"ঐ শালা কিতারে বইসা আছস ক্যান ? ?" চিত্কার করে বললো হাসান ।
"উফ্ হাসাইন্না আস্তে বলতে পারিস না ?" রেগেমেগে বললাম ।
"না । তোর মতো গাধারে আস্তে কইলে শুনতে পাবি না । বয়রা কোনানকার ।" হাসতে হাসতে বলল হাসান ।
"হ্যা হ্যা । আমি যদি গাধা হই তাইলে শালা তাইলে তুইও গাধা । গাধার সাথে গাধাই বন্ধুত্ব পাতায় ।" মুচকি হেসে বললাম ।
হাসান অট্টোহাসি হাসলো । ছেলেটা অদ্ভুত । সবসময় এতো প্রানবন্ত থাকে কিভাবে ? বেশি হাসলে হাসানের চোখের কোণে পানি চিকচিক করে । আজকেও ব্যাতিক্রম হলো না ।
"হইছে । আর হাসিস না । নাকে মুখে উঠবে ।" মুচকি হেসে বললাম ।
অবশেষে হাসি থামলো হাসানের ।
চোখ মুছলো সে শার্টের ডান হাতা দিয়ে ।
তারপর আমাকে বলল "চল্ যাই । আজকে স্পেশাল একটা কাজ আছে ।"
"কি কাজ ?" অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম ।
"আজকে নিশাতের সাথে ডেটিং এ যাবো । আজকে স্পেশাল , কেননা আজকে আমি বাসায় ওর ব্যাপারে জানিয়েছি । কেল্লা ফতে দোস্ত । বাসার সবাই রাজি । এমনকি তার বাসার সবাইও রাজি ।
শুধু লাস্ট সেমিস্টারটা যাইতে দে । বিয়া কইরা ফালামু ।" বলল হাসান ।
হাসানের কথা বলার ভঙ্গিমাটা এতোটাই হাস্যকর ছিলো যে হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খেলাম আমি । বহু কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম ।
"না রে দোস্ত । তোদের ইস্পেশাল ডেটিং এ গিয়ে কাবাবের মধ্যে হাড্ডি হইতে চাই না । তাছাড়া একটু পর খেলতে হবে । না হয় ম্যাচ ফি টা মাইর যাবে ।"
হাসান আমাকে অনেক টানাটানি করলো । বেচারা রোগা পাতলা শরীর নিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যাওয়ার ব্যার্থ প্রচেষ্টা করলো কতক্ষন । তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে হাটতে লাগলো ।
(২)
ঈদের ছুটিঁ বাড়ি যাব । বাসের টিকেট এখন সোনার হরিণ । বহু কষ্ট করেও একটা টিকেট পেলাম না ।
মেজাজ খারাপ করে মেসে ফিরে এলাম । গত ৪ দিন ধরে বিছানাটা ঝাট দেইনি । চাদরে এক হাটু বালু । ধপ্ করে খাটের উপর বসাতেই বালুর ঝড় উঠলো । কাশঁতে লাগলাম ।
কাশিঁ শেষ হতেই দেখি চোখের সামনে একটা টিকেট । এবং টিকেটটা ধরে আছেন মহান ব্যাক্তি হাসান । মিটিমিটি হাসছে সে ।
"নে ধর্ বেকুব । কি দরকার ছিলো এতো যুদ্ধ করে লাইনে দাড়ানোর ? আমারে কইলেই তো হইতো !" বলল হাসান ।
সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালাম হাসানের দিকে । তার মতো কিপটা আমার জন্য টিকেট কিনে আনছে ! টিকেট টা উল্টে পাল্টে দেখলাম । না , ঠিকই আছে ।
অবাক হয়ে টিকেটটার দিকে তাকিয়ে আছি । হটাত্ একটা মিষ্টি মেয়ের কন্ঠ বলে উঠলো "হ্যাপি বার্থডে টু ইউ আহনাফ ভাই ।"
চরম বিস্ময় নিয়ে দেখলাম নিশাত হাতে একটা কেক নিয়ে হাসানের সাথে দাড়িয়ে আছে ।
হটাত্ মনে পড়লো আজ আমার জন্মদিন । কখনো কেউ আমাকে এভাবে উইশ করেনি । দরিদ্র পরিবারে জন্ম । তাই জন্মদিন নামক বিলাশিতা অধরাই রয়ে যায় ।
চোখে পানি এসে গেলো । টপ টপ করে পানি পরতে লাগলো আমার চোখ দিয়ে । হাসান এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল "ধূর ব্যাটা । বাচ্চাদের মতো কাদিঁস ক্যান ? ? চুপ থাক । নিশাত কি মনে করবে ?"
চোখ মুছলাম । ঐ দিন চরম মজা করলাম । নিশাত মেয়েটাকে এর আগে কখনো দেখিনি । আজ দেখে বুঝলাম আল্লাহতালা তাকে হাসানের জন্যই বানিয়ে পাঠিয়েছেন ।
বিকালে সায়দাবাদ বাস স্টেশনে গেলাম আমি আর হাসান । বাস ছেড়ে দিচ্ছে । দৌড় দিলাম বাস ধরার জন্য । কোন মতে বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে রইলাম । হাসানকে উদ্দেশ্য করে বললাম "আসি দোস্ত ।"
হাসান সহাস্য চিত্কার করে বলল "দেখা হবে বন্ধু কারনে আর অকারনে ।"
(৩)
ডাক্তার আর নার্স গটগট করে হেটে যাচ্ছে আমার পাশ দিয়ে । আশেপাশে ডেটল এর কড়া গন্ধ ।
আমি ২১৯ নাম্বার রুমটা খুজঁছি উদ্ভ্রান্তের মতো । করিডোরের শেষ প্রান্তে একটা দরজার উপর নম্বরটা দেখতে পেলাম ।
দৌড় দিলাম সেখানে । ঈদের ৫ম দিন আজ । বাড়ি থেকে পাগলের মতো ছুটে এসেছি । হাসান নাকি অসুস্থ । এ কথা শোনার পর আর একমূর্হূত দেড়ি করি নি ।
দরজাটার কাছাকাছি পৌছানোর আগেই দরজাটা ঠেলে একজন ডাক্তার বেড়িয়ে এলো ।
ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলাম হাসানের অবস্থা ।
ডাক্তার আমার পরিচয় জানতে চাইলেন । আমি বললাম যে আমি হাসানের বন্ধু ।
ডাক্তার আমাকে তার চেম্বারে নিয়ে গেলেন । তারপর একটা একটা এক্সরে রিপোর্ট পরিক্ষা করতে লাগলেন ।
আমি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেসা করলাম "স্যার হাসানের কি হয়েছে ?"
ডাক্তার থমথমে মুখে জবাব দিলেন "দেখো । তোমার বন্ধুর সম্ভবত ব্রেন টিওমার । সিরিয়াস অবস্থা । অপারেশন প্রয়োজন । বলতে কষ্ট হচ্ছে । তবে আমার মনে হয় অনেক দেরি হয়ে গেছে ।"
বলেই তিনি চুপ হয়ে গেলেন । এক নার্স এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেল । আমি বজ্রহতের মতো বসে রইলাম । নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না ।
স্বাভাবিক হতে সময় লাগলো । উঠে দাড়িয়ে হাসানের রুমে গেলাম । গিয়ে দেখি নিশাত আর হাসানের মা বসে আছে । হাসান আধশোয়া ।
আমাকে দেখে হাসান আন্টিকে আর নিশাতকে ইশারা করলো । তারা উঠে দাড়ালো । তারপর আস্তে আস্তে রুম থেকে চলে গেলো ।
হাসান আমার দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি হাসলো । এই তিন চারদিনে হাসানের মুখটা অসম্ভব ফ্যাকাশে হয়ে গেছে । চোখ গুলো কোটরে ঢুকে গেছে ।
হাসানের কাছে গিয়ে বসলাম ।
হাসান আমাকে স্বাভাবিক প্রশ্ন করতে লাগলো । আমিও যথাসম্ভব স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে লাগলাম ।
হটাত্ হাসান আমার হাত ধরে করুন কন্ঠে বলল "দোস্ত । ডাক্তার কি বলছে ? আমি আর কয় দিন বাচবো ?"
আমি একটা ধাক্কা খেলাম । প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে আমার । তবুও জবাব দিলাম "কি বলতেছিস ছাগল । তোর কিছুই হয় নাই । এই তো দু একদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবি ।"
হাসান মলিন মুখে হাসলো । বলল "জানিস দোস্ত আমার না ভিষন বাচতেঁ ইচ্ছা করে । মা-বাবা , নিশাত আর তোর জন্য ।"
কেউ যেনো একটা ধারালো ছুড়িঁ খচ্ করে বিধিয়ে দিলো আমার বুকের বাম পাশে । ভিষন কষ্ট হচ্ছে আমার । ধরা গলায় বললাম "বোকা ছেলে , তোর কিছু হবে না ।"
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো হাসানের আত্মীয়স্বজন । আমি উঠে দাড়ালাম । উদ্ভ্রান্তের মতো হাটতে লাগলাম । হাসপাতালে থাকতে আর ভাল লাগছে না । বেড়িয়ে যাওয়ার আগে শুনলাম , ডাক্তার নিচু গলায় বলছে , হাসানের অপারেশনটা আজকে রাতেই হবে ।
(৪)
হাসানের লাসটা কবরে নামিয়ে মাত্রই কবর দেওয়া হয়েছে । আমি বসে আছি কবরের পাশে ।
আশে পাশে আর কেউ নেই ।
।
হাসানের প্রানবন্ত মুখটা বার বার
চোখের সামনে ফুটে উঠছে । ভিষন কষ্ট হচ্ছে আমার ।
মনে হচ্ছে কেউ চোঁখা কিছু
দিয়ে বুকে খোচা মারছে ।
উঠে দাড়ালাম । কবরের
দিকে ফিরে বললাম "আসি দোস্ত ।"
ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নামলো । আমি ঘুরলাম
। আমার চোখেও বৃষ্টি নেমেছে ।
প্রকৃতি আর আমার হাহাকার আজ এক
হয়ে গেছে ।
আমার মনে হচ্ছে পিছন
থেকে হাসান চিত্কার
করে বলছে "দেখা হবে বন্ধু , কারনে আর
অকারনে" . . .