somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নীলা আমার নীলাঞ্জনা

১৫ ই মার্চ, ২০১২ বিকাল ৪:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


যৌবনের প্ল¬াবিত জোয়ারে আমার প্রতি অঙ্গ মধুসিক্ত। প্রসারিত বক্ষদেশ প্রায় পরিপূর্ণ। চোখের কোণায় কামনার কাজল রেখা আর তুলতুলে গালে মায়াবী টোল পড়া হাসি। নদী উতরিয়ে যেমন জোয়ারের পানি চারিদিক উচলে পড়ে তেমনি আমার দেহের পরিপূর্ণতা আমাকে ভাসিয়ে নিল টুইটুম্বর কামিনীর সরোবরে। কিন্তু কিশোরী মন আমার কিশোরীই রয়ে গেল।
সবাই চুপ। বোবার মুখ আজ খুলছে। সানজিদা বলল, “বুকে প্রেম থাকলে মুখে কথা বের হবেই। হাসিরও ঝিলিক ছড়াবে।”
শ্রাবণী বলল, “ওতো রূপসী রাজকন্যা। ওর প্রেম কি আমাদের মত? ওর মন রাজপুত্রের ঘুমন্ত মুখের দিকে।”
সত্যি নীলা অপরূপা। সাবানের ফেনার বুদবুদের মত ওর সমস্ত দেহে কামনার তীক্ষè প্রতিফলন। এক নীলাভ আশ্চর্য আলো ওর সমস্ত অঙ্গ প্রতঙ্গকে অনাবিল ঐশ্বর্যে ভরে তুলছে। সখীগণের মাঝে ও একা নীরব। ওর মুখে কোন কথা নেই। সমস্ত যুবতীর রূপরেখা যেন ওর মাঝে প্রস্ফূটিত। বিকেলের লাল আলো যেন সবাইকে ফাঁকি দিয়ে কেবল নীলাকে নীলাঞ্জনা করে তুলছে।
রুপা বলল, “কিরে থামলি কেন?”
সেদিন সন্ধার পর বাড়ি ফিরছিলাম। ঝুনুদের আম বাগান পিছনে ফেলে অনেক দূরে চলে এসেছি। সামনের জঙ্গলে খুব অন্ধকার। একাকি দারুণ ভয় পাচ্ছিলাম। খানিক দাঁড়িয়ে ছিলাম। কে যেন আসছে। ঐ ছেলেটা। শহর থেকে যে ঝুনুদের বাড়িতে এসেছে। ওকে প্রথম দিন দেখে আমি দারুণ হেসেছিলাম।
মিতা বলল, “প্রেমের পুর্বাভাস দেখেছিলি?”
সারা গায়ে কাদা মেখে একেবারে ভুত সেজেছিল। আমার পাশে এসে দাঁড়াল। কোন কথাই হলো না। ওর পিছনে হাঁটলাম। অন্ধাকারে নিজেকে পর্যন্ত দেখা যায় না। চারিদিক নিস্তব্ধ। জঙ্গলের জোনাকি জঙ্গলকে অধিক অন্ধকার করে ফেলছে। কখন যেন ও দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি তখনও হাঁটছি। আচমকা ওর গায়ে ধাক্কা লেগে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। ও আমাকে দারুণ ভাবে জড়িয়ে ধরল। পরে যখন বুঝলাম ছোটা ছুটির দারুণ চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারিনি।
মণি বলল, “কি সখী, কেমন লেগেছিল?”
শ্রাবণী জোরের সাথে বলল, “তুই থামলি।”

ও জোর করে আমার গালে একটা চুমু খেল। পরে হাত ধরে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার নরম তুলতুলে দেহ তখনও কাটা মাংসের ¯তূপের মত কাঁপছে। ও আঁধারে মিলে গেল। আমি আমার ঘরে ফিরলাম। বড় একাকিত্ব বোধ করলাম। ঘুম আসছে না। জানালা খুলে দিলাম। জোছনা জ্বলেনি। তারায় তারায় আকাশ আলোকিত। ঘন গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা যায় না। জানালার পাশে মোরগ ফুলের পাতা টেনে ছিড়লাম। অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে কোথাও বের হইনি। মা আমার চুল বেধেঁ দিল। বলল, “দেখ, তোকে কেমন দেখায়। সারাক্ষণতো ছনবন হয়ে থাকিস।” এক পলক আয়নায় মুখ দেখলাম । সব জায়গা প্রয়োজন মত ভরাট এবং প্রয়োজন মত ভাঁজ। আমার চুলের বেণী বেয়ে হিমালয় কন্যা গঙ্গা যেন নেমে পড়ছে মর্তে। দুই ধারে উচলে পড়া জলের ঢেউ রাগে ফুলে উঠে থমকে আছে। বাতাস যেন সেখানে ঢেউ খেলছে। আমি আয়নাটা নিয়ে নিজের ঘরে এলাম। দেখলাম আমার মুখ। বিশ্বাসই করতে পারলাম না আমি এত সুন্দর। চোখ জোড়া মসৃণ আর মায়াবী। গাল ফুলে উঠছে আলাদা জৌলুসে। ঠোঁটে এতো হাসি আর এতো মাধুরী যে আয়না টেনে নিজের মুখে চুমু দিতে গেলাম। হঠাৎ ওর কথা মনে পড়ল। ওর চুমুর আকর্ষণ তখনও আমাকে বিমোহিত করছে। আয়নায় আমার উথলে ওঠা নতুন দেহটি ভালো করে দেখলাম। চোখ পড়ল গলার দিকে। পুতির মালাটি কখন যেন সোনা হয়ে গেছে। মা মনে হয় ওটা দেখেনি অথবা বলতে ভুলে গেছে। শুধু বলেছিল, “তুই বড় হয়েছিস একটা কিছু ঘটা অসম্ভব নয়। ভালো হয়ে চলা ফেরা কর।” ঘটার ভয় আমি পেতাম না। আজ ভাবলাম আমার কিছু ঘটে গেল। না আমার কিছুই ঘটেনি।
সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসছে। ঘরে একাকি। মালাটি খুললাম। একবার ডান হাতে একবার বাম হাতে নিলাম। ও ঘরে মা তখনও ঘুমায়নি। রাত বাড়ছে। মা-বাবার কথা বন্ধ হয়ে গেল। দরজা খুলে বাইরে এলাম। ঠণ্ডা বাতাস ছাড়ল। আমি জানতাম ও কোথায় ঘুমায়। কিন্তু চারিদিক গভীর অন্ধকার। ঝুনুদের আম বাগানে এলাম। আকাশের মেঘ এলোমেলো ঘোরা ফেরা করছে। ওর জানালার পাশে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি শুরু হলো। আমি ভিজছি। একদম নীরবে ভিজছি। ভয়ে হৃৎপিণ্ড কাঁপছে। পরান যেন বুক থেকে সরে কণ্ঠনালীতে এসে পৌঁছাল। খানিক পরে ও জানালা খুলল। হয়তো বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙ্গছে নয়তো তখনও ঘুমায়নি। আমি জানালার আড়ালেই থাকলাম। বৃষ্টি ক্রমেই বেড়ে চলছে। শির শির করছে শীতল বাতাস। আমার সারা গা তখনও ভয়ে আর শীতে কাঁপছে। মালাটি হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা। ওর ঘরে বাতি মিট মিট জ্বলছে। আমি ভয়ে আর থাকতে পারলাম না। ধীরে ধীরে জানালার খোলামুখে দাঁড়ালাম। আলোর রশ্মিতে আমার মুখ ঝলসে উঠল। আমি চোখ বন্ধ করলাম। আমার চুল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ঠোঁট মৃদু কাঁপছে। চোখের পাতায় আতংক। ও প্রদীপের পানে তাকিয়ে আছে। বললাম, “শোন।” ও যেন কেঁপে উঠল। আমার দিকে হেঁটে এলো। কোন কথাই বলল না। আমার মুখের পানে হাত বাড়িয়ে আবার টেনে নিল। আমি বুঝলাম না কেন এমন? যে আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারে সে কেন স্পর্শ করতে চাইল না।
“তোমার মালা।”
মালাটি ধরল। আমি পিছন ফিরলাম। ও আমার হাত টেনে ধরল। আমি আবার ঘুরে দাঁড়ালাম। আমার পুতির মালাটি ফিরিয়ে দিল।
আমি বললাম, “ওটা তুমি ইচ্ছে করে নিয়েছ।”
ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমি দৌঁড়ে ফিরে এলাম। আম বাগানের কাছে এসে আবার তাকালাম। ও জানালা ধরে দাঁড়িয়েই ছিল। ঘরে ফিরে ভেজা কাপড় ছাড়লাম। জানালায় দাঁড়ালাম। আমার সমস্ত গা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। বৃষ্টি কমে এলো। বিছানায় এলাম। গা কাঁপছে।

মালাটা দিতে গিয়েই আমি নিজেকে হারালাম। আমার পথ চলা ধীর হয়ে এলো। কার যেন একটা গোপন স্পর্শ আমার বুকে চেপে বসল। আমের মৌসুম প্রায় শেষ। ঝুনুদের বাগানে যাইনি। শ্যাওলা পুকুরের সিঁড়িতে দাগ টেনে একা একা খেলছি। কত বার ঠকেছি আবার কত বার জিতেছি। খুশিতে হাসছি আবার ঠোঁট কামড়িয়েছি।
সেদিন শ্যাওলা পুকুরের সিঁড়িতে বসে আছি। কার যেন বাঁশির সুর ভেসে এলো। আমি উঠলাম। বাঁশির সুর অনুসরণ করলাম। এত দিন আমার মনে যে কথা ভাসছিল ঐ বাঁশিতে সেই সুর ভেসে এলো। সে সুর আর এ সুর যেন একই মিলনের মন্ত্র। ঝোঁপের আড়ালে শহরবাসী সেই ছেলেটি। আমি পিছনের গাছের সাথে হেলান দিলাম। কিছুক্ষণ পর বাঁশি থেমে গেল। ততক্ষণ আমার দেহ, মন, প্রাণ একাকার হয়ে গেছে।
আমি বললাম, “থামলে কেন, বাজাও?”
ও উঠে দাঁড়াল। আমার দিকে এলো। নিষ্পলক ওর দুটি চোখ। সেই মালাটি আমার মুখের উপর ধরল।
“আমি এক শর্তে নিতে পারি।”
“বলো।’’
“তুমি আর বাঁশি বাজাবে না।”
“আমার যে সুর মানুষকে কাছে ডাকে কেন তুমি তা কেড়ে নিতে চাও? আমার ভালোবাসা, আমার সুর, আমার সংগীত সকল কিছুই আমার বাঁশি। এখানে আবার শর্ত কেন?”
“জানি না তো।”
“কেন বাঁশি বাজাই তা জানো?”
“হয়তো ভালো লাগে।”
“তুমি যে আমাকে বারণ করলে সে কোন ধরণের ভালো লাগা?”
“তাও জানি না।”
“আমি বাঁশি না বাজালে ভালো লাগবে?”
আমি ওর নীরব চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। ও চোখ যেন ভালোবাসায় ভাসা নীলকণ্ঠ। আমি থেমে গেলাম।
“ঠিক আছে, তবে আর একদিন বাজাব। যেদিন এ গ্রাম ছেড়ে চলে যাব।”
“চলে যাবে?”
“হ্যাঁ। আমি চাই না আমার জন্য কারো ক্ষতি হোক।”
“যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা পূরণ করতে পারবে?”
ও আমার দিকে তাকাল। আরো কাছে এলো। একটা হাত ধরল। আমি কোন বারণ করলাম না। গাটা হঠাৎ করে কেঁপে উঠল। মালাটা আমার হাতের মুঠোয় দিয়ে বলল, “মানুষ কখনও কখনও ভুল করে।”
“কিছু কিছু ভুল ভালোবাসার জন্ম দেয়।”
“তুমি আমার সুরের আকাশে আল্পনা, মনের কোণে নীলকণ্ঠ। কিন্তু সত্যিকারে কে আমি তা জানি না।”
“ঐ যে বললে, নীলকণ্ঠ। আমি নীলাঞ্জনা। তোমাকে আর একটা অনুরোধ করছি, তোমার শেষ বাঁশি যেন আমার কানে না পৌঁছায়।”
চলে এলাম। অনেক দিন ওর সাথে দেখা হলো না। ওকে দেখতে দারুণ ইচ্ছে হলো। শ্যাওলা পুকুরের সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম। চারিদিকে ঘন বন। চিকন একটা রাস্তা লোকালয়ের মধ্য দিয়ে এখানে পৌঁছেছে। লোকজন তেমন কেউ সেখানে আসে না। একেবারে লোক শূন্য বললেও চলে। কতগুলি ছোট্ট ছেলে মেয়েরা সেখানে খেলা করতে আসে। পুকুরের পানি পরিষ্কার। কতগুলি শাপলা ফোটে। পুকুরের চারদিক বাধাই করা। সেগুলি এখন ঘন ঘাসে ঘিরে ধরছে। দিনে দূপুরেও এখন বাদুর ওড়ে।
হঠাৎ করে ঘন ঘন বৃষ্টি হতে লাগল। রাতে ঘুম আসছিল না। বৃষ্টি দেখার জন্য জানালা খুললাম। দেখলাম ও বাইরে দাঁড়িয়ে মোরগ ফুলের পাতা ছিড়ছে। ওর সারা গা ভেজা। পানি গড়িয়ে পড়ছে। নীরবে আমার দিকে তাকাল। আমি কেঁপে উঠলাম। আমার খুব কষ্ট হলো। ও কাছে এলো। ওর অন্ধকার মুখের দিকে নীরবে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলাম। ও বলল, “তুমি একদিন ভিজে আমাকে ঋণী করছো। আমি তিন দিন ভিজে তোমার ঋণ শোধ করলাম।”
আমি জানালা দিয়ে হাত বের করে ওর মুখ মুছে দিলাম। এই প্রথম আমি ওকে স্পর্শ করলাম। মনে শিহরণ জাগল।
ওকে বললাম, “কৈ তোমার নীলাঞ্জনাকে তো একবারও ডাকলে না?”
“বাবা চিঠি লিখছে, আমাকে যেতে হবে।”
আমি ওর মুখের পানে তাকিয়ে থাকলাম। চোখের জল গড়িয়ে পড়ল। ও আমার চোখের জল মুছে দিল। আমার সারা মুখে হাত বুলিয়ে দিল। ওর হাত দারুণ ঠাণ্ডা। ও শীতে কাঁপছে। আমি ওর মাথার ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম।
ও বলল, “নীলাঞ্জনা,আমি তোমাকে একদিন শহরে নিয়ে যাব।”

বৃষ্টি বেড়ে উঠল। ও কে আমি ডাকতে পারলাম না। ও চলে গেল। অমি জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল। মনে হলো ওর হাত ধরে আমি শহরে প্রবেশ করছি। অন্যের অবজ্ঞার হাসি ঠেলে শুধু ওর হাত ধরে চলছি। হঠাৎ মুখ কালো হয়ে গেল। ও কাল চলে যাবে। বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে পড়লাম। এক বোঝা সুখ, স্বপ্ন, ভালোবাসা আমার মনের মাঝে আল্পনা আঁকল, আবার বেদনায় ভরপুর হয়ে গেলাম। বৃষ্টি সারা রাত থামল না। ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করল না। মা ডাকল। উঠে বাইরে এলাম। মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। একটু হাসলও।
আজ আবার আয়না নিয়ে নিজের মুখ দেখলাম। আমি যেন অনেক বেশি সুন্দরী হয়ে উঠছি। মাথার চুল নিজেই যেন সৌন্দর্যে বিকশিত। বেশি সময় নিজেকে দেখতে পারলাম না। আমার আবছায়া মূর্তির উপর ওর বৃষ্টি ভেজা মুখ ভেসে উঠল। আয়না যেন আমার মনের কথা বুঝল। আমি নীরবে তাকিয়ে আছি। আমার কানে ভেসে এলো সেদিনের বাঁশি। হাসিতে আমার মুখ ও বুক ভরে গেল। একটা পাওয়ার ভয় আমাকে হারানোর পথে নিয়ে গেল। মন এলো মেলো হয়ে গেল। মনেতো বাধন মানে না আবার মানেও। আমি মনকে বুঝাতে পারলাম না।
সেদিন একটা শাড়ি পরলাম। একাকি ঝুনুদের বাগান পর্যন্ত গেলাম। মনে কেবল ভয় আর আতংক। শাড়ির আঁচল মাটির সাথে মিশে আছে। বাগানে কিছু সময় দাঁড়ালাম। ভাবলাম ও আমাকে একটু দেখুক। কিন্তু দেখা মিলল না। আমি শ্যাওলা পুকুরের দিকে গেলাম। সিঁড়িতে বসলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ওকে না দেখিয়ে এ সাজ খুলতে ইচ্ছে হলো না। ওর উপর রাগ চড়ে গেল। আমি বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। পথে একদল দুর্বৃত্তরা আমাকে ধরে নিয়ে গেল। জঙ্গলের আড়ালে নিয়ে আমার সকল সাজ টেনে হিচড়ে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলল। আমি আমার জীবনের সব কিছু হারালাম। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হলো না। ভাবলাম এই শ্যাওলা পুকুরেই জীবন বিসর্জন দেই। তবু বাড়ি ফিরলাম। তখন অনেক রাত। মা আমার দরজায় দাঁড়াল। আমি লজ্জায় আর ঘৃণায় মাথা নিচু করলাম। আমার চোখের জল গড়িয়ে গেল। মা কাছে এসে হাত বুলিয়ে বলল, “কি হয়েছে?” আমি কান্নায় মায়ের কোলে ভেঙ্গে পরলাম। মাকে সব বলতে চাইলাম। মা’ইতো মেয়েদের বন্ধু। কিন্তু বললাম না। ভাবলাম এমন একটা মিথ্যাকে চিরকাল নিজের মাঝে লুকিয়ে রেখে সুখ খুঁজে নেব। একটা ঘটনা মাত্র। হোক সে জীবনের সবচেয়ে কঠিন ঘটনা। মা চলে গেল। আমি আমার ঘরের সমস্ত কিছু তচনচ করে ফেললাম। শূন্য বিছানায় শুয়ে কাঁদলাম। রাত বেড়ে উঠল। জানালায় দাঁড়ালাম। ভাবলাম আত্মহত্যা আমাকে করতেই হবে। কিন্তু কার যেন বাঁশি ভেসে এলো। আমার মাথার ভিতর যেন একটা ঝিঁ ঝি পোকা ডেকে উঠল। ওর ডাকের শব্দে আমার সব কিছু এলামেলো হয়ে আসছে। আমি শুনতে পাচ্ছি দূর সীমান্তের কোন অজানা সংগীত।
পাঁচ দিন কিভাবে যেন অতিবাহিত হলো। আমি শুনলাম ওর ভীষণ জ্বর। হয়তো বেশি পরিমাণ ভিজেছিল বলে। রাতে বেরিয়ে এলাম। ওর সিথানে মাটির প্রদীপ জ্বলছে। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ওর শিয়রে এক মহিলা বসে বসে কাঁদছে। ও অজ্ঞান। আবোল তাবোল বলছে। জানালার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি কাঁদলাম। আমার সমাজ, আমার কলঙ্ক আমাকে জানালার ও পাশে প্রবেশ করতে দিল না। আমি ফিরে এলাম। বিছানায় শুয়ে শুধু ওর কথা ভাবলাম। সারা রাত কাঁদলাম। ভাবলাম সকালে মাকে বলল, শহর থেকে আসা ছেলেটার কাছে আমি একবার যাব। সমাজের আড়ালেতো আমার সব কিছুই শেষ হয়ে গেছে। বাকী যা আছে তা কেবল মিথ্যে। মিথ্যে অভিনয় দিয়ে যদি ওর জীবনটা ভালো হয়ে যায়।
ভোর হলো। মা আমাকে যেতে দিল। সেই অপবিত্র শাড়িখানা পরে আমি বের হলাম। গেটের বাইরেই একটা গাড়ি দেখলাম। চিন্তা হলো ওকে নিয়ে যাবে। আমি কাঁপছি। আমার সারা শরীর শীতল হয়ে উঠছে। আবার বুক ভরে গেল। ও আমাকে শহরে নিয়ে যাবে। এ রকম গাড়িতে চড়ে আমি শহরে যাব। একটা মিথ্যে আনন্দ আমার সারা দেহে হাসির ঝিলিক দিল। আমার সব ক্ষয়ে যাওয়া মনে হাসি উঁকি দিল। হঠাৎ কান্না শুনে আমি থমকে গেলাম।
ওর লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আমি বোবা হয়ে গেলাম। আমার কণ্ঠ হারিয়ে গেল, আমার জ্ঞান হারিয়ে গেল। আমি পাথর। ততদিনে আমার পেটের সন্তান বেড়ে উঠল। চোখে মুখে ফুটে উঠল মাতৃত্ব। কলঙ্কের বোঝা আমার সুখের ঘরকে লাশ কাটা ঘর বানিয়ে দিল। গ্রাম ত্যাগ করলাম। শহরের দিকে পা বাড়ালাম। ওর সেই শহরের দিকে। ওর বাঁশি আমার কানে ভেসে এলো। বলল, “নীলা, আমার নীলাঞ্জনা, এ আমার শেষ বাঁশি। আমি চলি।” আমি নদীর জলে ঝাপ দিলাম। তারপর তোদের পেলাম। শুনলাম আমার মিথ্যা সন্তান কারো বংশ প্রদীপ হয়ে আলো দিচ্ছে।

১৫.০১.২০০৭ইং, ডায়না প্যালেস।

২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×