somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি ঘরোয়া গল্প...............

২৭ শে মার্চ, ২০১২ দুপুর ২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তখন সবেমাত্র অনার্স ফাইনাল দিচ্ছি । আর দুইমাস পর ফাইনাল। তাই রাতদিন এক করে সারাবছর অবহেলায় পড়ে থাকা বইগুলোর গুষ্ঠী উদ্ধার করছি । এমন অবস্থায় বাবা একদিন তার রুমে ডেকে পাঠালেন । বাবাকে আমরা ৩ ভাইবোনই বরাবর ভয় পায়। আর সবার বড় হওয়ায় আমার ভয়টা মনে হয় একটু বেশী। দুরুদুরু মন নিয়ে গেলাম বাবার কাছে। বাবা গম্ভীর হয়ে বললেন, "তোমার পরীক্ষা কবে থেকে শুরু হচ্ছে?"
"এপ্রিলের ৩ তারিখ থেকে।"
"তাহলে তো মাঝখানে এখনো দুইমাস রয়ে গেছে। শুনো, কালকে বিকেলে ভালো জামাকাপড় পড়ে রেডী থাকবে । কালকে তোমার জন্য মেয়ে দেখতে যাবো। পছন্দ হলে কালকেই বিয়ে হবে। এখন যাও।"
নিজের কানে শুনেও বিশ্বাস করতে পারলাম না কি শুনলাম । যদিও আমার কোন মেয়ের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নেই তাই পারিবারিকভাবে বিয়ে করতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু এভাবে হুট করে বিয়ে করতে হবে কেন? বাবার মুখের উপর কথা বলবো এমন কথা আমরা কল্পনাও করিনা কখনো। তাই ওখান থেকে বের হয়ে মার কাছে গিয়ে বললাম আমি এখন বিয়ে করতে চাচ্ছিনা । মা জানালেন বাবা অনেক আগে থেকেই মেয়ে পছন্দ করে রেখেছেন । দেখতে যাওয়াটা একটা ছুটো মাত্র। তাই বিয়েটা যে হবে তার কোন সন্দেহ নেই। সেদিন সারারাত ঘুমোতে পারিনি । একবার ভেবেছিলাম বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। অনেক কিছু বিবেচনা করে সেটা আর করা হয়ে ওঠেনি। পরদিন ঠিকই আমরা নতুন বউকে নিয়ে বাড়িতে ফিরি। বিয়ে নিয়ে আমার যে আপত্তিগুলো ছিলো নতুন বউয়ের মিষ্টি মায়াময় মুখটি দেখে সব কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল । পরদিন থেকে আমাদের বাড়ির পরিবেশে যেন পরিবর্তনের হাওয়া লাগলো । নতুন বউ পায়ের নুপূরে ঝুনঝুন আওয়াজ তুলে সারা ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগলো। বাবার গাম্ভীরযের তলায় পিষ্ঠ হয়ে প্রাচীন মানুষের মতো মৃতপ্রায় বাড়িটা হঠাৎ যেন তার হারানো যৌবন ফিরে পেল । দুদিন আগে যার এ বাড়িতে কোন অস্তিত্ব ছিলো না আজ সে সবার মধ্যমণি হয়ে গেছে। দুদিনে সে সংসারে এমনভাবে কর্তৃত্ব স্থাপন করলো যে তাকে ছাড়া এখন সবই অচল লাগে। আমার ছোট দুই ভাইবোনকেও দেখি সারাক্ষণ ভাবী ভাবী বলে অস্থির । এতদিনে মার একটা মনের মতো সঙ্গী জুটলো দেখে মনটা ভালো হয়ে যায় । আমি দূর থেকে সবই উপভোগ করি । ছোটবেলা থেকে যে বাবাকে আমরা রাশভারী গম্ভীর বলে চিনতাম , যার সামনে আমরা মুখ ফুটে কখনো কিছু আব্দার করতে পারিনি, সেই বাবার সামনে সে দেখলাম অবলীলায় বলে ফেলে," আব্বা আপনি তো বিয়েতে আমাকে একটা লাল শাড়ীও দিলেন না। লাল শাড়ী ছাড়া কি নতুন বৌ নতুন বৌ লাগে?"
বাবাও দেখলাম হাসতে হাসতে বলছেন, " তাই তো রে মা, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।"
পরদিন বাবা ঠিকই তার জন্য একটা লাল জামদানী শাড়ী নিয়ে আসে । সারাদিন সে ঐ শাড়ী পরে ঘরময় ঝুন ঝুন নুপুরে আওয়াজ তুলে ঘুরে বেড়ায়।
এই চঞ্চলা রমণীকে আমি গোপনে টুনটুনি ডাকতাম।খেয়াল করলাম পুরো ঘর মাথায় তুলে রাখা এই চঞ্চলা রমণীটি আমার রুমে ঢুকেই কেমন চুপ হয়ে যায় । কিছু বললে কেবল হু হা করে উত্তর দেয় । বাড়ির অন্যান্যদের প্রতি তাই আমি একটু ঈর্ষাবোধ করতে থাকি।
দেখতে দেখতে আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে যায় । এরপর থেকেই সে একটু একটু আমার কাছে আসতে থাকে । ওর সব আব্দার যেন এখন শুধু আমাকে ঘিরেই। বাড়ি থেকে বের হতে গেলেই সে পথ আগলে দাড়াতো।কেনাকাটার একটা লম্বা লিষ্ট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতো ,"তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবা।" ইচ্ছে করেই আমি একটু দেরীতে বাড়ি ফিরতাম। তখন দেখতাম ও অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। ওর অভিমান ভাঙানো ছিলো আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। কারণ ঐ সময় অভিমান না ভাঙ্গা পর্যন্ত সে আমাকে জড়িয়ে বসে থাকতো। আর আমি টুনটুনি পাখিটার পালকতুল্য হাতটা ধরে নানা কথা বলে তার মান ভাঙ্গাতাম।
একদিন জানতে চাইলাম," বিয়ের প্রথম দিকে অমন দূরে দুরে থাকতে কেন?"
ও সহজ সরল ভাবে বললো, "বাহ্ রে , তোমার পরীক্ষা ছিলো না? তাই আব্বার কড়া হুকুম ছিলো তোমার পড়াশুনায় যেন ব্যাঘাত না করি।"

এভাবে প্রায় বছর খানেক হয়ে গেল। আমাদের বাড়ির পরিবেশটা অনেকটা সাভাবিক হয়ে এসেছে। এখন আর আমরাও কেউ বাবাকে ভয় পায় না। মা কে অনেকটা প্রাণবন্ত দেখায়। কিন্তু যেই টুনটুনি পাখিটার কিচিরমিচিরে বাড়িটা ভরে থাকতো সে যেন কেমন নিরুত্তাপ হয়ে গেছে। কিছু হয়েছে কিনা জানতে চাইলেও কিছু বলে না। একদিন রাতে ঘুমানোর সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বলে," ওগো, আমার মনে হয় মরণ রোগ হয়েছে। আমি আর মনে হয় বাচবো না।"
মনে হলো আমাকে সাই করে কেউ চাবুক মারলো। তবু শান্ত থাকার চেষ্টা করে বললাম," ধুর, কি উল্টাপাল্টা কথা বলছো। কি হয়েছে একটু খুলে বলো তো?"
ও বললো," আমার আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। সারাক্ষণ খালি মাথা ভার ভার লাগে। হাটতে গেলে মনে হয় পড়ে যাবো। আবার কিছু খেতে ইচ্ছে করে না । যাই খাচ্ছি সব বমি হয়ে যাচ্ছে।"
আমি বললাম," চিন্তা করোনা, কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।"
টুনটনির এই হঠাৎ পরিবর্তনে সবাই কমবেশী চিন্তিত হয়ে আছে। এরি মাঝে সবাই জেনে গেছে আমি ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। বাসায় ফিরে দেখলাম সবাই উদ্দিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে। ঢুকার সাথে সাথে সবাই মিলে প্রশ্নের বাণ ছুড়ে দিলো।সবাইকে শান্ত করে আমাদের পরিবারে নতুন অতিথির আগমনের খবরটা জানিয়ে দিলাম । সেদিনের টুনটুনির লজ্জামাখা মুখটি আমি কখনো ভুলবো না ।
আজ ও দুই সন্তানের গর্বিত মা। কিন্তু এতদিনেও তার চাঞ্চল্য একটুও কমেনি। বরং ছেলেদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে আরো একটু বেড়েছে। আমি খুব মন দিয়ে ওর ছুটোছুটি উপভোগ করো। ওর কপাট শাসনে আমি আজ সব দিক দিয়ে পরিপূর্ণ। শুধু একটা অপূর্ণতা এখনো রয়ে গেছে। ওকে আজও মুখ ফুটে বলা হয়নি , "টুনটুনি, আমি তোমাকে আমার নিজের থেকেও বেশী ভালোবাসি।"
পুনশ্চ: ওকে আজ পর্যন্ত মুখ ফুটে টুনটুনিও ডাকা হয় নি। জানি না কখনো হবে কিনা।
১৬টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভুল শুধু ভুল নয়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৬

এক
লেখাটা একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি। ১৯৯৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে শফিপুর আনসার একাডেমিতে বিদ্রোহ হয়। ৪ ডিসেম্বর পুলিশ একাডেমিতে অভিযান চালায়। এতে চারজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছিল। এটি ছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। VF 3 Mini: মাত্র 60 মিনিটে 27 হাজার বুকিং!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:০৪



আমার ব্যাক্তিগত গাড়ি নেই কিন্তু কর্মসূত্রে বেঞ্জ , ক্যাডিলাক ইত্যাদি ব্যাবহার করার সুযোগ পেয়েছি । তাতেই আমার সুখ । আজ এই গাড়িটির ছবি দেখেই ভাল লাগলো তাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ময়লাপোতার কমলালেবুর কেচ্ছা!! (রম্য)

লিখেছেন শেরজা তপন, ২১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩


বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাময়িক পোস্ট: বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন

লিখেছেন করুণাধারা, ২১ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন! view this link

সামহোয়্যারইনব্লগ থেকে কয়েকজন ব্লগার আলাদা হয়ে শুরু করেছিলেন সচলায়তন বা সংক্ষেপে সচল ব্লগ। এটি বন্ধ হবার মূল কারণ উল্লেখ করা হয়েছে দুটি:

১)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×