হৃদয়ে বাংলাদেশ
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
"হৃদয়ে বাংলাদেশ" শব্দটা কে কতটুকু বিশ্বাস করেন জানিনা। আমার এ ব্যাপারে বিশ্বাসটা অনেক গভীর। আমি লোক দেখানো দেশ প্রেমিক নই, কখনও ছিলামনা। এ বিষয়ে পরে আসছি। আজকে সিডনীতে দেখা তিনটা ঘটনা বলি আগে।
১) আমাদের বাসায় কিরণ (ছদ্মনাম হতে পারে) নামের ছেলেটির আগমন ঠিক কার মাধ্যমে, সেটা মনে নেই, কিন্তু এই ছেলেটি অল্প কিছুদিনের ভেতর সবার বন্ধু হয়ে যায়। একটা সময় সে নিজের বাসা ফেলে আমাদের বাসায় থাকতে শুরু করে সপ্তাহে তিন চার দিন। কয়েকটা ছেলে এক সাথে থাকলে সব চাইতে বড় সমস্যা হয় রান্না বান্না নিয়ে। কেউ সময় মত রান্না করতে চায় না, ফলে অনেক সময়েই কেউ না কেউ অভুক্ত থেকে কাজে বা ক্লাসে চলে যায়। কিরণ যে কয়দিন থাকতো, নিজেই সবার জন্য রান্না করতো, কাজেই আমরাও খুশী হতাম সে থাকলে। শান্তশিষ্ট ছেলে, কারও সাথেই তেমন তর্কে যেত না। আর আমাদের মাঝে একটা অলিখিত নিয়ম ছিল, আমরা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তেমন কথা বলতাম না। সবাই মোটামুটি আলাদা মতাদর্শের মানুষ বলে এই সমস্ত আলাপে আসলে কোন সমাধান কখনই আসতো না, বরং বড় ধরনের ঝগড়া লেগে যাবার আশঙ্কা থাকতো। যা হোক, সেই কিরণ এক সময় অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পেয়ে যায় আর পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে। কয়েকদিন পর কথায় কথায় সে বলে যে অস্ট্রেলিয়ার পাসপোর্ট পেলে সে বাংলাদেশের পাসপোর্টটি ফেলে দেবে এবং বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেবে। একটা সময়ে সে এই কথাও বলে যে বাংলাদেশের পাসপোর্টটি সে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষবে। সহ্য করতে পারিনি সেদিন এই কথা। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব তাকে কে দিয়েছে। বলে - জন্মের সময় উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছে সে। তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম সে জারজ সন্তান কি না, তার রক্তে দোষ আছে কি না। এর পর থেকে কিরণ আর আমাদের বাসায় আসেনি। কিরণের সাথে একটা ছোট ব্যাগ সব সময় থাকতো। ব্যাগটার ওপর বাংলাদেশের পতাকা আঁকা আর নীচে লেখা "হৃদয়ে বাংলাদেশ"।
২) হাসান ভাইয়ের সাদা গাড়ীর পেছনে স্টিকারে লেখা "হৃদয়ে বাংলাদেশ - Bangladesh in my heart "। খুব ভাল লাগতো দেখতে। রীতিমত গর্ব বোধ করতাম ওই গাড়ীটা মাঝে মাঝে ড্রাইভ করতে বা ঘুরে বেড়াতে। হাসান ভাইয়ের বাসায় গেলে মন ভরে যেত। বাসার সব কিছুতেই বাংলাদেশের ছাপ। ঘর সাজানো থেকে শুরু করে রান্না বান্না, বাচ্চাদের কথাবার্তা (এখানে যে সব বাচ্চার জন্ম তাদের অনেকেই বাংলা বলতে পারেনা, অন্তত ভাল পারেনা, অনেকেই পড়তে পারেনা বাংলা), ভাবীর সব সময় শাড়ী পড়া, যে কোন ফাংশনে ভাবীর গান, হাসান ভাইয়ের দেশের জন্য চিন্তা - সব মিলিয়ে অসাধারণ পরিবেশ। যেন বিদেশের বুকে একটুকরো বাংলাদেশ। হাসান ভাই বছর দুই আগে সপরিবারে দেশে চলে গেছেন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে।
৩) এই ঘটনাটা কয়েকদিন আগের। ট্রেনে করে আসছিলাম কাজ থেকে বাসায়। সামনের সিটে একটা মেয়ে বসেছে। দেখে ভেবেছিলাম ইন্ডিয়ান। লো কাট টপস আর জিন্স পড়া। চুলে দু তিন রকম রঙ করা। কিছুদূর আসার পর মেয়েটা ফোন বের করে পরিষ্কার বাংলায় কথা বলতেই বুঝলাম এটা খাটি বাংলাদেশী। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে যা যা বললো তার সারমর্ম এই রকম -
(ক) হিজাব হচ্ছে পাকিস্তানী কালচার, তাই সে হিজাব ব্যাবহারের পক্ষপাতী না। ফোনের অপর প্রান্তের কাউকে সে হিজাব না পড়ার উপদেশ দিচ্ছে।
(খ) এ দেশে সে এদেশীয় মেয়েদের মত কাপড় পরে, তার না কি "হৃদয়ে বাংলাদেশ"।
(গ) দেশে আমরা সব তেল চর্বি ওয়ালা বাজে খাবার খাই, তাই সে এদের খাবারের স্টাইল ফলো করে। সবারই সেটা করা উচিৎ।
(ঘ) সে দেশে যায়না, যাবেওনা কারণ বাংলাদেশে অত্যধিক পলুশন।
(ঙ) ইন্ডিয়ান কালচার অনেক হাই স্ট্যান্ডার্ডের, কাজেই বাংলাদেশীদের উচিৎ ইন্ডিয়ান কালচার ফলো করা।
(চ) এই দেশে কিছু কিছু বাংলাদেশী মেয়ের দেশী স্টাইলে পড়া কাপড় চোপড় দেখে সে নিজেকে বাংলাদেশী পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করে।
- এমন আরও অনেক কিছু।
বাসায় এসে প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ নিয়ে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, যেটা পড়ার পর অনেকেই বলেছিল তাড়াতাড়ি মুছে ফেলতে। স্ট্যাটাসের ভাষাটা অতিরিক্ত রকম কঠিন আর অশ্লীল হয়ে গিয়েছিল।
আমি অনেককে, শুধু বাংলাদেশী না, যে কোন দেশের লোককেই একটা কথা বলি - এই দেশ আমার দেশ না। এখানে একশ বছর থাকলেও নতুন কারও সাথে পরিচিত হলে সে জানতে চাইবে "Where are you FROM?"। "হৃদয়ে বাংলাদেশ" কথাটার মানে আমার কাছে - হৃদয়ের মাঝে একটুকরো বাংলাদেশ লালন করা। লোক দেখানো কিছু করার চাইতে আমি নিজে কতটা করতে পারি, আমার কাছে সেটাই বড়। দেশের জন্য ভালবাসা, মাটির জন্য ভালবাসা - সেটা আমার অন্তরে হীরের মত জ্বলজ্বল করে। এটা দশজনকে বলে বেড়ানোর বিষয় না। যারা দেশে আছেন, তারা এই ভালবাসায় শ্বাস নেন প্রতি মুহূর্তে, আপনারা হয়তো এতটা গভীর ভাবে অনুভব করবেন না, যতটা প্রবাসীরা করে। দেশ আমাকে কি দিয়েছে, তার চাইতে আমি দেশকে কি দিয়েছি - সেটাই আমার কাছে বড়। হ্যাঁ, আমার দেশে ধুলোবালি, মশা মাছি, চোর ডাকাত, ভাঙ্গা রাস্তাঘাট, দুর্নীতি, হতাশা - সব আছে। তবুও সেটা আমার দেশ। মা যেমন আমার আপন, নিজের গর্ভে ধারণ করেছেন দশটি মাস, লালন করেছেন নিজের শরীরের নির্যাস দিয়ে, তেমনি দেশমাতৃকাও আমাকে লালন করেছে বেঁচে থাকার অক্সিজেন দিয়ে, গলা ভেজানোর জন্য পানি দিয়ে, মন ভরানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দিয়ে, হাজার ব্যঞ্জনে পেট ভরানোর ব্যবস্থা করে। মা এবং মাটি - দুজনের কাছেই আমি সমান ঋণী।
"হৃদয়ে বাংলাদেশ" এমন একটা ব্যাপার, যা বাংলাদেশকে মোটা ছালার বস্তায় ভরে হৃদয়ে তালা দিয়ে রাখাকে বোঝায় না। বরং বুকের মধ্যে নিরন্তর ধুকপুক করা হৃৎপিণ্ডের মত জীবন্ত একটা অনুভূতি লালন করাকে বোঝায়। হৃৎপিণ্ড ছাড়া যেমন দেহটা মৃত, তেমনে হৃদয়ে বাংলাদেশ না থাকলে সেই বাংলাদেশীও মৃত ছাড়া আর কিছুই নয়।
সবাই ভাল থাকবেন।
৯টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আমরা কেন এমন হলাম না!
জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন
অভিমানের দেয়াল
অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি
২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১
তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন
One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes
শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন