somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিত্তের সঙ্গে একদিন----- কেভিন রুজ

১৫ ই এপ্রিল, ২০১২ সকাল ১০:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমি নিউইয়র্ক টাইমসের একজন সাংবাদিক। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে লেখালেখিই আমার পেশা। টাকার কুমিরদের পেছনে ঘুরে ঘুরে তুলে আনি অনেক অজানা ও না বলা খবর। খবরের পেছনের খবর। ওয়ালস্ট্রিটের অনেক হাঁড়ির খবরই আমার টেপ রেকর্ডারে সংরক্ষিত আছে। কোটিপতি থুড়ি পড়বেন বিলিয়নীয়রদের খুব কাছ থেকে দেখে, তাঁদের সম্পর্কে জেনেছি, মানুষকে জানিয়েছি। কিন্তু আজ আমার অ্যাসাইনমেন্ট একটু আলাদা, বেশ রোমাঞ্চকরও। আমার অ্যাসাইনমেন্ট—একদিনের জন্য ‘বিলিয়নীয়র হওয়া’। একদিনের জন্য ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যের মধ্যে থেকে অসীম বিত্তের অধিকারীদের ভেতরের ব্যাপারগুলো বের করে নিয়ে আসা।
কাজটা হাস্যকরই বটে। একদিনের জন্য ঐশ্বর্যের অনুষঙ্গগুলো উপভোগ করে ঐশ্বর্যধারীদের সম্পর্কে আর কতটুকুই বা জানা যায়। তার ওপর পৃথিবীময় ‘ওয়ালস্ট্রিট দখল করো’ আন্দোলন যখন সমর্থন পাচ্ছে সাধারণ মানুষের, যখন বিত্তবানদের করপোরেট কারসাজি সাধারণ মানুষের জন্য গলার কাটা হয়ে দেখা দিয়েছে, যখন করপোরেট সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে তীব্র জনমত, তখন আমার এই ‘একদিনের বিত্তবান’ সাজা একটু হাস্যকরই হয়ে যায়। তার পরও চাকরির খাতিরে মানুষকে কত কিছুই না করতে হয়। আমি না হয় ‘বিত্তবান’ই সাজলাম।
আমার এই অ্যাসাইনমেন্টের প্রথম ধাপ হিসেবে আমাকে চড়তে হবে সাড়ে তিন লাখ ডলার মূল্যের একটি ঝা চকচকে রোলস রয়েসে। সেই রোলস রয়েসে চেপে আমাকে যেতে হবে বিমানবন্দরে। সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে একটি ব্যক্তিগত জেট বিমান। যে জেট বিমানে আমার সঙ্গে কথা বলবেন একজন বিলিয়নীয়র। তাঁর সঙ্গে উপভোগ্য ঐশ্বর্য নিয়ে কথা বলতে হবে আমায়।
সাড়ে তিন লাখ ডলারের সেই রোলস রয়েসের ভেতর ঢুকে মাথা ঘুরে গেল। বাইরে থেকে দেখলে অতটা বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরে জায়গার প্রশস্ততা যেন মনে করিয়ে দেয় ফুটবল খেলার মাঠের কথা। ক্রিম রঙের সিট কাভার ও অভ্যন্তরীণ পরিবেশের কোথাও যেন পুরোনোর ছোঁয়া নেই। পায়ের নিচে ভেড়ার লোমের গালিচা। গাড়ি যখন চলছিল, তখন মনে পড়ে গেল নিজের ব্যক্তিগত জীবনাচারের কথা। ব্রুকলিনে মাথা গুঁজতে পারা যায় কোনোমতে, এমন একটি বাসায় আমার বাস। বাসা থেকে কর্মস্থল যাওয়ার পথে খুব কম সময়ই সাধারণ ট্যাক্সি ব্যবহার করি আমি। বেশির ভাগ যাতায়াত করি কোনো না কোনো গণপরিবহন কিংবা হেঁটে।
আজ আমার প্রথম গন্তব্য মিডটাউনের ‘কোর ক্লাবে’। যাতে সদস্য হতে প্রতি মাসে খরচ করতে হয় ১৫ হাজার ডলার। বছরে ৫০ হাজার ডলার। ব্ল্যাকস্টোন গ্রুপের স্টিফেন এ স্কোয়ারজম্যান ও থার্ড পয়েন্টের ড্যানিয়েল এস লোয়েবসহ আরও অনেকেই এই কোর ক্লাবের সদস্য। দুজনই বিত্তবান। এঁদের বিলিয়নীয়র বললেও কম বলা হয়।
প্রথমেই কথা হলো কোর ক্লাবের স্বত্বাধিকারী জেনি এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে। তিনি বললেন, কোর ক্লাবের বিশেষত্বই হলো এখানে বিত্তবানেরা নিজেদের দৈনন্দিন ব্যস্ততা পেছনে রেখে একান্ত কিছু সময় কাটিয়ে যান। বিত্তবানদের সেই নীরবতা, সেই আরাম-আয়েশ ও সুযোগ-সুবিধারই সংস্থান করে কোর ক্লাব।
কোর ক্লাবেই আমি আমার প্রাতরাশ সেরে নিলাম। এবার আমার ব্যক্তি মালিকানাধীন সেই জেট বিমানে চড়ার পালা। জেট বিমানটি একজন বিলিয়নীয়রের। আমি সেখানে পৌঁছে দেখি সেই বিলিয়নীয়র সাহেব আগেই উপস্থিত হয়েছেন। কিছুটা লজ্জা পেলাম। আমি একটা ব্যাপার জানতাম, যেকোনো ব্যক্তিগত বিমানের মালিক বিমানে উঠে গেলে সেখানে আর কাউকে উঠতে দেওয়া হয় না। দেখলাম সেই বিলিয়নীয়র ভদ্রলোক এ ক্ষেত্রে অনেকটাই উদার। তিনি আমাকে যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গেই সম্ভাষণ জানালেন। বিমানে আমাকে বসতে দেওয়া হলো অত্যন্ত আরামদায়ক একটি চেয়ারে। একজন সেবিকা আমাকে স্বাগত জানালেন কফি ও দইয়ের তৈরি অত্যন্ত সুস্বাদু পাই দিয়ে।
বিলিয়নীয়র ভদ্রলোককে দেখেই মনে হলো, পোশাক-আশাকে আমি একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছি। তাঁর পরনে অত্যন্ত সাধারণ জিন্স ও পাতলা সোয়েটার। পায়ে পাতলা স্নিকার্স। মোজা পরেননি।
আর সময় নষ্ট না করে আমার মূল কাজে চলে গেলাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় একজন বিত্তবান হয়ে তাঁর অনুভূতি। খুবই সাধারণভাবে তিনি বললেন, ‘আমার তো আলাদা কিছু মনে হয় না।’ আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি ধনী হয়ে সুখী তো!’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘দেখুন, সুখটা নিজের মধ্যকার ব্যাপার। কেউ অনেক সম্পদ নিয়ে সুখী থাকে। কেউ কেউ আবার প্রাচুর্যতে হতাশায় ভোগে, মনে করে তাঁর আর কিছুই পাওয়ার নেই। আমি সত্যিই সুখী আমার এই প্রাচুর্য নিয়ে।’
সি আইল্যান্ডে বিমান নামার পরপরই আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল বিলাসবহুল এক মার্সিডিজ বেঞ্জ। সেই গাড়িতে বিলিয়নীয়র সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়িতে। বাড়ি না বলে একে প্রাসাদ বলাটাই ঠিক হবে। পুরো প্রাসাদের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা একটি পাঁচ তারকা হোটেলের চেয়েও বেশি বিলাসবহুল। বাড়িতে পৌঁছেই তিনি বললেন, ‘আসলে ঈশ্বরের সিদ্ধান্তেই আমি আজ এক বিত্তশালী।’ বলার সময় ঈশ্বরের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতা যেন দৃশ্যমান মনে হচ্ছিল।
বলাবাহুল্য, বিলিয়নীয়র সাহেব তাঁর বাড়িতে খাতির যত্নের চূড়ান্ত করেছিলেন।
আমার আগ্রহ ছিল সম্পদশালীদের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে। সি আইল্যান্ড থেকে বিমানে করে আমি আ বার ফিরলাম নিউজার্সি। সেখানে আমার দেখা হলো স্টিভ রবিনহো নামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। তিনি একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ। প্রতি ঘণ্টায় আড়াই শ ডলার নেন তাঁর সেবার জন্য। তিনি বললেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা খুব কষ্টকর। তবে একবার যদি সেটা আয়ত্তে নিয়ে আসা যায়, তাহলে সেটা অভ্যাস হয়ে যায়।
আমার এই অ্যাসাইনমেন্টে আরেকজনের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি একজন সাবেক শরীরচর্চাবিদ। নাম জন সিতারাস। এ মুহূর্তে একটি শরীরচর্চা কেন্দ্রের মালিক। বহু ধনীকে তিনি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, এখনো দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি প্রশিক্ষণ দিয়েছেন জেনারেল ইলেকট্রিকের প্রধান জন এফ ওয়েলচ জুনিয়রকে। তাঁর হাতেই শরীরচর্চায় ঋদ্ধ হয়েছেন ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান পল এ ভোলকার। তাঁর শরীরচর্চা কেন্দ্রে নিয়মিত যেতে গেলে মাসে ১৩ হাজার ডলার গুনতে হয়। বুঝলাম, শরীরকে ফিট রাখতেও আর সবার চেয়ে অনেক এগিয়ে বিত্তবানেরা। বিত্তের এমনই বৈভব!
বিত্তবানেরা সত্যিকার অর্থেই মানসিকভাবে কেমন থাকেন? এই প্রশ্ন অনেক দিন ধরেই ছিল আমার মধ্যে। অ্যাসাইনমেন্টের সুযোগে তা করে ফেললাম মনোবিদ গ্রুবম্যান সাহেবের কাছে। তিনি আমার প্রশ্ন শুনে হাসলেন, বললেন, ‘আসলে বিত্তবানেরা যে যা-ই বলুক, আসলে তারা মানসিকভাবে খুব একা। তাদের কোনো বন্ধু নেই। নিরাপত্তা ব্যবস্থা, শান-শওকত, আলিশান বাড়ি-ঘর আর রোলস রয়েস ও মার্সিডিজের চক্করে তাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায় সাধারণত্ব। আর এই সাধারণত্বই মানুষকে সুখ দিতে পারে। অন্যকিছু নয়। দেখবেন তারা মানসিকভাবেও খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।’
গ্রুবম্যানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজেকে খুব সুখী মনে হলো। সুখের মাত্রাটা টের পেলাম পরের দিন। যখন আমার অ্যাসাইনমেন্ট শেষ, নিউইয়র্ক শহরের ভিড় ঠেলে আমি ছুটছি আমার কর্মক্ষেত্র ওয়ালস্ট্রিটে। মেট্রো স্টেশনে ঢুকেই কফি শপে ক্যাপাচিনোর অর্ডার দিলাম। ক্যাপাচিনোর মগে চুমুক দিয়ে দেখলাম এর স্বাদ আগের চেয়ে অনেক বেশি ভালো লাগছে। আমি সুখী, আমি একজন সাধারণ মানুষ।
বেঁচে থাকুক আমার এই সাধারণ জীবন!
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অলীক সুখ পর্ব ৪

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৮ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৪৫

ছবি নেট

শরীর থেকে হৃদয় কে বিচ্ছিন্ন করে দেখতে চেয়েছি
তুমি কোথায় বাস করো?
জানতে চেয়েছি বারবার
দেহে ,
না,
হৃদয়ে?
টের পাই
দুই জায়গাতে সমান উপস্থিতি তোমার।

তোমার শায়িত শরীরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামে ভুল থাকলে মেজাজ ঠিক থাকে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৫


বেইলি রোডে এক রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে একজন একটা পোস্ট দিয়েছিলেন; পোস্টের শিরোনামঃ চুরান্ত অব্যবস্থাপনার কারনে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডকে দূর্ঘটনা বলা যায় না। ভালোভাবে দেখুন চারটা বানান ভুল। যিনি পোস্ট দিয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

চলুন দেশকে কীভাবে দিতে হয় জেনে নেই!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৫১

চলুন দেশকে কীভাবে দিতে হয় তা জেনে নেই৷ এবার আপনাদের সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি ঘটনা শেয়ার করবো৷ আমি কোরিয়ান অর্থনীতি পড়েছি৷ দেশটি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ১৯৭০ সালের পর থেকে প্রায় আকাশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৮

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ২৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৪


আজকের গল্প হেয়ার স্টাইল ও কাগজের মোবাইল।






সেদিন সন্ধ্যার আগে বাহিরে যাব, মেয়েও বায়না ধরল সেও যাবে। তাকে বললাম চুল বেধে আসো। সে ঝটপট সুন্দর পরিপাটি করে চুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×