somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৈশাখী পিছুটান

১৪ ই এপ্রিল, ২০১২ সকাল ১০:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের বাড়ি একেবারে অজপাড়া গাঁয়ে। সেই সূত্রে বৈশাখ নিয়ে আমার কিছু সমৃতি এখনো মনে দাগ কেটে আছে । বৈশাখ মাসের জন্য আমরা সারাটি বছর অপেক্ষা করতাম। কখন দিনটি আসবে। পয়সা জমাতাম,,,, দশ, পঁচিশ,পঞ্চাশ পযসা। আর এক টাকা হলেতো কথাই নাই। আসতো সেই প্রতিক্ষীত দিনটি।

আমার মা এদিনে সকাল হতেই বিভিন্ন ধরনের ফল নিয়ে বসতো। যাদের বাড়িতে বাংগি, তরমুজ নেই তাদেরকে দিত। কারণ আমাদের বাড়িতে এই ফল খুব হতো। আমাদের একটা আমগাছের আম এই মাসে পাকতো। এই গাছের আমকে আমরা বৈশাখী আম বলতাম। খুব মিষ্টি ছিল আর সিঁদুর লাল ছিল। আরও একটা গাছ ছিল ,,,সেটার আম পাকার আগেই শেষ হয়ে যেত। সেটার নাম ছিল কাঁচামিঠা আম। ওহ কাঁচা আমই কি মিষ্টিরে বাবা। আমার বোন বলতো, মা তুমি সব ফল অন্যদের দিও, শুধু ঐ গাছের আম দিও না। মা বলতো সবাইকে নিয়ে না খেলে গুনাহ হবে।

গ্রামে নিমাই যাত্রা পালা বা কোথাও থিয়েটার হতো। আমার সবচেয়ে মজা লাগতো ছেলেরাই মেয়ে সাজতো। আর খুব কষ্ট লাগতো যখন দেখতাম নিমাই সংসারের সব কিছু ফেলে চলে যাচ্ছে,,,,,ওহ্ আমি ব্যা ব্যা করে কান্না করতাম,,,,,আর আমার বোন বলতো ''তোকে আর নিয়ে আসবো না'',,,,,,,,ভাই বলতো ,''দূর পাগলী এটা তো অভিনয়''।

বাড়ির একেবারে কাছেই বসতো মেলা। মেলায় যাওয়ার জন্য সকাল হতে কত প্রস্তুতি। লাল সবুজ রংএর ফিতা দিয়ে আমার আপা চুলগুলো বেধে দিতেন। আর জমিয়ে রাখা পয়সাগুলো জামার পকেটে রেখে দিতাম। সকাল ১০টার দিকে একবার চলে যেতাম,,,,,,,,,বাড়ির সবাইকে ফাকি দিয়ে। তখন ঝাল চানাচুর খেতাম, সুন্দর মেঝেন্টা কালারের বরফ কুচি খেতাম বট পাতায় করে। একজন লোক বলতো,,,,,,,,,''পোলাপাইন আইসো তারাতারি,,,,,,,,,চোখ রাখ এইখানে,,,,,,,,,তা না হইলে চইলা যাইব''। দৌড়াইয়া যাইয়া বসতাম, চোখ রাখতাম খুব যতন করে,,,,,,,,,আর ঐ লোকটি বলতে থাকতো,,,,,,,,''এইবার আইসা যাইব,,,রহিম রুপবান তারাতারি,,,,,এই কিবা সুন্দর দেখা গেল... রহিম রুপবান চইলা গেল,,,,,,,,পরীবানু আইসা গেল,,,,,কি মজা লাইগা গেল''। আমার মোহ আর কাটে না। কি সুন্দর,,,,,,,,,আরো কত সুন্দর সুন্দর ছবি আসছেরে বাবা। আর সেই সময় আমাদের বাড়ির কাজের মেয়েটি বলতো,,,,,,,,,,তোমার খবর আছে,,,,,,,তোমার বাবা ডাক দিসে। আমি পরিমরি করে ছুটতাম বাড়ির দিকে। ভাবতাম আহারে কি সুন্দর করে দেখছিলাম। আর অল্পের জন্য সবটা দেখা হলো না।

আমাদের মত ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সব আমাদের পুকুরে গোসল করতো। বড়রাও করতো। সবাই আমাকে ডাকতো,,,,লায়লারে তারাতারি আয়,,,,,,,সাঁতার কাটবি। আমি দেখতাম ছেলেরা আমাদের পুকুরের পাড়ে মার্বেল খেলছে, কেউবা কাঁচা আমা গাছের সাথে ফাটিয়ে খাচ্ছে। আমি আর আমার বোন ঝাপিয়ে পড়তাম পুকুরে,,,,,,,,,মা বকা দিত,,,,বেশি ক্ষণ গোসল না করার জন্য। কিন্তু আয়েস করে গোসল তো করতেই হবে। সবাই মিলে আলোচনা করতাম কে কি কিনবে, কি খাবে,,,,,। আমার হিন্দু বান্ধবী, বন্ধুরা গল্প করতো তাদের বাড়িতে কি কি রান্না হয়েছে। ওরা আমাদের নিমন্ত্রন করতো ওদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য।

আমাদের বাড়িতে এবং গ্রামের প্রায় সকল বাড়িতে এ দিনে ১৩ রকমের শাক দিয়ে একটা শাক রান্না করতো। এটিকে সংক্ষেপে তেরাবেরা বলত। আরো রান্না হতো কই মাছের ঝোল, পুটি মাছ ভাজি, ছোট মাছের চচ্চরী, সজনে ডাল, বেগুন ভাজি, ডালের বড়া, ভর্তা আর গরম গরম ভাত। মাকে বলতাম , মা ঐ শাকটা একটু বেশিই দাও,,,,,,,আমার বোন শুধু মাছ খেত। মা বলতো সবাইকে তেরাবেরা দিতে হবে,,,বেশি দেয়া যাবে না,,,,,,,,,,সবাই মিলেমিশে একটু একটু করে খাও।

ভাই আর তার বন্ধুরা (হিন্দু মুসলামন) মিলে মেলায় বিভিন্ন লোকগীতি, ভাটিয়ালি, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া গান বাজাত। মাইক দিয়ে সকলকে সুন্দরভাবে মেলায় অংশগ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করতো। যাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য কমিটি গঠণ করা হতো।

খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আবার মেলায় যাওয়ার প্রস্তুতি ,,,, তখন ভাইবোন সব মিলে যেতাম মেলায়। কখনো আব্বা আবার কখনো ভাই এতে লিড দিত। ভাই বলতো একটা ডাব খাবি। একেবারে প্রাণটাই জুড়িয়ে যাবে। বলতাম নাহ্ ওই বরফ কুচি খাব আর একটা দুধের মালাই খাব। আহ্ কি আনন্দ আকাশে বাতাসে,,,,,,,,,,সাথে ফাও ফাও পেয়ে যেতাম একটা ডাব,,,,,,,,রসগোল্লা খেতাম। আব্বা কত বাহারি রংএর খেলনা, চুরি, ফিতা, নকসা করা ছোট হাড়ি, বিন্নি ধানের খই, বাতাসা কিনে দিত। আব্বা মার জন্য তাল পাতার পাখা, মাটির হাড়ি, সারা বছরের তেজপাতা কিনতো। আমি তাল পাতার বাঁশির জন্য বায়না ধরতাম। কিন্তু আমার আব্বা আমার আরেক ভাইকে তাল পাতার বাঁশি, বাঁশের বাঁশি, রং করা সুন্দর মাছ, রং করা হরিণ, রং করা বাঘ, বল, ঘুড়ি কিনে দিত। আর আমাদের কিনে দিত পুতুল। আমার মন খুব খারাপ হতো। আমার বড় ভাই বলতো আবার এই বছর ফিরে এলে তোদের জন্য ঐসব কিনে দিব। কিন্তু আমার ঐ তাল পাতার বাঁশি আর রংএর ঘুড়িটার দিকে বেশি নজর থাকতো। আব্বাকে বায়না ধরতাম,,,,,,,,ঐ যে নাগর দোলা ,,,ওটাতে চরবো আব্বা। আব্বা আমাদের নাগর দোলাতে চরতে সুযোগ করে দিতেন। ফিরে আসতাম মেলা থেকে। কতই না শান্তি শান্তি ভাব থাকত মনের কোনে। মেলা হতে ফিরার পথে চরকা ঘুরানো দেখতাম। একটা মানুষকে চরকায় বরশি বেধে কিভাবে ঘুরানো হত। লোকটির কোন কষ্টই হতো না।

আমাদের গ্রামসহ আরো আশে পাশের গ্রামে অনেক হিন্দু পরিবার বাস করতো। আমরা সবাই মিলে মিশে থাকতাম। যখন ঘট ডুবানো হতো। আমার বায়না থাকতো,,, আমার ঐ সুন্দর ঘটটাই চাই,,,,,,,,, আমাদের এক প্রিয় দাদা বলতো, তোরে ঐ পুচকে ঘটটা দিব। আমি মন খারাপ করতাম,,,,,,,,, দাদা বলতো তোরা সবাই চোখ বন্ধ কর, আমরা সবাই চোখ বন্ধ করতাম। চোখ খুলেই দেখতাম,,,,,,সুন্দর ঘট। ওহ সে এক মহাখুশীর প্রশান্তি বয়ে যেত মনে।

আমাদের সমবয়সীরা বলতো, সন্ধায় ভুত তারানো হবে, আমরা ভুত তারানো দেখবো। দেখতাম,,,,বড় বড় বাঁশের লাঠিতে আগুন ধরিয়ে কিছু লোক গ্রামময় ঘুরছে, তারা ভুত তারিয়ে দিচ্ছে, গ্রামে আর কোন রোগ বালাই হবে না। ভয়ে একেবারে একাকার হয়ে যেতাম,,,,,,এই বুঝি ভুত এল। কোন কোন বৈশাখে দেখতাম কিছু লোক বুকের উপর বিভিন্ন ধরনের উল্কি একে মুখে হরেক রকম মুখোস পরে নাচ দিচ্ছে,,,,এ সময় পূজা হতো,,,,ঢোলের শব্দে চারদিক মুখোরিত থাকতো। আমরা প্রসাদ খেতাম। কিছু প্রসাদ আমাদের বাড়িতে দিয়ে যেত।

গ্রামে চলতো সকাল থেকেই একটা উৎসবের ভাব। হাল খাতা চলতো। মিষ্টি, গুড়ের পায়েস, চিরা, মুড়ি, গুড়ের পাক দেয়া খই, সাথে থাকতো আরো দই। আরো থাকতো বাহারী ফলের সমাহার। ওহ্ সেই স্বাদ এখনো জিহ্বায় লেগে আছে। ,,,,,,,,,,,,কিন্তু এখন কি হচেছ!!!!!!!!!!!!!!! পানতা ভাতের সাথে ইলিশ!!!!!!!!!!!!!! আমি এটা জীবনেও দেখি নাই। আমি দেখেছি একেবারে কাছ হতে,,,,সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের দেখেছি পানতা ভাত খেতে, করকড়া ভাত ( ভাতের ভিতর পানি না দিয়ে সকালে যে ভাত খাওয়া হয়) খেতে। সেই ভাত বাসি তরকারি দিয়ে, কাঁচামরিচ, ভর্তা, শুকনা মরিচ পুড়ে খেতে দেখেছি। আমি বাংলাদেশের বড় বিভাগীয় শহর, বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলায় গিয়েছি (চাকুরী সূত্রে)। ইনফরমালি তাদের কথা প্রসঙ্গে জিঞ্জাসা কিরেছি তারা পানতা ভাতের সাথে ইলিশ মাছ খায় কিনা,,,,,,,,। কেউ কেউ বলেছে ভাত তরকারিই পাই না,,,,,,,তার উপর ইলিশ, ওটাতো বড়লোকের খাবার। টাঙ্গাইলের একজন চাষী বলেই
ফেলেছে,,,,,,,,''আমাগো নিয়া তামাশা করে ''। আমি মনে করি গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের সাথে এক ধরনের রসিকতা। অন্তত আমার খারাপ লাগে এই ভেবে যে গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের নুন আনতে পানতা ফুরিয়ে যায় আর সেখানে পহেলা বৈশাখ এর দিনে শহুরে মানুষেরা পানতা ভাতের সাথে ইলিশ খাবেই খাবে। আর এই ইলিশ না দিলে অনেক সংসারে লাগে ঝগড়া।

আহারে, কোথায় গেলোরে আমার গুড়ের পায়েস!!! চিরা, মুড়ি খই!!!!!!!!!!!!!!!!!! আর কোথায় গেলরে আমার তেরাবেরা

সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে এপ্রিল, ২০১২ দুপুর ১২:৩৯
৪৯টি মন্তব্য ৪৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×