যশোর: সাইফুল ও মেহেদি আপনমনে, একাগ্রতায় নিজের মনের সৌন্দর্য সুই-সুতোর মায়াজালে বুনে চলেছেন। কাপড়ের ক্যানভাসে এঁকে চলেছেন তা নিবিষ্ট মনে।
সূচিশিল্প প্রতিযোগিতায় অন্যান্যের মধ্যে অংশ নিয়েছেন সাইফুল ইসলাম ও মেহেদি হাসান নামে দুই কলেজছাত্র। শতাধিক প্রতিযোগীর মধ্যে তারা দুজন মোটে ছেলে!
তাদের পাশে বসে একই কাজ করছেন শেলি খান। তিনি নিজেও এসব কাজ করান গ্রামে গ্রামে মেয়েদের দিয়ে, বেকার বসে না থেকে কাজের ভেতরে নিজেকে সম্পৃক্ত করা, পাশাপাশি সংসারে সচ্ছলতাও আসছে।
যশোর সদরের পুলেরহাট এলাকায় বাড়ি শেলি খানের। স্বামী ইমামুল হোসেন প্রবাসী। ছেলে মেহেদি হাসান ইন্টারমিডিয়েট প্রথমবর্ষে পড়ছেন।
সাইফুল ইসলামের বাড়ি রূপদিয়া গ্রামে। তিনি রুদ্রপুর মুক্তিযোদ্ধা কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন।
শেলি খান জানান, স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে স্টিচের কাজ তিনি শেখেন। এখন নিজেই গ্রামে গ্রামে মেয়েদের দিয়ে সেলাইয়ের কাজ করান এবং সেগুলো বাজারজাত করেন।
ছেলে মেহেদি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষার আগেও সে গোপনে সেলাই করতো। নিষেধ করলেও শোনেনি। সেলাই ছাড়া অন্য কোনো নেশা নেই তার। এভাবে সেলাইয়ের কাজ করে তার অ্যাকাউন্টে এখন প্রায় ৩৫ হাজার টাকা জমা হয়েছে। তাছাড়া ঘরে ওয়ালমেট, কুশন কভার, সোফা কভার, নিজের পাঞ্জাবি, ফতুয়া এমনকী আমার থ্রি পিসেও নকশি সেলাই করেছে সে।’
ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়ার আগ্রহ রয়েছে মেহেদি হাসানের।
গ্রামে কাজ করতে যেয়েই শেলি খানের সাথে পরিচয় সাইফুল ইসলামের। সেলাইয়ে আগ্রহ দেখে তাকে শেখান কীভাবে সুই-সুতোর বন্ধনে গড়ে ওঠে এ শিল্প।
সাইফুল সূচিশিল্প প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় পর্যায়েও এসেছিলেন। ২৫ জনের মধ্যে ১২তম স্থানে ছিলেন। এবার আরো অভিজ্ঞ, আশা করছেন ভাল অবস্থানে থাকার।
সাইফুল ইসলাম জানান, শিখেছেন যশোর স্টিচ, নকশিকাঁথা স্টিচ, ডালফোঁড়, ভরাট, জামদানি, শ্যাডো, শান্তিপুরী স্টিচসহ নানান সেলাই। বাড়িতে বসেই কাজ করেন, নিজের হাতখরচও আসে সেলাই থেকে।
বুধবার সকালে তৃতীয়বারের মত যশোরে শুরু হয়েছে সূচিশিল্প প্রতিযোগিতা। গত দু’বছর ধরে প্রতিযোগিতা হয়ে আসছে।
এবার প্রতিযোগিতাস্থল দুটি। একটি চারুপীঠ আর্ট ও রিসার্স সেন্টার অপরটি শেখহাটি সফিয়ার রহমান মডেল অ্যাকাডেমি।
চারুপীঠ ও ফোঁড় ক্রাফটস যৌথভাবে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। আর প্রতিযোগিতায় অর্থসহায়তা দিচ্ছে কপোতাক্ষ-জাপান।
চারুপীঠের অধ্যক্ষ ও আয়োজক মাহবুব জামাল শামীম বলেন, ‘১৯৭১ সালের আগে আমাদের মা-বোনেরা তাদের শাড়ির পাড় থেকে নানারঙের সুতো তুলে সেলাই করতেন কাঁথা, ওয়ালমেট, কুশনসহ আরো নানা জিনিস। অনেক আগে থেকেই নকশি সেলাই সামাজিকভাবে রূপ নেয় অদ্ভূত এক শিল্পের। মা-বোনেরা ভাবতেন, অতিথি আসবেন তাদের বসতে দিতে হবে, খেতে দিতে হবে-তার জন্য প্রয়োজন নান্দনিক সেইসব কাজের।’
‘যুদ্ধপরবর্তীকালে ভারতীয় প্রিন্টকাপড়ে সয়লাব হয়ে যায় দেশ। কাপড়ের পাড় থেকে আর আহরণ করা যায় না রঙিন সুতো, মা-বোনেরা ভুলতে বসেন সেই আদি অকৃত্রিম শিল্পকে। পরে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে এ শিল্পরক্ষার্থে।’ তার দাবি।
তিনি বলেন, ‘শিল্পকলার সামাজিকীকরণের মাধ্যমে আজ সেলাই হয়ে উঠেছে জীবিকার মাধ্যমও।’ যশোরের নকশিকাঁথা বা সেলাই আজ দেশের বাইরেও বিস্তৃত। সেই ঐতিহ্যকে রক্ষা খুব সহজ নয়। তবুও প্রচেষ্টা চলছে-এটাই বা কম কী ’- বললেন তিনি।
ফোঁড় ক্রাফট্স-এর নির্বাহী পরিচালক মামুনুর রশিদ বলেন, ‘দেশের কৃষ্টি সংস্কৃতির অন্যতম ধারক আমাদের সূচিশিল্প। আবহমানকাল থেকে আমাদের মা-বোনেরা তাদের নিপুণ হাতে কাঁথা, রুমাল, বালিশের কভার থেকে শুরু করে জামা-কাপড়েও তুলে এনেছেন সেই শিল্পকর্ম। তাদের সেই কৃতিত্বটুকুর মর্যাদা সমুন্নত রাখা, একাজে উৎসাহ যোগাতে আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াস।’
তিনি বলেন, ‘এবার প্রতিযোগিতায় যশোরের বিভিন্ন স্থান থেকে ১০৫জন অংশগ্রহণ করেছেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মাত্র দুজন কলেজছাত্র (পুরুষ) রয়েছেন। প্রথমপর্যায়ে এই প্রতিযোগীদের মধ্য থেকে ২৫ জনকে বাছাই করা হবে। তারা যাবেন চূড়ান্ত পর্যায়ে।’
তিনি বলেন, ‘২২ মার্চ চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা। সেখান থেকে নির্বাচিত হবেন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়সহ ১০ জন। যাদের প্রত্যেককে নগদ অর্থসহ সম্মাননা স্মারক ও সনদপত্র প্রদান করা হবে।’
২৩ মার্চ যশোর জেলা পরিষদ মিলনায়তনে (বিডি হল) অনুষ্ঠেয় সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধানঅতিথি হিসেবে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. আব্দুস সাত্তার উপস্থিত থাকবেন বলে আয়োজকরা জানান। এছাড়া জাপানিজ কালচারাল অ্যাকাডেমির প্রিন্সিপাল ইয়ানো রিকো, কপোতাক্ষ-জাপানের অর্গানাইজার ফাং ইয়াং জো এবং সদস্য হিরোমি উপস্থিত থাকবেন।
সকালে সূচিশিল্প প্রতিযোগিতা পরিদর্শন ও প্রতিযোগীদের উৎসাহ দিতে চারুপীঠে আসেন যশোর শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর আমিরুল আলম খান, ছোঁয়া হস্তশিল্পের তটিনী সাহাসহ সাংবাদিকরা।#
যশোরে ফের শুরু হয়েছে সূচিশিল্প প্রতিযোগিতা
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।
আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন
মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?
সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.
গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন
=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=
©কাজী ফাতেমা ছবি
বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।
ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন