মেয়েটি সদ্য বিধবা। তার শরীরে কাণায় কাণায় পরিপূর্ণ যৌবন। টলটল করছে যৌবনের সিক্ত রস। চোখে কামনার বহ্নি। একটা কাপড় তার সমস্ত শরীরকে ঢেকে রাখতে পারছে না। খোলা বাতাস তার দেহের ভাঁজে ভাঁজে লুকোচুরির ছলে দোলা দিচ্ছে। ওর ঠোঁটে নব দিগন্তের হাসি।
সেদিন বুধবার। রাহুথড় হাট। হাট থেকে ফিরছে অতুল। অতুল আর প্রতুল দুই ভাই ওদেরকে বলা হয় নারী পালা। মানে নারী পালনকারী। নারীর প্রতি ওদের ছিল বেপরোয়া ভাব। নারী পালন হলো বিবাহ বন্ধন ছাড়া কেবল খাদ্যের বিনিময়ে কোন নারীর সংস্পর্শে আসা। অতুলের সাথে ও মেয়ে লোকটির দেখা। বেচারা পাশ কেটে দাঁড়িয়ে ছিল। আর বোঝেন তো, ‘গু খাওয়া কুত্তা একটু আড়ে আড়ে চায়।’ অতুলও মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটার দিকে তাকাতেই ওর চোখে একটু নেশার গন্ধ পেল। অতুল ঘুরে দাঁড়িয়ে, “কে তুমি?”
“আমার বাড়ি অনেক দূরে। আমার কেউ নেই। বিয়ের পরই স্বামী মারা গেছে।”
“হায়! গো বেচারা। তা, কার বাড়ি যাচ্ছ?”
“আমি কাউকে চিনি না। ভাবছি গ্রামের দিকে গেলে একটা ব্যাবস্থা হবে। এ গ্রামে লোকজনতো কম নেই।”
“দেখ দেখি কি তরি কথা। আমরা থাকতে একজন লোক অসহায় হয়ে থাকবে তা কি করে হয়। চলো, তুমি আমার সাথেই চলো। তবে কাউকে বলবে না তুমি কে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে ওনার আত্মীয়।
মেয়েটি মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ জবাব দিল। কিছু দূরে হেঁটে যেতে না যেতে প্রতুলের সাথে দেখা হলো। উনি হাটের দিকে যাচ্ছেন। হঠাৎ নজরে পড়ল অতুল একটা বিধবা মহিলাকে নিয়ে আসছে। ওর আতে ঘা লাগল। দ্রুত গিয়ে বলল, “ও কে?”
অতুল বলল, “ও আমার সাথে যাচ্ছে”
“না, ও তোর সাথে যাবে না। তোর কাছে এখনও পান্তীর মা আছে। ওকে আমার কাছে দিয়ে যা।”
“দাদা, ভালো হবে না কিন্তু। প্রয়োজনে তুমি পান্তীর মাকে নিও।”
প্রতুল মেয়েটার হাত ধরে টান দিল। অতুলের হাতে কেরোসিন তেলের বোতল ছিল। বোতল দিয়ে প্রতুলের মাথায় আঘাত করল। অতুল ভাবতে পারল না কাজটা কেমন হয়ে গেল। বড় ভাইকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। মেয়েটা পিছন দিকে হেঁটে চলছে। রিপনের সুতীক্ষ্ম চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। ও ঐ মেয়েটার পিছন নিল। মেয়েটি কিছু দূরে এসে একটা সাপ হলো। পিবল নামে একটা ছেলে হাট থেকে পিরান কিনে আনমনে হাঁটছিল। সাপটি তার পায়ে দংষণ করল। সে চিৎকার করল। সাপটি দ্রুত ছুটছে। রিপন ওর পিছনে। মোমিনের ভিটার কাছে এসে সাপটি একটি গর্তে ঢুকে গেল।
রিপন গর্তের পাশে বসে থাকল। ক্রমশয় রাত্রি নেমে আসছে। হাটের লোক চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। চারদিকে নীরব নিথর অন্ধকার। রিপনের হৃৎপিণ্ড দুরু দুরু কাঁপছে। পাশে একটা শব্দ হওয়াতে মাটিতে পড়ে গেল। ভয়ে গা ঘামছে। তবু বসে আছে। হঠাৎ দেখতে পেল গর্ত থেকে একটা ইঁদুর বেরিয়ে যাচ্ছে। রিপন তার পিছন ছুটল। ইঁদুরটি বড় রাস্তায় উঠে গেল। পাশের ধান েেত ঢুকে গেল। রিপন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকল। হঠাৎ দেখতে পেল ধবধবে সাদা একটি খরগোশ রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। পাশের বাড়ি উঠে খরগোশটি বিশাল একটি দৈত্যের বেশ ধারণ করল। কে যেন একজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে এসেছিল। আর্তচিৎকার করে সে মাটিতে পড়ে গেল। রিপন ভয়ে কাঁপছে। দৈত্যটা আবার খরগোশের বেশ ধারণ করল। বড় রাস্তা ছেড়ে চলছে বিলের দিকে। হঠাৎ বাঁক ঘুরে মোড় নিয়েছে খালের দিকে। খালপাড় এসে আবার ঐ বিধবা মহিলার বেশ ধারণ করল। রিপন এবার সাহস নিয়ে বলল, “কে তুমি?”
“আমাকে এখনও চিনতে পারনি? আমি নিয়তি। যার যে ভাবে মৃত্যু আমি সেই মৃত্যুর পরিবেশ সৃষ্টি করি। জেনে রেখ, তোমাকেও একদিন মরতে হবে। আর সে কাজ আমিই সুসম্পন্ন করব।”
রিপন ভয়ে কাঁপছে। তবু সাহস নিয়ে বলল, “আমি কিভাবে মরব?”
“মৃত্যুর আগে মৃত্যুর খবর জানলে সুস্থ্য ভাবে বাঁচতে পারবে না। সারাটা জীবন কষ্ট পাবে। মৃত্যু যন্ত্রণা তোমাকে কুড়ে কুড়ে মারবে। ঐ একটি আতংকই সারা জীবনের সুখকে বিনাশ করবে।”
“তবু বল।”
“তোমার মৃত্যু হবে কুমীরের হাতে। আমি কুমীর হয়ে ঠিক দিন তোমাকে নিয়ে যাব। সেদিন আর কোন প্রশ্ন থাকনে না।”
মহিলাটি অন্তর্ধাণ হলো। রিপন তখনও ভয়ে কাঁপছে। হঠাৎ দেখল সুন্দর এক পুরুষ। পুরুষটি ওকে বলল, “কি বৎস, ভয় পাচ্ছো? একটা কথা মনে রেখ, পৃথিবীতে জন্মটা যত সত্য মৃত্যু তার চেয়ে অধিক সত্য। প্রতিটি প্রাণীরই মরতে হবে। আজ যারা মরল কালকের পৃথিবীতে তারা অতীত। এরাও বেঁচে রবে তবে সে মানুষের অন্তরে। তুমি এমন কিছু কর যাতে মানুষের অন্তরে বেঁচে রবে। এ দেহ নশ্বর। এ মুখে বেশি দিন কথা বলবে না। তুমি এমন কিছু কর যাতে তোমার এই কথা অন্য মুখে বলবে। বাড়ি ফিরে যাও। মনে করে আজকের এতোটুকু সময় ছিল ভুল।”
রিপন অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরল। তখন রাত তিনটা। বাবা-মার চোখে ঘুম নেই। দুটি নীরব প্রাণী তখনও জেগে আছে। হায়রে মায়ার সংসার। এক মুহুর্তে সব ফেলে চলে যেতে হবে। এই ঘর, এই সংসার সবই ণিকের। নিয়তির হাতে সকল বন্ধন মুক্ত হবে। রিপনের সারা রাত ঘুম এলো না। সকালে বাবাকে বলল, “আমি অনেক দূরে চলে যাব যেখানে কোন জল নেই। জল থাকলেও সে জল হবে সামান্য।” বাবা-মা ছেলের কথাকে প্রাধান্য না দিয়ে পারল না। কিন্তু জলতো সব জায়গাই আছে। জলহীনে জীবন বাঁঁচে না। ও চলে এলো ঢাকায়। একদিন এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে গেল এক নাচের আসরে। সেখানে বাংলাদেশের সেরা শিল্পীরা নাচবে। নাচের ফাংশনে রিপনকে বেশ আনন্দ দিল। নাচ দেখে আসার সময় গাড়ি চাপা পড়ে বন্ধুটি মারা গেল। বন্ধুর লাশ পুলিশ হেপাজতে থাকল। ও অনেক কষ্ট করে বাসায় ফিরল।
অনেক দিন গত হলো। একদিন আরেক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে ভুল করে অন্য বাসায় ঢুকল। বন্ধুর ঠিকানা ভুল ছিল। ও ঢুকতেই দেখল দুই ভদ্রলোক বসে বসে বাজাচ্ছে। আরেক সুন্দরী নাচছে। রিপন দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। বাড়িটা একেবারে ফাঁকা। আশে পাশে যেন আর কেই নেই। এ বাড়িটা যেন জলসা ঘর। ভদ্রলোক দুজন বেশ তাল দিচ্ছে আর কাঁচের পাত্রে মদ পান করছে। মেয়েটির ঠোঁটে চিকন হাসি। চোখ দুটো কামনার কামিনী। অর্ধখোলা পোশাকে সে যেন একেবারে মনকাড়া ময়ূরী। রিপন যে ভুল করে ঢুকছে তা তারও মনে নেই। ঐ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। যৌবন আকর্ষণ ওর মাঝেই যেন চাপা থাকছে না। যৌবন পরিমল বাতাসকে মাতিয়ে তুলছে। এক ভদ্রলোক নাচুনীর হাত ধরে কাছে টানতে আরেক ভদ্রলোক উঠে তাকে বুঝাতে চেষ্ট করল। কিন্তু মেয়েটি আরো কাছে আসায় ওর দিকে তাল দিতে গেল। ঐ ভদ্রলোক আরো রেগে উঠল। নারীর লোভ সামলানো কঠিন। ভদ্রলোকটির হাতের পেয়ালা দিয়ে ঐ ভদ্রলোকের মাথায় আঘাত করল। লোকটা রঙ্গিন কার্পেটের উপর ঢলে পড়ল।
রিপন দ্রুত বেরিয়ে গেল। দেখল মেয়েটি ওর আগে বাড়ির দরজায় দাাঁড়িয়ে আছে। ওর ঠোঁটে লিপিস্টিকের হাসি। বলল, “আমাকে চিনতে পারছো?”
রিপনের মুখেও হাসি ফুটল। চিন্তা করল বেশতো এর সাথে পরিচয় থাকলে মন্দ হোত না। ওকে দেখতে দারুণ ফিট। বলল, “নাতো, কে আপনি?”
“নিয়তি। আমি নিয়তি। পৃথিবীর সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও মৃত্যুকে ফাঁকি দিকে পারবে না। ওরা স্ত্রীকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে এসেছে এই নির্জনে। কিন্তু আমাকে ফাঁকি দিতে পারেনি। এখানেই আরেক জনের মৃত্যুর সূত্রপাত হলো।”
রিপনের দামাল হাসি থেমে গেল। লোভ তাকে কত দূরে নিয়ে এসেছে। মেয়েটি বলল, “কি হলো? আমাকে পেতে ইচ্ছে করে? লোভ ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। তোমার কাছে আসতে এখনও অনেক দেরী। অপো কর; আসব। কিন্তু দুঃখ তুমি আমার যে বেশটা পছন্দ করেছো এ বেশে তোমার কাছে আসতে পারব না। আমার অঙ্গে যে উদগ্র মধুর উৎস্য তোমার দিনে ময়লায় পরিণত হবে।”
মেয়েটি চলে গেল। রিপনের কাছে এখন প্রত্যেকটি প্রাণীকেই নিয়তি মনে হচ্ছে। প্রত্যেক স্বপ্নে দেখে একটা বিরাট কুমীর তার ঘার ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে লোক কিন্তু কেউ তার কথা শুনছে না। ও চিৎকার দিয়ে ওঠে।
পাশের বন্ধু বলল, “কিরে, এমন করছিস কেন?”
রিপন ঢোক গিলে, “দরজা ঠিক মত বন্ধ করছিসতো?”
“কেন?”
“যদি কুমীর আসে।”
বন্ধুটি হেসে, তুই কি পাগল হয়েছিস?”
“বাঁচতে হলে পাগলই হতে হবে।”
“সত্যি বলতো কি হয়েছে?”
“আজ নিয়তির সাথে দেখা হয়েছিল।”
“কি বললি! নিয়তির সাথে দেখা? তুই শালা ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস।”
“জলেই কুমীর আর কুমীরই আমার নিয়তি।”
“কোথায় দেখা হয়েছিল তাই বল?”
“ঐতো ঐ বাড়িতে।”
“কি বলল?”
“আমি ভালো কিছুই করিনি।”
“হ্যারে, মেয়েটি দেখতে কেমন? একদিনও আলাপ করিয়ে দিলি না। শালা দিনগুলি বেশ ভালোই যাচ্ছে। ওর সাথে কবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিস?”
“বাঁচবি না। মরে যাবি।”
“কিছু কিছু মেয়ে দেখে মরলেও শান্তি।”
তাহলে মরার সময় ঠিকই দেখা হবে।”
“বাজে কথা রাখ। বিবরণটা দেতো। কেমন গায়র রং? কেমন পোশাক পছন্দ করে? কি খেতে ভালোবাসে? আর শিউলির চেয়ে ভালো হলে বুঝিসতো, ওকে ডিলিট দিয়ে দিবি।”
“শিউলি আমার ভালোবাসা, আমার অহংকার। শিউলির বুকে মৃত্যু মানে সোজা স্বর্গে। নিয়তি আমার জীবনটাকে দুঃসহ বেদনায় ভরে তুলছে।”
বন্ধুটি বুঝল ওর সাথে কথা বলে টিকে থাকা যাবে না। রিপনও তাকে ঠিক বোঝাতে পারছে না। এ নিয়তি ঠিক সে নিয়তি নয়।
রিপন বাড়ি ফিরে আসছে। বাবা-মা তাকে জোর করে বিয়ে দিল। শিউলি তার জীবনের বাইরে রয়ে গেল। না পাওয়ার বেদনা বুকে নিয়ে একটু সুখ অনুভব করল। কারণ শিউলির বিধাব মুখের হাসিতে পৃথিবীকে সে রাঙ্গাতে চায় না। ভালোবাসার সুখ কামনা করা সবার কর্তব্য।
স্ত্রীর সাথে রিপনের মেশে না। একদিকে শিউলি অন্য দিকে নিয়তি। রিপন স্ত্রীকে বলল, “তুমি আমার নিয়তি নয়তো? হঠাৎ করে আবার কুমীর হয়ে যাবে নাতো?”
“বাহুল্য কথা বাদ দাও।”
“তুমি জান আমি কুমীরের হাতে মারা যাব। তাই øান করি না। কাউকে কথাটি বলিনি। আজও বলতে চাইনি। তুমি যদি চাও আমি øান করতে পারি।”
“ঠিক আছে, আমি তোমাকে বালতি ভরে জল এনে দেই তুমি øান কর।”
কয়েকদিন বালতি ভরে øান করল। একদিন স্ত্রী এক বালতি জল এনে আরেক বালতি আনতে গেল। রিপন বালতির দুই পাশে হাত দিয়ে মাথায় ঢালবে হঠাৎ বালতি থেকে একটা কুমীর মাথা বের করে রিপনের ঘাড় ধরল। রিপন চিৎকার করল। কুমীর ওকে পুকুরের দিকে নিয়ে গেল। স্ত্রী দৌঁড়ে গিয়ে কুমীরের লেজ টেনে ধরল। ততণে রিপনের আত্মা চলে গেছে বহু দূরে। কুমীরটি ঘুরে দাঁড়িয়ে একটা মানুষের বেশ ধারণ করল। বলল, “আমি নিয়তি। সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও আমাকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব না। মৃত্যুকে কেউ ফাঁকি দিতে পারেনি। তুমিও না। মৃত্যু প্রত্যেকটি জীবের কাম্য।
৩১ ডিসেম্বর ২০০৫ইং, ডায়না প্যালেস, ঢাকা কেরাণীগঞ্জ-১৩১০।