somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা নববর্ষে টাইটানিক অর্কেষ্ট্রার গল্প

১৪ ই এপ্রিল, ২০১২ রাত ২:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সবাই তাকে ‘জক’ (Jock) নামে চিনে, আসল নাম জন ল’ হিউম। বয়স মাত্র ২১ বছর। খুব ভালো ভায়োলিন বাজাতে পারেন, ইতিমধ্যেই অনেক সুনাম হয়েছে। এর আগে পাঁচ বার সমুদ্রযাত্রায় গিয়েছিলেন। এবারো যাবেন। এবারের যাওয়াটা অবশ্য এক বিশাল ব্যাপার। বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো জাহাজ ‘আরএমএস টাইটানিক’-এর প্রথম সমুদ্রযাত্রার অর্কেষ্ট্রা দলের সদস্য হিসেবে তিনি যাবেন। ১০ এপ্রিল, ১৯১২ সালে জক তার প্রেমিকা মেরী কস্টিনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজে উঠলেন। বিদায় নেবার আগে জানিয়ে গেলেন, এবারের সমুদ্রযাত্রা শেষেই তিনি মেরীকে বিয়ে করবেন।


জন ল হিউম

দলটিতে বয়সে সবচেয়ে বড় হচ্ছেন ওয়ালেস হার্টলি, তিনি আবার টীম লিডারও বটে। বয়স ৩৩ বছর। ওয়ালেস হার্টলির ব্যান্ড দল সরাসরি টাইটানিকের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘হোয়াইট স্টার লাইন’-এর অধীনে ছিলো না। লিভারপুলের একটি ফার্মের মাধ্যমে তারা টাইটানিকে কাজ করার সুযোগ পায়। প্রত্যেকেরই টিকেট নম্বর ছিলো একটিই- ২৫০৬৫৪, তারা সবাই ছিলেন ২য় শ্রেণীর প্যাসেঞ্জার লিস্টে।


ওয়ালেস হার্টলির ঘড়ি

রজার মেরী ব্রিকক্স- টাইটানিক অর্কেষ্ট্রার একমাত্র নন-বিটিশ এবং বয়সে সবচেয়ে ছোট, মাত্র ২০ বছর। এই ফরাসী সেলিস্ট (Cellist) হার্টলির টীমে যোগ দেবার আগে টীমের আরেক পিয়ানিষ্ট থিওডর রোন্যাল্ড ব্রেইলীর সাথে ‘আরএমএস কারপাথিয়া’-তে বাজাতেন। ব্রেইলী সেই সময়েই স্পিরিচুয়ালিস্ট হিসেবে যথেষ্ঠ পরিচিত ছিলেন।


রজার মেরী ব্রিকক্স

জন ওয়েলেসলি উডওয়ার্ড। টাইটানিকের আগেও ‘আরএমএস অলিম্পিক’-এ করে সমুদ্রযাত্রার সময় দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিলেন, কিন্তু সেটা তার জাহাজে বাজানো বন্ধ করতে পারেনি। বরঞ্চ প্রথমবারের মতো তার সেরা সেলোটা নিয়ে টাইটানিকে হার্টলির টীমে জয়েন করেন।

টাইটানিক অর্কেষ্ট্রাতে আরো ছিলেন- জন ফ্রেডেরিক প্রেস্টন, জর্জেস অ্যালেক্সজান্দ্রে এবং পার্সে কর্নেলিয়াস টেইলর।


টাইটানিক অর্কেষ্ট্রা

এই দলে আটজন সদস্য থাকলেও তারা দুইটি ইউনিট হিসেবে কাজ করতেন। তাদের কাজের সময় এবং জায়গা- দুটোই ছিলো আলাদা। ওয়ালেস হার্টলিসহ পাঁচ জন বাজনা বাজাতেন চা-পানের সময়, ডিনারের পরে, রবিবারে। বাকী তিনজনের দলটি পিয়ানো, সেলো এবং ভায়োলিন বাজাতেন ‘এ লা কারটে রেস্টুরেন্টে’র বাইরের রিসেপশনে এবং ক্যাফে প্যারিসিয়ানে। এই দুইটি ইউনিট টাইটানিকে কখনোই একসাথে বাজায়নি টাইটানিকের শেষ সময়ের বাজনা ছাড়া।

১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিলের মধ্যরাত। The Unsinkable Titanic- আটলান্টিকে ভাসমান বরফ খণ্ডের সাথে ধাক্কা খেয়ে ডুবতে শুরু করলো। টাইটানিকের যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই তখন ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিলো না, যে যার কাজে নিমগ্ন থাকলো। কিছুক্ষণ পরে যখন যাত্রীদেরকে প্রথম শ্রেণীর লাউঞ্জে অবস্থান নিতে বলা হলো, অধিকাংশ যাত্রীই বুঝতে পারলো না কী করবে। টাইটানিক অফিসিয়ালদের কোনো একজনের অনুরোধে হার্টলি তার টীম মেম্বারদের প্রথম শ্রেণীর লাউঞ্জে জড়ো করে শুরু করলেন, তাদের সেই বিখ্যাত কিন্তু মর্মন্তুদ সিম্ফনী। এই প্রথমবারের মতো তারা আটজনেই একসাথে বাজালেন।

লাউঞ্জে গানের ব্যাপারটা ছিলো কিছুটা সময় নষ্ট করার মতো। টাইটানিকের বোটগুলো তখনো সাগরে নামানোর জন্য তৈরী হচ্ছিল, সেই সময়টাতে যাত্রীদের কেউ যাতে বাইরে বেরিয়ে না এসে, সে ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলো টাইটানিক অফিসিয়ালরা। হার্টলি তার টীম নিয়ে সেই কাজটিই করে যাচ্ছিলেন। অর্কেষ্ট্রার বাজনার জন্য বেশীর ভাগ যাত্রীরা ছিলেন নিরুব্দিগ্ন।

এক সময় ঘোষণা দেওয়া হলো মহিলা আর শিশুদের লাইফবোটে উঠার জন্য। যাত্রীরা চলে এলো ফার্স্ট ডেকের কাছে। হার্টলিরাও চলে এলেন সেখানে- বাজনা চলতে থাকলো, কেউ থামতেও বললো না, কেউ বাজানো চালু রাখতেও বললো না। কিন্তু তারা বন্ধ করলেন না।

টাইটানিকের সেই শেষ মুহুর্তে তাদের প্রত্যেকের মনে কি ভাবনা চলছিলো সেটা অনুমান করাও কষ্টকর। তারা আটজনই কি ভেবেছিলেন এই বাজানোই তাদের জীবনের শেষ বাজানো? তাদের কারো মনে কী সামান্যতম বাঁচার আশা কি দোলা দিচ্ছিল? তারা কি অপেক্ষায় ছিলো, শেষ মুহুর্তে টাইটানিকের কোনো অফিসার তাদেরকে লাইফবোটে উঠতে বলবে? আজ আর কিছুই জানার উপায় নেই!

কি বাজাচ্ছিলো এই অসম সাহসী আট সঙ্গীতজ্ঞ? বেঁচে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ননা অনুযায়ী, সেগুলো ছিলো 'Alexander's Ragtime Band' এবং 'In The Shadows’- এর টিউনগুলো। কিন্তু বিতর্ক দেখা দিলো শেষ গানটা নিয়ে। টাইটানিকের একেবারে শেষ মুহূর্তে কোন গানটা বাজাচ্ছিলেন হার্টলি আর তার “টাইটানিক অর্কেষ্ট্রা”?

প্রথম শ্রেণীর একজন কানাডিয়ান যাত্রী মিসেস ভেরা ডিক এবং আরো কিছু জীবিত প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, শেষ টিউন ছিলো, "Nearer, My God, to Thee". হার্টলি একবার তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন, যদি তিনি কোন ডুবন্ত জাহাজে থাকেন, তাহলে "Nearer, My God, to Thee" টিউনটি বাজাবেন। কিন্তু ওয়াল্টার লর্ড তার “A Night to Remember” বইতে টাইটানিকের ওয়ারলেস অপারেটর হ্যারল্ড ব্রাইডসের ১৯১২ সালে “New York Times”-এ বলা কথাটাকেই বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। সেখানে হ্যারল্ড বলেছেন তাদের শেষ টিউন ছিলো "Songe d'Automne". মিসেস ভেরা ডিক টাইটানিক ডুবে যাবার ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট আগেই লাইফবোটে নেমে গিয়েছিলেন, তাই তার পক্ষে সম্ভব নয় টাইটানিক অর্কেষ্ট্রার শেষ মুহূর্তের টিউনগুলো শোনা।


হিল্ডা মেরী স্ল্যাটার- টাইটানিকের জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী, টাইটানিক অর্কেষ্ট্রার কথা যিনি সর্বপ্রথম সবাইকে জানান

কর্নেল আর্চিবল্ড গারসি, ধারনা করা হয়, তিনিই শেষ ব্যক্তি যিনি টাইটানিক থেকে লাইফবোটে নেমেছিলেন। এই দুর্ঘটনার কারণেই তিনি আট মাস পর মারা যান। তিনি উদ্ধার পাবার পরই টাইটানিক অর্কেষ্ট্রা সম্পর্কে লিখে রেখেছিলেন এবং তার পরিবার সম্প্রতি তা জনসমক্ষে প্রকাশ করেছে। গারসি্র মতে, অর্কেষ্ট্রার বাজানো টিউনগুলো ছিলো সব উদ্দীপনামূলক, যদিও সেগুলোর কোনোটাই তিনি চিনতে পারেন নি। শেষ টিউন হিসেবে ‘Nearer, My God, to Thee’- এর দাবী সম্পর্কে তার বক্তব্য হচ্ছে, "I assuredly should have noticed it and regarded it as a tactless warning of immediate death to us all and one likely to create panic."

জর্জেস অ্যালেক্সজান্দ্রে, পার্সে কর্নেলিয়াস টেইলর, জন ওয়েলেসলি উডওয়ার্ড, থিওডর রোন্যাল্ড ব্রেইলী এবং রজার মেরী ব্রিকক্সের মৃতদেহ উদ্ধার করা যায়নি বা উদ্ধার করা গেলেও সনাক্ত করা যায়নি। ২০০০ সাল পর্যন্তও ফরাসী আর্মি রজার মেরী ব্রিকক্সকে ‘Deserter’ হিসেবে অফিসিয়ালী কাগজে দেখিয়েছে। ২০০০ সালেই Association Française du Titanic- এর সহযোগিতায় সরকারীভাবে ব্রিকক্সকে ‘Dead’ ঘোষণা করা হয়।

শুরু করা হয়েছিলো জন ল হিউমকে দিয়ে। শেষ করছি, জন হিউমের প্রেমিকা মেরী কস্টিনকে দিয়ে। হিউমের মৃতদেহ পাবার পরে জানা গেলো, মেরী কস্টিনের গর্ভে হিউমের সন্তান, হিউম জেনে যেতে পারলেন না!

(সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। শুভ ১৪১৯ )
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাইলট ফিস না কী পয়জনাস শ্রিম্প?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১২ ই মে, ২০২৪ সকাল ৭:৪০

ছবি সূত্র: গুগল

বড় এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পাশে ছোট ও দূর্বল প্রতিবেশী রাষ্ট্র কী আচরণ করবে ? এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অধিক্ষেত্রে দুইটা তত্ত্ব আছে৷৷ ছোট প্রতিবেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

জমিদার বাড়ি দর্শন : ০০৮ : পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২৪


পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি

বিশেষ ঘোষণা : এই পোস্টে ৪৪টি ছবি সংযুক্ত হয়েছে যার অল্প কিছু ছবি আমার বন্ধু ইশ্রাফীল তুলেছে, বাকিগুলি আমার তোলা। ৪৪টি ছবির সাইজ ছোট করে ১৮ মেগাবাইটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×