somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যা কিছু আমার সেতো আসলে আমাদেরই, আমাদের সবার......

১৫ ই এপ্রিল, ২০১২ বিকাল ৩:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আর দশটা সাধারণ, শহুরে,পরিবারের মত মোটামুটি শিক্ষিত পরিবারে জন্ম নেয়ায় এবং বেড়ে ওঠায় আমি আমাদের প্রতিদিনের তিনবেলা খাবারের আয়োজনে কখনও 'পান্তাভাত' পাইনি। জানিনা মা কেন আমাকে শেখাতে ভুলে গেছেন যে 'পান্তাভাত' আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার! মা নিজেও তা জানেন (মানেন!) কিনা পুরোপুরি সন্দেহ হয় আমার। তবে, আমার মায়ের এই জানাজানির স্বল্পতা আমাকে কিন্তু কখনও বিভ্রান্ত করেনি। বরং অনেক কিছুতেই সমৃদ্ধি দিয়েছে। আড়ম্বর বা চাকচিক্যের চোখ ঝলসানির আরোপিত আনন্দ থেকে মুক্ত রেখেছে। বুকের ভেতর স্বকীয়তা, সত্য, বিশুদ্ধতা আর গরলের মধ্যকার পার্থক্য এবং কোমলতা, ভালবাসা আর শান্তির জয়-জয়কার নিয়ে যাবতীয় চ্যুতি-বিচ্যুতির দ্বন্দের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে শিখিয়েছে। তাহলে মা'তো আর কম দেননি। কৃতজ্ঞতার কী শেষ আছে!

ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমাদের বাড়ীতে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে সকালবেলা পতাকা উত্তোলন হয়। সেইসাথে 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি'- জাতীয় সঙ্গীতে সবার কন্ঠ মিলে এক অসাধারণ উদ্দীপনায় হৃদয়স্পর্শী এক আবহ তৈরী হয়। শীতের সকালের খানিকটা সময় আপনজনদের সাথে ঘরে বসে সেই শহুরে নাস্তায়, চায়ে এবং মিষ্টিমুখেই শেষ হয় আয়োজন। এই একত্রীততার মূল্য অনেক।

ব্যক্তিগতভাবে আমার মধ্যে একটি অদ্ভূত অনুভূতির বিষয় আছে, যেকোন পরিবেশেই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত আমাকে অস্থির করে তোলে। কী ভয়াবহ সুন্দর সৃষ্টি! অতুলনীয়, মোহময়..। চোখর কোনে, মনের কোনে একই ঘটনা ঘটে সেই অমর সৃষ্টি 'আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' কানে এলে। অজানা কারণে কিংবা অকারণেই আমার চোখ ভিজে উঠে।

বাড়ীতে নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন ও মৃত্যুদিনে আমার মায়ের প্রবল ইচ্ছায় উৎসাহে পরিবারের আপনজনদের নিয়ে একটা অপূর্ব বিকেলের আয়োজন করা হত। ফুলের সৌরভ, একটুখানি গান, কবিতা আর সংশ্লিষ্ঠ ছোট ছোট আলোচনায় মূখর হয়ে সেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে যেত। ১১ই জৈষ্ঠ্যের উদযাপনে মনে করে ফুলদানীতে বাড়ীর বাগানের গন্ধরাজ এবং কাঠের পেয়ালায় দু'মুঠো বেলীফুল রাখা হতো। ২২শে শ্রাবণের আয়োজনে রজনী গন্ধার স্নিগ্ধতার পাশাপাশি একগুচ্ছ কদমফুল সবার নজরে রাখতে ভূল হতোনা। মা আমার দক্ষ নির্দেশক। এমন আলোচনায় প্রসঙ্গত নানান সময়ে লালন, হাছন রাজা, আব্বাস উদ্দিনসহ বাংলার আরও কতসব গৌরবময় বিষয় উঠে আসতো। এরপর মা সবার জন্য একটু রাতের খাবারের আয়োজন রাখতেন।

এইতো সেদিনের কথা! আমাদের ভাই-বোনদের বিয়ে-সাদীর কারণে বিচ্ছিন্নতা, পড়শোনা এবং কাজের জন্যে বিদেশে বসবাস, সর্বোপরি মায়ের অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে এখন আর তেমনটা হয়ে ওঠেনা। তবুও সুযোগ হলেই হয়।

আমাদের সবার সাধারণ গড়পরতা জীবনে খানিকটা আনন্দ আর একটু রঙের স্পর্শ দিতে যদি আমরা কোন কিছুকে উপলক্ষ্য করে একটি সত্যিকারের সুন্দর সময় বার করে নিতে পারি তবে ক্ষতি কী। আবার সেটা নিয়ে খুব করে আড়ম্বরই বা কী দরকার, যা সবার আয়ত্বের বা নাগালের বাইরে? বাড়ীতে মাটির বাসনে আমি কোনদিনই খাইনি। মা বা পরিবারের কাউকেই খেতে দেখিনি। কোনদিনই ৩০০০ টাকায় এক কেজি ইলিশের স্বাদ জানিনি। অভিভাবকের বা নিজের কষ্টার্জিত পয়সার মর্মান্তিক অপচয় করে বৈশাখ বরণ কখনও করতে শিখিনি। মেলায়, রেস্তোরঁায় মাটির বাসনে সুসজ্জিত হীরকমূল্য ইলিশের গরম ছাপিয়ে মনগড়া পান্তাভাত, কাঁচালঙ্কা আর এটাসেটার বিনিময়ে নির্লজ্জ অর্থ সঁপে দিতে দেখিনি আমাদের মা-বাবাদের।

আমাদের বর্ষবরণ মানেই রমনার বটমূলের সঙ্গীতময় কোমল সকাল, চারুকলার নজরকাড়া শিল্পকর্ম, ঢোল, বাঁশি, বাউল গান, মেলা, আরও কত কী। দুপুরে বাড়ী ফিরে মায়ের হাতের বিশেষ খাবার। এর সবটুকু আমার চির চেনা, চির আপন। আমার মত এমনভাবেই বড় হয়েছে এদেশের শহুরে এবং সাধারণ সব পরিবারের সন্তানেরা। চাওয়া-পাওয়ার সীমাটিও কম-বেশী শিখে-বুঝে বড় হয়েছে তারা।

তবে আজ কেন এই দ্রুত সভ্যতা, প্রযুক্তিময় স্মার্টনেস এবং সত্যের সুযোগ্য প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠার যুগে, এগিয়ে যাওয়ার মোক্ষম সময়টিতে আমার সন্তানকে, আমাদের অনুজকে ঐ মেকী, অবুঝ আর নির্বোধ উদযাপনে উৎসাহী করে তুলবো? কেন ওদের বোধ আর মননের মিশ্রণে একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সহযোগিতা থেকে সরে থাকবো? কিভাবে আমি আমার মায়ের কাছে শেখা সব সুন্দর, সব অর্জন ধুলিস্যাৎ করে দিই? প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আমাদের কি আরও বেশী বাস্তবমূখী আর দায়িত্বশীল হয়ে ওঠার কথা নয়? মানুষের সৌন্দর্যের প্রধাণ বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায় বিনয় আর পরিমিতিবোধ। আমাদের পরিমিতি বোধ আমাদের সন্তানদের অনুকরনীয় হোক, সেটাইতো হওয়ার কথা।

আমার দেশ, আমার সংস্কৃতি, আমার ঐতিহ্য, আমার নদী, আমার মাটি, আমার ইতিহাস, আমার মা, আমার সন্তান আমারই থাকুক, আমাদেরই থাকুক। এর সবটাই আমার গৌরব, আমাদের গৌরব।

নববর্ষের শুভেচ্ছা সবাইকে। মঙ্গলময় হোক আমাদের প্রতিদিন।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১২ রাত ১১:১২
৩৬টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রোড জ্যাম ইন ভিয়েতনাম

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৭



আমার ধারনা ছিল জটিল জ্যাম শুধু বাংলাদেশেই লাগে । কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিল । ভিয়েতনামে এরকম জটিলতর জ্যাম নিত্য দিনের ঘটনা । ছবিটি খেয়াল করলে দেখবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×