খুব হাল্কা স্বরে কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায় গাইছেন,
‘‘বিমল আনন্দে জাগো রে ।
মগ্ন হও সুধা সাগরে ।।
হৃদয় উদয়াচলে দেখো রে চাহি ।
প্রথম পরম জ্যোতিরাগ রে ।।’’
দ্বিতীয় চুমুক দিলাম চায়ে । বলা বাহুল্য, স্বাদ পেলাম না কোন । এত এত গুঁড়ো দুধ, আর চিনি দিয়ে তৈরি করা সাধের চা আমার, কপাল দোষে যমঘরে গেছে !
[নিকটবর্তী পূর্ব শেকল]
উনুনের আঁচে, আমার অণুগুলো অচিন্ত্যনীয় বেগে ছুটোছুটি করছিল । একসময় প্রবল স্বরে চিৎকার করতে থাকলাম । তখন, গায়ে ছুঁড়ে দেয়া হল পাতার গুঁড়ো । গুঁড়োগুলো বুঝতেই পারেনি, কোথায় এসে পড়ছিল তারা । বোঝার পর প্রচণ্ড আতঙ্কে আবার ফিরে যেতে চাইছিল । দেখে ভীষণ মায়া হয়েছিল আমার । কিছু বাষ্পকণা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ওদের অভ্যর্থনার জন্যে । তারা রন্ধ্রে প্রবেশ করে, আশু দুর্ঘটনার জন্যে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে নিয়েছিল তাদের । কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রং ও ঘ্রাণ পেলাম উপহার । অত কষ্টের মাঝেও বলতে ভুলিনি তাদের, ‘ধন্যবাদ, হে চায়ের গুঁড়ো সকল ! আন্তরিক ধন্যবাদ তোমাদের !’
এখন, আমার নিজের প্রতিশোধ স্পৃহার সাথে যুক্ত হয়েছে মৃতগুলোর অভিশাপ, গুঁড়ো ল্যাকটোজ আর সুক্রোজের জিঘাংসা ! চমৎকার এক সুবাস তৈরি করলাম আমরা । তারপর তা কণায় ভর করিয়ে, নাসারন্ধ্র দিয়ে লোকটার কুটিল মস্তিষ্কে পাঠিয়ে দিলাম । লক্ষ্য করলাম, চুমুক দেয়ার ব্যাপারে তাকে যথেষ্ট প্রলুব্ধ করা গেছে !
So! It is show time !! দগ্ধ হয়ে দগ্ধ করবার সুখ, আমাকে ঘিরে ধরতে চলেছে !
[নিকটবর্তী পূর্ব শেকল]
গল্প শোনার জন্যে বেলা কি অবেলা, তা বুঝবার কোন উপায় নেই এখানে । এটি একটি বদ্ধ টিনের কৌটো । বাহিরের বিচিত্র সব শব্দ এর গায়ে এসে ঘা দেয় । ভেতরের পরিবেশ রহস্যময় হয়ে ওঠে । তেমনই এক রহস্যময় পরিবেশে একজন ‘আমি’, ঘুরে, ফিরে, গড়িয়ে, সরিয়ে, রসিয়ে আমাদের শোনাচ্ছিল এক অদ্ভুত গৌরবের কথা ।
‘তোমরা কি জানো, কেন আমরা অন্য চা পাতাদের তুলনায় অধিক সৌভাগ্যবান ?’
‘কেন ! কেন !’ সবাই সমস্বরে জানতে চাইল ।
‘এজন্যে যে, আমাদের মূল্য অন্য জ্ঞাতিদের তুলনায় কেজিতে আট টাকা বেশি !’
‘এই কথা !’
সবার কণ্ঠে আশাভঙ্গের কৃত্রিম সুর ।
‘তোমরা কি দেখো না, আমাদের বাজার জাত করা হয়েছে মসৃণ স্বচ্ছ সবুজাভ প্যাকে ? আর ওদের মলিন অস্বচ্ছ হলদেটেতে ?...’
তার এসব অপ্রয়োজনীয় কথাকে পাত্তা দিচ্ছিল না কেউ । আমারই শুধু তাকে একটু চাগিয়ে দিতে ইচ্ছে হল । বললাম, ‘কিন্তু জ্ঞানী, আমরা তো একই গাছ থেকে এসেছি ! একই মাটি থেকে পুষ্টি নিয়েছি ! তবে কেন শুধু আমাদেরই এমন সৌভাগ্যবান করা হল ?’
সে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘এটা নকশাকারীর একান্ত ইচ্ছে ।’
‘তুমি সামান্য চা পাতার গুঁড়ো, তাঁর ইচ্ছের কথা জানলে কি করে ?’
‘ঠাট্টা করছ ? নাকি, সত্যিই জানতে চাইছ !’
‘কোনটাতে তোমার সুবিধে, বল । তুমি পৃথিবীতে আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছ । এটা জানো ? ’
হঠাৎ প্রবল ভাবে ভুমিকম্প শুরু হল। উপস্থিত সবাই মেতে উঠলো ত্রাহি চিৎকারে। জ্ঞানী 'আমি'টির মুখে সন্তুষ্টির হাসি দেখা গেল । তার চোখ যেন চিৎকার করে বলল, ‘দেখ ! আমাকে অবমাননা করার শাস্তি দেখ !’ এখানেই শেষ নয় । সময়বুঝে, পূর্ববর্তী ভারসাম্যহীনদের মত করে বলে বসল, ‘ এখন শুধু সেই নকশাকারীই পারে আমাদের বাঁচাতে ! সবাই তাঁকে স্মরণ করতে থাকো !’
কেউ একজন বলল, ‘গাধা ! এই বললে তোমার নকশাকারী তোমাকে সুন্দরভাবে বাজারজাত করে ইতোমধ্যেই সৌভাগ্যবান করেছেন, আর এখনই আবার বলছো বাঁচানোর কথা ? সৌভাগ্যবানই যদি করবেন, তবে বাঁচানোর প্রসঙ্গ কেন আসবে! তোমার কি...’
তাদের কথোপকথন হারিয়ে গেল । হঠাৎ কৌটোটির ঢাকনা সরে গিয়ে, এক ক্রূর টেবিল চামচ প্রবেশ করলো ভেতরে । আমাকে ও আরও শ পাঁচেক ‘আমিকে’ তুলে নিয়ে ওপরের দিকে চলল । দেখি, শুকনো মুখে জ্ঞানীও সেখানে বসে আছে । ‘ভয় পেয়ো না বন্ধুরা । নিশ্চয়ই আমরা আরও চমৎকার কোন ঘরের দিকে চলেছি । যারা তাঁর মাহাত্ম্য ঘোষণা করেছে, তাদের কোন ভয় নেই’, শুকনো মুখেই ঘোষণা করলো সে ।
হ্যা । ঘরটা চমৎকার বটে । আমাদের মরচে পড়া টিনের কৌটোর পরিবর্তে একটি নকশাদার চকচকে কেটলি । তাতে টগবগ করছে ফুটন্ত জল ! চামচ হতে আমাদের স্খলন, অতঃপর প্রবল চিৎকারে অমোঘ নিয়তি বরণ । অসহনীয় উত্তপ্ত জলকণাগুলো আমাদের শরীর ভেদ করে সুচের মত বিঁধে গেল । পরমুহূর্তেই খলবলে হিংস্র জল লুফে নিল আমাদের !
ক্রমশঃঅবশ অনুভূতির কাছে জলদানবীর নৃত্যরতা দেহ, ঝাপসা হয়ে এল ক্রমে !
[দূরবর্তী পূর্ব শেকল]
আমার সন্তানদের কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে ঐ পাপিষ্ঠার দল ! হায় আমার বৃক্ষজন্ম ! কিছুতেই পারছিনা আর ! দেহ-মনের যাতনায় কুঁকড়ে আছি সারাটাক্ষণ ! আর অপেক্ষা করে আছি । কবে মৃত্যু হবে ? পাশ থেকে সমবেদনার সুরে কেউ একজন বলে উঠল, ‘তোমার বড় কষ্ট !’ কে আমার মনের পড়ে নিল এমন করে ? ছোট্ট লাল জোঁক এক । আমারই ডালের সাথে একরকম মিশে গিয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, ‘কষ্ট ? আমার ? হবেওবা বাছা !’
‘কতদিন ঘুম নেই তোমার ! তোমাকে বাড়তে দিচ্ছে না মানুষগুলো । কাঁচি চালিয়ে এতো টুকুন করে রেখেছে । মাথা উঁচু করে আকাশ দেখার কথা ছিল তোমার । অথচ, পড়ে আছ মাটির কাছে ।’
আমি অবাক হলাম । বললাম,‘এসব কথা তুমি জানলে কি করে বাছা ? জন্মের পর থেকে তো তুমি আমাদের এমনটাই দেখে আসছ !’
সে বলল, ‘আমি আমার অন্তর্তন্তুর ভাষা পড়ে জেনেছি । সেখানে লেখা আছে, দূর প্রাচ্যে আমাদের পূর্বপুরুষেরা, তোমাদের বিশালকায়া পূর্বপুরুষদের প্রবল ঘ্রাণের ঘোরলাগা সময়ে রাজত্ব করে গেছেন ।’
‘তোমার অন্তর্তন্তুতে আমাদের কথা লেখা আছে !’
‘হ্যা । কেননা, আমরা প্রজন্মান্তরে তোমাদের সঙ্গে সহবিবর্তিত হয়েছি । তোমাদের একজন খুব বড় দার্শনিক আছেন । উত্তর-পশ্চিম যখন প্রাচীন পুণ্ড্র অঞ্চল, তখন তাঁর জন্ম ! পুণ্ড্রশ্বথ । আমি তোমাকে তাঁর শান্তিময় বৃক্ষদর্শন শোনাব ? সম্প্রতি, এটা আমার আগ্রহের বিষয়বস্তু হয়েছে ।’
‘শোনাও !’
[নিকটবর্তী পূর্ব শেকল]
এই বামন চা গাছটার কাণ্ড-শেকড় তিরতির করে কাঁপছে । কিসে সে এমন প্রবল ভাবে অনুরণিত ? যে কারণেই হোক- ভূমিকম্প যে সে তালিকায় নেই, এটাই আপাতঃস্বস্তির কারণ । ভূমিকম্পের কথা মনে এলেই মাতৃমূর্তি বজায় থাকে না আমার । কংস মূর্তি জেগে ওঠে । আমার এমন লক্ষ পরিজনের মাঝে বিভেদ রচেছে সে, যারা আর কোনোদিন কারও মুখ দেখতে পায়নি আর ।
মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে । কেন এই মৃত্তিকা জীবন বেছে নিয়েছিলাম ? ফুঁড়ে গাছেরা বেরিয়ে আসছে, খুদে পোকামাকড়েরা ঢুকে পড়ছে, জীবজগৎ দৌড়ুচ্ছে, জড়জগৎ গড়াচ্ছে । ক’বছর হল, যুক্ত হয়েছে দোপেয়ে বানর বিশেষ । এদের নির্দয়তায় কার শান্তি বিপন্ন হয়নি, কেউ বলতে পারে না ! আমার চেয়ে বেশি কষ্টে কি কেউ আছে পৃথিবীতে ?
ছি, এসব কি ভাবছি আমি ! আমার আজকের এই জমাট মাতৃরূপ, বিন্দু বিন্দু করে গড়ে ওঠা পাথারসম সাধনার ফল । আর কেউ তো পারেনি ! আমি মাতা-গরবিনী। জগৎ তো আর- ‘সয়ে যাও নয় ক্ষয়ে যাও’ নয়। শক্তি অবিনশ্বর। এই গাছটি কেন এতো অনুরণিত হচ্ছে ? ‘এই গাছ, এই ! এই চা গাছ !’ শুনছেই না । আমি আবার ডাকলাম । ‘এই, এই !’
[দূর দূরবর্তী পূর্ব শেকল]
‘আজকাল একটা কথা প্রায়ই মনে হয় ।’ আমি একে একে তিনজনার দিকে তাকালাম । কৌতূহলী হয়ে উঠেছে তারা এ কথায় ।
‘তোমাদের মনে আছে আমাদের সেই জঠরকাল ?
‘বেশ মনে আছে ।’ বলল সবল নিউক্লীয় । ‘আমরা একে ওপরের সঙ্গে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে ছিলাম । কেউ কাউকে চিনতে পারিনি । ছুটে বেরিয়ে আসতে চাইছিলাম তাই । কিন্তু পারছিলাম না । কেন, তা আজ বলতে পারি ।’ তড়িৎচুম্বক আর দূর্বল নিউক্লীয় সায় জানাল তার কথায় ।
আমি বললাম, ‘হ্যা । আমরা একে ওপরের সঙ্গে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে ছিলাম । বিপরীতে, ছুটে বেরিয়েও আসতে চাইছিলাম । কিন্তু, আমি মহাকর্ষ তা করবার আগে, তোমাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না তা। শূন্য হতে দশ পিকোর ব্যবধানে, একে একে সবাই ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলাম । কিন্তু, সেদিন হুড়োতাড়া না করলে, আজ এ বিশ্বে, আরও সাতটি মাত্রা অবমুক্ত হতে পারত । আমরা নিজেদের মাঝে নিজেরা পশে, সৃষ্টি করেছি । জাত জড়জগতের আকার, আর উপজাত জীবজগতের ইন্দ্রিয় আটকে গেছে ত্রিমাত্রিকতার সুতোয় । তারা সাঁতার কাটছে অসম্পূর্ণ আনন্দ-বেদনা, সৌন্দর্যবোধ, আর মুখাপেক্ষিতার বন্দিদশায় !
তাদের অজ্ঞতাপ্রসূত নৈর্ব্যক্তিক এক সন্তোষ, নিরন্তর অভিশাপ দিয়ে চলেছে আমাদের !
*
[অন্তর্হিত শেকল]
কেন শেকলের বাহিরে চলে গেলে, তা ভেবে মনটা বড্ড বিষণ্ণ তোমার ?
সত্যিই, কত চমৎকার হত যদি সবার মাঝে নিজেকে ব্যাপৃত করে দিতে পারতে, কল্পনার সর্বশক্তিমানটি হয়ে !
তুমি ত্রিমাত্রিক সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে ! সমস্ত সুকৌমার্য সম্পূর্ণ তোমার ! তথাপি, তুমি সয়ম্ভু নও । বরং,পদার্থের সূত্রবন্দি, একাকী স্বতন্ত্র সৃষ্টি । মাত্রাবিভবের পার্থক্যের কারণে, যার কোন প্রভাবই নেই মাত্রিক জগতে ।
তুমি অবাক হয়ে দেখ, ওরা স্বয়ং সমন্বিত ঈশ্বর !
তুমি ঈশ্বর তোমাতে !
ত্রিমাত্রিক হয়েও ওরা শক্তিমত্ত, যূথবদ্ধ !
আর তুমি ? একাকী, বিলোল !
তোমার বহুমাত্রিক সৃজন-সৌন্দর্যের একমাত্র স্তুতিকার !
একেক সময় ওদের উপাসনায় বসতে, কি প্রবল ইচ্ছে করে তোমার !
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১:০৯