somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার দাদুর মৃত্যু

০৬ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৮:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘড়ির কাটায় তখন ভোর ৫ টা। এপ্রিল মাসের ৬ তারিখ। হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই দেখলাম মা-বাবার ঘরে বাতিটা জ্বলছে। একটু অবাক হলাম কারণ মা-বাবা নামায পড়লে এই সময় বাতি জ্বালান না। হুরমুরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দেখি মা শুয়ে শুয়ে এক হাত কপালে দিয়ে আরেক হাত দিয়ে তাসবিহ গুনছেন। আর বালিশের পাশে কোরআন শরীফ রাখা আছে।বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। যেই দু:সংবাদটির ভয়ে ছিলাম হয়তো তার জন্যই এরকম দেখছি, মনে মনে বললাম আর মা কে জিজ্ঞেস করতেই মা বললেন যে তিনি আমাদেরে মাঝে আর নেই...

আমার বাবা আর বড় চাচা আগে থেকেই অবস্থার অবনতি দেখে দাদুর কাছেই ছিলেন। আমার পাঁচ জন চাচা। আমরা একান্নবর্তী পরিবার। তাই মৃত্যূ সংবাদ পেয়ে সবাই মিলে ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে ঢাকা থেকে রওনা হলাম আমার দাদুর বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। ঠিক ৬:৩০ এ পৌছলাম দাদুকে শেষবারের মতো দেখতে। দাদুর মুখটা দেখে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। আবেগপ্রবণ হয়ে পরলাম।

দাদুর বাড়ির গাছগুলো যথারীতি হাওয়ায় দুলছিল, আকাশে সাদা মেঘগুলো প্রকৃতির নিয়মে ভাসছিলো। গাছে পাখিরা ডাকছিল মিষ্টি সুরে। চারদিকের পরিবেশ আগের মতোই ছিলো শুধু একজন মানুষের কমতি ছিলো... মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। মৃত্যুর কিছুদিন আগ পর্যন্তও দাদু আমার নাম ধরে ডেকেছেন আর কেঁদেছেন দেখার জন্য। এই কথাটি একজনের কাছে শুনে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। কারণ প্রত্যেকদিনের গদবাঁধা জীবনের ব্যস্ততায় নিয়মিত দাদুকে দেখতে যেতে পারতাম না কিন্তু ভীষণ মনে পড়তো।

বেশ কিছুদিন ধরেই লিভার ক্যান্সারে ভুগছিলেন দাদু। এই বছরের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ডাক্তার বলেছিলো, বেশিদিন আর নেই! এরপর থেকেই চাপা আতঙ্ক, এই বুঝি খারাপ খবরটা আসে! ডাক্তারের কথা শুনার পর থেকে বুকের ভিতরটা খুব যন্ত্রনা করতো। কেবলই মনে হচ্ছিল যে কি যেন নেই! কী যেন আমার থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। সবকিছুই যেন মনে হচ্ছিল শুকনো মরমরে পাতার মতোন। হাতে নিলেই মরমর শব্দে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আকাশের দিকে তাকালে মনে হতো যে এতো বিশালতার মাঝেও শূণ্যতার একটি ছাপ রয়েছে।

মানুষ এই রঙের দুনিয়াতে স্থায়ী নয়, এই নির্মম বাস্তবতা মেনে নিতে বড়ই কষ্ট হচ্ছে আজ। আর এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াতে এসে মানুষ তার অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে মশগুল হয়ে পড়ে, হয়তো ভাবেও না যে মহাকালের গর্ভে তাকে হারিয়ে যেতে হবে একদিন। হায় রে বাস্তবতা!

খারাপ খবরটা শুনার পর থেকে পুরো শরীর নিথর হয়ে আসছিল। কাউকে বুঝাতে পারছিলাম না তা। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল যে আমার জীবনে চলার পথের অনেক বড় একজন অনুপ্ররণাকে আমি আজ হারালাম। দাদুকে নিয়ে এই মুহুর্তে কিছু স্মৃতি আমাকে তাড়িত করছে ভীষণভাবে...
সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর দাদু নিজ গ্রাম রূপগঞ্জেই থাকতেন। মাঝে মধ্যে ঢাকায় তাঁর ছেলে-মেয়েকে আর নাতি-নাতনীকে দেখতে বেরাতে আসতেন। আজ মনে পড়ছে সেই দিনগুলোর কথা, যখন আমাদের ঢাকার বাড়ীতে গ্রাম থেকে দাদুর আগমন উপলক্ষে চলতো সেই রকম প্রস্তুতি। আমার মা আর চাচীরা মিলে দাদুর পছন্দের খাবারগুলো নিজ হাতে অতি যতোনে রান্না করতেন। দাদু মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসতেন, তাই আমি অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে তাঁর পছন্দের মিষ্টি কিনে নিয়ে বাসায় ফিরতাম, আর বাবা-চাচারা তো কিনতেনই। সেই মিষ্টি আর কেনা হবে না অতি আনন্দে। দাদুর পছন্দের খাবারগুলো আর রান্না হবে না অতি যতোনে। দাদুর আগমন উপলক্ষে আর ঘর গুছাতে হবে না। বেতনের টাকা দিয়ে আমি আর দাদুকে পাঞ্জাবি-ফতুয়া উপহার দিতে পারবো না। মনে পড়ে সেই দিনটির কথা যেদিন প্রথম আমার বেতনের টাকা দিয়ে সখ করে দাদুর জন্য একটি পাঞ্জাবি কিনেছিলাম। দাদু তো মহা খুশি হয়েছিলেন আমার উপহার পেয়ে।একবার পরীক্ষা শেষে বেরাতে গিয়েছিলাম দাদুর কাছে। দাদু তো আমাকে দেখে বেশ খুশি হয়ে হাতে পাচঁশত টাকা দিয়ে বলল "তোর যা খুশি তুই কিনে খাবি। আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার ভালোবাসার মানুষটি ফুরিয়ে গেলো!

সবথেকে কষ্ট হচ্ছে আজ আমার বিছানায় ঘুমাতে। কারণ দাদু আসলে আমার বিছানাতেই বেশিরভাগ সময় শুয়ে থাকতেন এবং বিশ্রাম নিতে পছন্দ করতেন। আমার ঘরের খোলামেলা পরিবেশ তাঁকে মুগদ্ধ করতো। দাদু সবসময়ই প্রকৃতির কাছাকছি থাকতে খুব স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। তিনি ছিলেন একজন আধুনিক ও প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণার মানুষ । সবসময়ই বলতেন আমাদের সবাইকে সামনে এগিয়ে যেতে। আর অনুপ্ররণা দিতে নিজের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো আমাদের সবাইকে একসাথে বসিয়ে শেয়ার করতেন। দাদুর জীবনের কিছু দু:সাহসিক ঘটনা আমাকে এখনো নাড়া দেয় প্রবলভাবে। তিনি সবসময়ই দেশ নিয়ে ভাবতেন আর নিজেকে প্রশ্ন করতেন, কতটুকু দিতে পেরেছি আমার দেশটাকে! আমাদের সাথে দাদু তাঁর মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক কথাই শেয়ার করতেন। এখন ভাবছি যে আমার পরিবার বাংলাদেশের ইতিহাসের একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষীকে হারালো। দেশ নিয়ে, দেশের ইতিহাস নিয়ে আর দাদুর কাছে গল্প শোনা হবে না।

হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে আমার হাতটি ধরে দাদু বলেছিলেন, “ তুই মানুষের জন্য সারাজীবন কাজ করে যাবি। কারো কখনো ক্ষতি করবি না। দেশের সঠিক ইতিহাস জানবি। দেশের জন্য কিছু করে মরবি...’’।

শরীরে বাসা বাঁধা কঠিন রোগ দাদুকে চিরতরে আমাদের কাছ থেকে পর করে নিয়ে গেলো। তিনি আর ফিরবেন না। আকাশের তারা হয়ে আমাদের পরিবারের সবাইকে তিনি আর্শীবাদ করবেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাবো না। দোয়া করি তিনি যেখানে আছেন যেন ভালো থাকেন।

সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১১:১২
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্যামুয়েল ব্যাকেট এর ‘এন্ডগেম’ | Endgame By Samuel Beckett নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা

লিখেছেন জাহিদ অনিক, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৮



এন্ডগেম/ইন্ডগেইম/এন্ডগেইম- যে নামেই ডাকা হোক না কেনও, মূলত একটাই নাটক স্যামুয়েল ব্যাকেটের Endgame. একদম আক্ষরিক অনুবাদ করলে বাংলা অর্থ হয়- শেষ খেলা। এটি একটা এক অঙ্কের নাটক; অর্থাৎ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যাঙ দমনের নেপথ্যে এবং রাষ্ট্রীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয়

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৭


ব্যাঙ দমনের বাংলায় একটা ইতিহাস আছে,খুবই মর্মান্তিক। বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানির কোন সার কেনা হতো না। প্রাচীন সনাতনী কৃষি পদ্ধতিতেই ভাটি বাংলা ফসল উৎপাদন করতো। পশ্চিমবঙ্গ কালক্রমে ব্রিটিশদের তথা এ অঞ্চলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামে ভুল থাকলে মেজাজ ঠিক থাকে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৫


বেইলি রোডে এক রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে একজন একটা পোস্ট দিয়েছিলেন; পোস্টের শিরোনামঃ চুরান্ত অব্যবস্থাপনার কারনে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডকে দূর্ঘটনা বলা যায় না। ভালোভাবে দেখুন চারটা বানান ভুল। যিনি পোস্ট দিয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×