করে। ঠাকুর বাড়ির এইরকম দ্বিমুখী নীতি ও ইংরেজ প্রসাসনে তাদের প্রভাব পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম সমাজে কেবলি হতাশার মেঘ ঘনীভূত হচ্ছিল। কলকাতা কেন্দ্রিক অর্থনীতি, শিক্ষা বাবস্থা, পূর্ববঙ্গকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিল। সেই সময়কার পরিস্থিতি নিয়ে ডঃ মুহাম্মাদ শহিদুল্লাহ লিখলেন তার “আমাদের সাহিত্যিক দারিদ্রতা” প্রবন্ধে-
“ কি পরিতাপের বিষয়, আমাদের শিশুগন কে প্রথমেই রাম শ্যাম গোপালের গল্প পড়িতে হয়। সে পড়ে গোপাল ভালো ছেলে। কাশেম আব্দুল্লাহ কেমন ছেলে, সে তাহা পড়িতে পারেনা। এখান হয়তেই তাহার সর্বনাশের বীজ রোপিত হয়। তারপর সে বিদ্যাসাগরের কথা, কৃষ্ণকান্তের কথা, অরজুনের আক্ষান, সিতা- সাবিত্রীর গল্প পড়িতে থাকে। সম্ভবত তাহার ধারনা জন্মিয়া যায়, আমরা মুসলমান ছোট জাতি, আমাদের মধ্যে বড়লোক নেই। এই সকল পুস্তক দ্বারা তাহাকে জাতিয়ত্তহীন করা হয়। ... মুল পাঠ্য ইতিহাস সম্বন্ধে ওই কথা। তাহাতে বুদ্ধদেবের জীবনী চার পাতা আর মুহাম্মদের জীবনী অর্ধপাতা মাত্র। অথচ ক্লাসে একটি ছাত্র ও হয়ত বুদ্ধ নহে। আর অধিকাংশ ছাত্র মুসলমান। ইতিহাস পাঠে হিন্দু বীরপুরুষদের অগৌরব অধ্যায় সমূহ ঢেকে ফেলে মুসলমান মনিষীদের দুর্বলতা সামনে আনা হয়।। ফলস্রুতিতে একটা অসামঞ্জস্য হীনমন্যতা তৈরি হয় আর তাহাতে ইহায় প্রতিপাদ্য হয় যে মুসলমান একটা নীচ জাতি, তাহারা বর্বর আর তাহাদের দ্রুত বিনাশই মঙ্গল। ( দ্রষ্টব্য “আমাদের সাহিত্যিক দারিদ্রতা” - ডঃ মুহাম্মাদ শহিদুল্লাহ)

ডঃ শহিদুল্লাহ যা অনুমান করেছিলেন আক্ষরিক অর্থে তাই হয়েছিল। জোড়াসাকো কেন্দ্রিক আধুনিক হিন্দু সমাজ প্রতিষ্ঠায় সেটাই ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছিল। ব্রাহ্ম সমাজের মুল থেকে সরে গিয়ে ঠাকুর বাড়ি স্পষ্টতয় হিন্দুত্ব বাদের দিকে যাচ্ছিল।

ঠাকুর বাড়ির সবচেয়ে ঘৃণিত ও অমানবিক সিদ্ধান্ত ছিল বঙ্গ ভঙ্গের বিরোধিতা করা। ইংরেজদের এ সিদ্ধান্তে কলকাতার ঠাকুর বাড়ি কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তার কারণও ছিল, কুষ্টিয়া শাহজাদপুর এর জমিদারীর সবটুকুই প্রায়ই পূর্ববঙ্গে পড়ে যাচ্ছিল, আর তাতে সবচেয়ে ক্ষতি কার হত তা সহজেই অনুমেয়।
ডঃ বিমলান্দ “ভারত কিভাবে ভাগ হল” পুস্তকে লিখেছেন-
বাঙালি হিন্দুদের বাংলা ভাগের বিরোধিতা করার প্রধান কারন ছিল, পূর্ববঙ্গে বাঙালি মুসলমানেরা যাতে যোগ্য স্থান না পেতে পারে সেই আকাঙ্খার দরুন। বাঙালি হিন্দুরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি যে, তারা বাংলা ভাগের বিরোধিতা করে এবং সেই সাথে স্বরাজ লাভের দাবি করে তারা একদিন পূর্ব ও পশ্চিম উভয় বঙ্গের শাসক করে তুলবেন। “ ( পঃ ২৫, ১৯৮১)
ডঃ আম্বেদকার আরও স্পষ্ট ভাষায় বললেন-
“১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দলন সারা ভারতবর্ষে সৃষ্টি করল দুটি জাতীয়তাবাদ- একটি হিন্দু অপরটি মুসলিম। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯০৬ সালে ঢাকায় জন্মলাভ করল নিখিল ভারত মুসলিম লীগ । ... আর ১৯০৬ সালেই সাধারন ভাবে কংগ্রেস হয়ে দাঁড়াল হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান আর কাল ক্রমে তারই প্রতিযোগী হয়ে দাঁড়াল মুসলিম লীগ” । (পঃ ২৫)
কলকাতার আকাশ বাতাশ কাপিয়ে তাঁরা বিক্ষোভ করতে লাগলেন, রবীন্দ্রনাথ তার পারিবারিক কারনেই মাঠে নামলেন, ১৯০৫ সালের ২৪ ও ২৭ সেপ্টেম্বর কলকাতায় দুটি সভা হল, যাতে রবীন্দ্রনাথ, আমাদের প্রানের কবি, যাকে ছাড়া আমাদের বৈশাখ প্রভাত অচল, যাকে ছাড়া আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ভাবা যায়না- তিনিই , ভালো করে শুনুন, হাঁ তিনিই রবীন্দ্রনাথ পর পর দুটি বিক্ষোভ সভায় সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন, আর পূর্ব বঙ্গের জন্মের বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯০৫ সালের ১৬ অকটবার “রাখিবন্ধন” উৎসবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি চান নি তার প্রানের মুসলমান ভাইয়েরা আলাদা হোক, তিনি রাখিবন্ধনে আমাদের আবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকায় বসে নিদারুন নিঃসঙ্গতায় ভুগছিলেন, তার আসে পাশে কাউকেই পাচ্ছিলেন না।
রবীন্দ্রনাথ তারপরও না ঠেকাতে পেরে গান লিখলেন- “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি” ( গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি, তাই এর সঠিক রচনাকাল জানা যায় না। সত্যেন রায়ের রচনা থেকে জানা যায়, ১৯০৫ সালের ৭ অগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত একটি প্রতিবাদ সভায় এই গানটি প্রথম গীত হয়েছিল। এই বছরই ৭ সেপ্টেম্বর (১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র) সঞ্জীবনী পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সাক্ষরে গানটি মুদ্রিত হয়।)

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই সর্বনাশা গানটি আজ আমাদের জাতীয় সঙ্গীত! কি ভয়ঙ্কর দ্বিমুখী রবিন্দ্রপ্রেমে আমারা মশগুল, যে পাগল সেও কখনও এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়না।

তারপর দু বছরের চেঁচামেচিতে বঙ্গ আবার জোড়া লাগল, পূর্ববঙ্গের মানুষ হল হতাশ। এরপর রবীন্দ্রনাথের শেষ বিদ্রূপটা আমরা দেখি ১৯১২ সালে। ২রা ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করল ঢাকায় তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় করবেন আবার বিপত্তি বাধল। কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা আবার বিক্ষোভে ফেটে পরলেন। এখন প্রশ্ন জাগে কেন, কেন এখানেও বিরোধিতা? শিক্ষার প্রসারেও কেন বাধা হয়ে দাঁড়ালো কলকাতার সুশীল সমাজ? উত্তরটা খুবই সাধারন, এবং ভয়ঙ্কর রকমের সাম্প্রদায়িক। ভাটির মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে এটা হতে পারেনা, সুতরাং ঠেকাও। কটুটুকু হিনমন্ন না হলে শিক্ষিত সমাজ এমন বর্বর আচরন করতে পারে। এবং যথারীতি এখানেও রবীন্দ্রনাথ , ১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে বিরাট সমাবেশ হয়, আমাদের প্রানের কবি সভায় বক্তব্য দিলেন সে সভার সভাপতি, কবির বয়স তখন ৫১। সভায় সিদ্ধান্ত হল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হতে দেয়া হবেনা। কবির সঙ্গে আর ছিলেন ডঃ রাসবিহারি ঘোষ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভি সি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, গিরিশ্চন্দ্র ব্যানারজি প্রমুখ। আরও লজ্জার বিষয় এই শিক্ষিত দলতি আশুতোষের নেত্রিত্তে লর্ড হার্ডিঞ্জ কে স্মারকলিপি দিতে গিয়েছিলেন। ( জীবনের স্মৃতি দ্বীপে- ডঃ রমেশ্চন্দ্র মজুমদার)

তারপরও রবীন্দ্র প্রতিবাদীরা তখন ছিল, কিন্তু ব্রিটিশ আনুকুল্লে তাঁরা হারিয়ে গেছেন। যেমন দিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনাথের ভাবের অস্পষ্টতা অ নৈতিক স্খলনের কথা স্পষ্ট বলেছিলেন। বিপ্লবি বিপিঞ্চন্দ্র পাল ও রাধাকমল মুখোপাধ্যায় ছিলেন কবির কড়া সমালোচক। জতিন্দ্রনাথসেন গুপ্ত, মহিতলাল মজুমদার ও বুদ্ধদেব বসু ছিলেন সে সময়ের মহারথি। ( রবিন্দ্রবিরধি সমালোচনা- দীপন চট্টোপাধ্যায়)
আরও –
“ কবি রবিন্দ্রনাথকে দয়ার প্রতিমূর্তি বলে আমরা অনেকে মেনে নিলেও জমিদার রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তার বিপরিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সামন্তবাদ জমিদার ছিলেন। শাজ্জাদপুরের ইসমাইল মোল্লা দফায় দফায় খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিদ্রোহ করেছিলেন”। (জমিদার রবীন্দ্রনাথ- অধ্যাপক অমিতাভ চৌধুরী। দেশ- ১৪৮২ শারদীও সংখ্যা।)

প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় ও কম যান নি, তিনি বলেছেন-
“শান্তিনিকেতনে একটি চাকরি পেয়ে তার সরকারি চাকরি ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হলেন জমিদার মর্জির, ঠিক নেই, কখনো আবার চাকরি নষ্ট করে দিলে তার খাবার অভাব হবে। রবীন্দ্রনাথ ইন তলারেন্ত (অসহিশ্ন) ছিলেন। যে মাস্টার তার কথার ব্যত্যয় করত তার চাকরি থাকতনা”। ( দৈনিক বাংলাবাজার, ১৯৯৭, এপ্রিল)

আরও আছে, জালিওলানবাগ নিয়ে তার সময়ক্ষেপণ প্রতিবাদ, গগন হরকরার সাথে শঠতা, লালনের পান্দুলিপি ধংস করা ইত্যাদি।

কালের পরিহাস, গতকাল বৈশাখ গেল, তার আগে পহেলা (উর্দু) বসালে হয় পহেলা বৈশাখ। যা রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়া অচল। সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুখরিত হয় রবীন্দ্রনাথের গানে, পরিহাস!!
আরও পরিহাস রবীন্দ্রনাথের সেই গানটিই হতে হল বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। যার সুর টিও তিনি নিয়েছিলেন অবৈধ ভাবে, যার (গগন হরকরা ) কৃতজ্ঞতা কখনো তিনি স্বীকার করেন নি। কলকাতার সমাজ এখনও ১ বৈশাখ কে সেভাবে পালন করেনা, যেখানে আমরা দাবি করি তারায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের সোপান। তবে কিসের জন্য ভুলে ভরা ইতিহাস আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি, কেন আমারা ইতিহাস বিমুখ?
ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ কে হেয় করা কখনয় আমার উদ্দেশ্য নয়, আমার উদ্দেশ্য কেবল এই দ্বিমুখী আচরন সত্ত্বেও কেন আমরা আমাদের শেকড়কে রবীন্দ্রনাথের দিকে ফিরিয়ে আনি?
কেন আমরা অন্ধের মত কলকাতা কেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে নিজেদের অস্তিত্ব খুজে ফিরি?
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×