১
কাজ বন্ধ করে ভালো করে লোকটার দিকে তাকালো বাদল।হিসাবের মাঝখানে কেউ বাধা দিলে সে প্রচন্ড বিরক্ত হয়।আজ অবশ্য সে বিরক্ত হতে পারছেনা।কারন তাকে যে লো্কটা হিসাবের খাতা থেকে উঠিয়ে এনেছে তার কথা বলার ভঙ্গিতে স্পষ্ট যে সে ক্ষমতাবান।লো্কটার আপামস্তক ভাল করে দেখে নিলো বাদল।লোকটা কালো রঙের টিশার্ট, কালো রঙের প্যান্ট ও কালো রঙের জুতা পরা। এই রাতের বেলাও সে সানগ্লাস পরে আছে।সেই সানগ্লাসের ফ্রেমের রঙও কালো।লোকটার কালো প্রীতি দেখে বাদল বেশ অবাক হলো।ঝাড়ি মেরে ভাগিয়ে দিবে এই চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে দিয়ে বিনয়ের সাথে সে জিজ্ঞেস করলো – “কিছু বলবেন ভাই?”
“আপনিই বাদল?”
জ্বী।
“কি করেন আপনি?”
প্রশ্নটা শুনে যথেষ্ঠই বিরক্ত হলো বাদল।জনাব কালো সাহেব দেখতেই পাচ্ছেন যে সে একটা রড সিমেন্টের দোকানে বসে হিসেব করছে।এটা দেখেই তার বোঝা উচিত যে সে এই দোকানটা চালায়।মনে মনে বললো “শালার বুদ্ধিশুদ্ধিও মনে হয় কালা, দেইখাও বোঝেনা যে আমি কি করি।”
“ভাই এই দোকানটা আমার”
“ও আচ্ছা”
“পরিবারে কে কে আছে?”
বাদলের অনেক বলতে ইচ্ছে হলো “পরিবারে হাত দেন ক্যালা?” তবুও বিপদ না বাড়িয়ে সে বললো “ভাই, বউ আর এক ছেলে”
“আমাকে ভাই না বলে স্যার বলবে”
“স্যার, বউ আর এক ছেলে”
“ছেলে কি করে?”
“স্যার, এইবার স্কুলে ভর্তি হইলো।সে বানান কইরা নিজের নাম লিখতে পারে।”
কালো স্যা্র তার কালো রঙের সানগ্লাসটা একবার চোখ থেকে খুলে আবার পরে নিয়ে বললো।“আচ্ছা ঠিক আছে।তোমার সাথে পরে কথা হবে।”
২
করিম মাথা নিচু করে তার বসের সামনে দারিয়ে আছে।তার বসের নাম জহির খান।সারা দেশের মানুষ তাকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে এক নামে চেনে।এত বড় একজন মানুষের ডান হাত হতে পেরে করিম গর্ববোধ করে।আজ অবশ্য বস তার সাথে ভাল ব্যবহার করবে কিনা তা করিম বুঝতে পারছেনা।পাশের বাসার কোহিনূর বেগমকে সে অনেকদিন ধরে বশে আনার চেষ্টা করছিলো।আজ বাসায় কোহিনূরকে একা পেয়ে সে সোজা তার বাসায় ঢুকে যায়।অনেক্ষন মেয়েটার শরীর নিয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তির পর মেয়েটার খোলা শরীর দেখে করিমের কেমন যেনো লাগে।“এত দেমাগ কিসের তোর?” কথাটা উচ্চারন করতে করতে পকেট থেকে বের করা নতুন ছুরিটা ঢুকিয়ে দেয় কোহিনূরের নগ্ন বুক বরাবর।
খুনের দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই আনন্দে মনে মনে হাসে করিম।কালই সে একটা হিন্দী সিনেমায় ঠিক এইভাবে একটা মেয়েকে খুন করতে দেখেছে।আনন্দে পিচিক করে মেঝেতে একদলা থুতু ফেলতে নিয়েও চকচকা টাইলসের মেঝে দেখে থেমে গেল সে।
মুখের উপর কাপড় বেঁধে রাখায় চিৎকার করতে পারছিলোনা কোহিনূর।কিন্তু করিম মনে মনে সেই আর্তনাদটা শুনতে পারে।তরপাতে তরপাতে হঠাৎ করেই নিস্তেজ হয়ে যায় শরীরটা।এই নিস্তেজতার সাথে করিম পরিচিত।বিছানা থেকে নেমে একটা চেয়ারের উপর বসে একটা সিগারেট ধরায় সে।ঠান্ডা মাথায় কাজ করার জন্যে বসের কাছে তার একটা সুনাম আছে।কিন্তু আজ কোহিনূরকে বাসায় একা দেখে তার মাথাটা কেনো যেন আর ঠান্ডা রাখতে পারছিলোনা।দরজায় ঠক ঠক শব্দ শুনে করিম বুঝতে পারে তার পালানোর কোন উপায় নেই।ঠান্ডা মাথায় দরজাটা খোলে ও।একমাত্র সম্বল ছুরিটা নিয়ে হামলে পরে কোহিনূরের স্বামীর উপর।
কিন্তু ছুরিটা ঠিকমতো ঢোকেনি তা বোঝাই যাচ্ছে।আজ সকালের সব পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে করিমের ছবি এসেছে।শিরোনামে লেখা “আবারও কালা রিপনের হত্যাযজ্ঞ”।এত সমস্যার পরেও করিম নির্ভাবনায় তার বসের দিকে তাকালো।সবাই জানে তার বস কখনো কোন কর্মচারীকে ফেলে দেননা।
৩
বাদলের ছেলে আশরাফ যুদ্ধজয়ের ভঙ্গিতে তার বাবার দিকে তাকিয়ে হাসছে।এইমাত্র সে ঘরের দেয়ালে মোমরঙ দিয়ে তার বাবার নাম লিখেছে।বাদল একই সাথে আনন্দিত এবং ভীত।দেয়ালের দাগ লতিফা দেখতে পেলে বাপ ব্যাটা দুইজনেরই ঘর ছাড়া লাগতে পারে।চোখের পানি আটকাতে আটকাতে সে ফিসফিস করে তার ছেলেকে বললো – “আমার বুকে আয় বাপ।”আশরাফ হাসান এক লাফে তার বাবার বুকে এসে লেপ্টে পরে থাকে।তার চোখ দেখে মনে হয় এই উপহারটার জন্যই সে এত পরিশ্রম করে দেয়ালে লিখেছে।
বাদলের বউ লতিফা সুলতানা রাতের খাবার রান্না শেষ করে শোবার ঘরে এসে দেখে বাপ-ছেলে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।দুটো নিস্পাপ মুখের দিকে মায়াভরা চোখ নিয়ে অনেক্ষন ধরে তাকিয়ে থাকে লতিফা।
৪
আওলাদ হোসেন তার সুগঠিত দেহ টানটান করে সাবধান ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।জহির খানের সামনে প্রয়োজন ছাড়া কার মাথা তোলার অনুমতি নেই।তার পরনে কালো টি-শার্ট, কালো প্যান্ট ও কালো জুতা।বসের সামনে আসার পরে সে তার শখের কালো রঙের সানগ্লাসটা খুলে পকেটে রেখে দিয়েছে।
“তোমার কাজ শেষ?” ভরাট গলায় প্রশ্ন করলেন বস।
“জ্বী স্যার” আর্মির ভঙ্গিতে জবাব দিলেন আওলাদ হোসেন।ছোটবেলা থেকে তার আর্মিতে যোগদান করার ইচ্ছা ছিলো।পরীক্ষাও দিয়েছিলেন।কিন্তু মেডিকেল টেস্টের সময় বাদ পরে যান।আর্মি হবার সুপ্ত কিন্তু প্রবল ইচ্ছাটা এখনো তাকে পীড়া দেয়।
“নাম?”
“বাদল হাসান” জবাব দেয় আওলাদ
“ঠিকানা?”
ভাবলেশহীন মুখে আওলাদ ঠিকানা দিয়ে দেয়।আড়চোখে তাকিয়ে দেখে বসের প্রধান অপারেশনাল এক্সপার্ট করিম তার দিকে তাকিয়ে হলুদ দাঁত বের করে হাসছে।জহির খান তার মোবাইলটা বের করে একটা নাম্বার ডায়াল করে কানে দেয়।ওপাশ থেকে রিসিভ করার সাথে সাথে জহির খান একটি নাম ও একটি ঠিকানা উচ্চারন করেন।করিম এবং আওলাদ দুজনেই জানে তাদের বস বেশী কথা বলা মোটেই পছন্দ করেননা।
৫
আশরাফ হাসান স্কুল ছুটি হবার পর অবাক হয়ে আধাঘন্টা ধরে স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে তার বাবার জন্যে অপেক্ষা করছে।অবাক হবার কারন তার বাবা কখনো তাকে নিতে আসতে একটুও দেরী করেননা।স্কুলের দারোয়ান এই নিয়ে তৃ্তীয়বার তাকে বললো – “ভাইয়া, আপনের বাপ মনে হয় আজকে একটু বেশী ব্যস্ত।চলেন আপনেরে দিয়া আসি।অনিচ্ছাকৃত ভঙ্গিতে আশরাফ তাকে পৌঁছে দেবার জন্যে স্কুলের দারোয়ানকে অনুমতি দিল।
৬
আরামদায়ক একটা গাড়ীতে করে বাদলকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।গাড়ীতে তার সাথে আরও তিনজন মানুষ।ড্রাইভার ছাড়া বাকি দুইজনকে দেখে বেশ ক্ষমতাবান বলে মনে হচ্ছে।তাদের ক্ষমতার পরিচয় বহন করছে তাদের কোমর থেকে ঝুলে থাকা রিভলবার।গাড়ীতে ওঠার পর বাদল দুবার জিজ্ঞেস করেছে তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।লোক দুজন কোন উত্তর দেয়নি।এমনকি তারা নিজেদের সাথেও কোন কথা বলছেনা।গাড়ীর এসি অন করা।বাদল তবুও ঘামছে।অবাক হবার জন্যেও যথেষ্ঠ সুযোগ পাচ্ছেনা সে।দুপুর বেলা তার দোকানের সামনে একটা জিপ এসে থামে।গাড়ী থেকে নেমে এই লোক দুজন তাকে বলে জরুরী কাজে তাদের সাথে যেতে হবে।কালো রঙের পিস্তল দেখে বাদল কোন কথা না বাড়িয়ে গাড়ীতে উঠে বসে।তারপর থেকে কি হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছেনা বাদল।আকাশের রঙ আস্তে আস্তে আজকের তরে বিদায় নিচ্ছে।গাড়ীর গন্তব্য গাজীপুরের পথে।রাস্তাটা বাদলের অনেক পরিচিত।তার গ্রামের বাড়ী মানিকগঞ্জ।দু পাশে সরিষার ক্ষেত দেখে আশরাফের কথা মনে হলো বাদলের।তার ছেলের সরিষা ক্ষেত অনেক পছন্দ।তার গলা দিয়ে দলা পাকিয়ে উঠে আসতে থাকে বোবা কান্না।
৭
আশরাফ হাসান কাঁদতে পারছেনা।কারন মা তাকে বলেছে মেয়েরা কান্না করে।মেয়েদের আশরাফের খুবই অপছন্দ।তার প্রধান কারন তার ক্লাসের মেয়েরা তাকে পিচ্চি বলে ডাকে।তবে আশরাফ আজ রাতে অন্যভাবে বিদ্রোহ ঘোষনা করেছে।তার বাবা না আসা পর্যন্ত সে রাতে ভাত খাবেনা।ছেলেকে বকা দেবার মত মানসিক অবস্থা এই মুহূর্তে লতিফার নেই।সত্যি কথা বলতে তার নিজেরও খেতে ইচ্ছে করছেনা।ভাতমাখা প্লেটটা হাত থেকে রেখে লতিফা জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
“কোথায় গেলো লোকটা?”
৮
করিম আজ খুবই আনন্দিত।আনন্দের প্রধান কারন তার বস জহির খান আজ নিজে তাকে সি-অফ করতে এয়ারপোর্টে উপস্থিত হয়েছেন।করিম নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছেনা।সে আজ ইন্ডিয়া যাচ্ছে সেটাও আনন্দের আরেকটা বড় কারন।তবে সবচেয়ে তুচ্ছ কিন্তু একটু পর পর সবচেয়ে বেশী যে বিষয়টা করিমকে আনন্দ দিচ্ছে তা হলো বসের নির্দেশে দীর্ঘ এক বছর পর সে তার ঘন দাড়িগোঁফের জঙ্গল ফেলে দিয়েছে।গতবার ইন্ডিয়া থেকে আসার সময় সে তার এই দাড়িগোঁফের জঙ্গল সাথে করে নিয়ে আসে।করিম একটু পর পর বিভিন্ন জায়গায় তার নিজের চেহারা দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।পত্রিকায় যারা রিপনের কুকীর্তি নামে রিপোর্ট প্রকাশ করছে তারা পর্যন্ত তাকে এখন দেখলে চিনতে পারবেনা।বসকে কদমবুসি করে করিম এয়ারপোর্ট এর গেটের দিকে এগিয়ে যায়।গম্ভীর স্বরে পেছন থেকে জহির খান তাকে বললেন -
“তোমার জন্যে এই হাওয়া বদলটা মনে হয় একটু বেশীই প্রয়োজন ছিল করিম”
“সব আপনার ইচ্ছা বস”
“তোমাকে কতদিন নিষেধ করসি সব আপনার ইচ্ছা এই কথাটা বলবানা?”
অনেক বড় ভুল হয়ে গেসে এমন ভঙ্গিতে জিবে কামড় দিয়ে বসকে একটা হাসি উপহার দিয়ে এয়ারপোর্ট এর গেট দিয়ে ঢুকে গেলো করিম।সে এবং তার বস দুইজনই জানে করিম এই কথা আবারও বলবে।
পরিশিষ্ট
সকাল বেলা চা খেতে খেতে পত্রিকা খুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আওলাদ।অনাগ্রহের সাথেই প্রথম পাতায় ছাপা রিপোর্টটা পড়লো সে।
কুখ্যাত সন্ত্রাসী কালা রিপন ক্রসফায়ারে নিহত
ডেস্ক রিপোর্টঃ এগারোটি খুনের মামলার আসামী কোহিনূর বেগমের খুনী কুখ্যাত সন্ত্রাসী কালা রিপন গতরাতে গাজীপুরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে ক্রসফায়ারে নিহত হন।গতরাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখপাত্র এই ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন ।আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখপাত্র জানান সন্ত্রাসী কালা রিপনের অবস্থান নিশ্চিত করে গতরাত ১১টার দিকে তাদের সশস্ত্র দল কালা রিপনকে ধরার জন্য গাজীপুরে তার অস্থায়ী বাসস্থানে পৌঁছান।আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্তিত্ব টের পেয়ে গেলে কালা রিপন তাদের উদ্দেশ্য করে গুলি ছুড়ে।একপর্যায়ে নিরুপায় হয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী দল পাল্টা গুলি ছুড়লে ঘটনাস্থলেই কালা রিপন মৃত্যুবরন করেন।কালা রিপনের কোন আত্নীয় স্বজন না থাকায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে তাকে কবর দেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করা হয়।কালা রিপনের বর্বরতার স্বীকার কোহিনূর বেগমের স্বামী কালা রিপনের বিচার হয়েছে বলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানান।তাৎক্ষনিক এক প্রতিক্রিয়ায় গতরাতে স্বরাষ্ট্র্মন্ত্রী জানান তাদের সরকার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।তিনি আরো বলেন ভবিষ্যতেও সকল ধরনের অপরাধ ও অপরাধীকে কঠোর হস্তে দমন করা হবে।