somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাঁজরে নৈঃশব্দের সুর (গল্প)………নীলাঞ্জনা নীলা

০৩ রা মার্চ, ২০১২ ভোর ৪:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নিয়নীর গাড়ী যখন পিচের রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তায় পড়লো আর এগুচ্ছিলো না।ওখানেই নেমে পড়লো ।সেই পথ আর নেই ।শুধু দুই পাশের ধান ক্ষেত এখনো তার সবুজ-হলুদ রঙ দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে ।অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে ।মাথার ওপর প্রখর রৌদ্র,কিন্তু খেয়াল নেই ।এসব জমি নিয়নীর বাবা মানস চৌধুরীর ছিলো ।কতো বৎসর পরে এলো এখানে ?হিসেব নেই ।শেষ যখন আসে অনেকগুলো কাজ নিয়ে তাই গ্রামের বাড়ীতে সময় দেয়া হয়নি ,বাপি বারবার বলছিলো এরপর যখন আসবি আমি থাকবো না রে ।অনেক অনুরোধ আর কি দুটো দিন থেকে যেতে পারিস না ?বন্ধু প্রিয় নিয়নী অনেকদিন পরে বন্ধুদের পেয়ে মেতে উঠেছিলো আনন্দে ।

কতো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ।“কার বাড়ী যাইবেন আপনে ?” হঠাৎ ডাকে চমকে গেলো নিয়নী ।
মানস চৌধুরীর বাড়ী,চেনেন ?
উনি তো আর নাই ।আর তাঁর জায়গা-জমিও দখল করসে তাঁর জ্ঞাতি-গুষ্টি ।
আমি জানি ।আমি উনার মেয়ে বাড়ী দেখতে এলাম ।আপনি কে ?উনার তৈরী মন্দিরটা তো আছে সেটাই দেখবো ।
আপনি নিয়নী ? আহারে জেঠা আপনারে খুব দেখতে চাইসিলো । কতো কইসে আমার মেয়েটারে খবর দেও খুব দেখতে ইস্যা করতেসে । কেন আইলেন গো বইন ? আমি আপনাগো জমিতে কাম করতাম । যান বইন মন্দির দেখেন । কেবল নিজেরে শক্ত কইর‌্যা রাইখেন ।

ফটোসান চশমার জন্যে চোখের জলের ঝিলিক দেখতে পেলো না কেউ । এগিয়ে গেলো সামনের দিকে । অল্প পথ তবুও যেনো শেষ হচ্ছিলো না । এই জায়গা বিক্রীর জন্য কম দৌঁড়ায়নি নিয়নী । শেষদিকে এসে হার মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না । আর বাপিও কম দামে ছাড়বে না । এই দেশে হিন্দু আইনে মেয়ে জায়গা পায়না । তাই বাপি উইল করে দিতে চেয়েছিলো , কিন্তু নেয়নি সে । অরূপ চেয়েছিলো । আহ্ অরূপ ! ভুল সিদ্ধান্তে জীবন যে কতোটা বদলে যায় । আর এই অরূপের জন্যই বাপি কে হারাতে হলো । জীবনে কখনো ভেবে-চিন্তে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি সে । শুধু অরূপ কে বিয়ের আগে ছয়টি মাস অনেক ভেবে তারপর জানিয়েছিলো নিয়নী তার সিদ্ধান্তের কথা । আর এতো বড়ো সিদ্ধান্তের পরিণতি শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদ তখন যদি জানতো ! একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে পড়লো অগোচরে । চোখের সামনে কচুরীপানা ভরা পুকুর , নিস্তরঙ্গ চেয়ে আছে আকাশের দিকে । পুকুর পাড়ে সেই কড়ই গাছের সারির মাত্র একটি-ই দাঁড়িয়ে আছে । নিঃসঙ্গ গাছটা যেনো তারই মতো । চারিদিকে ঝিম মেরে বসে আছে , একটুকরো বাতাসের ছোঁয়া নেই । অথচ দুলে উঠলো গাছটা । গাছটা কি চিনেছে তার মালিকের মেয়েকে ? মামনি বলতো গৃহপালিতরা ঠিক তার মালিককে চিনতে পারে শুধু মুখ খুলে বোঝাতে পারেনা । এই গাছটিও হয়তো চিনে ফেলেছে । পুকুর ঘাটের অস্তিত্ত্ব নেই বললেই চলে । অথচ এই ঘাটেই কতো জলকেলি । সাঁতার না পারা মেয়েটা কি চিৎকার জলে নেমে । যদিও এই বাড়ীতে খুব কমই থাকা হয়েছে । বাপি চাকরী করতো শহরে । বৎসরে একবার আসা হতো তাও ভরা পূর্ণিমায় । আর বাপির চাকরী শেষ হবার পরে তো এই গ্রামেই ঘর তুলে থাকা শুরু করলো । কোনোভাবেই আর শহরমুখী করা গেলো না । আর হবেইবা কি করে জীবনে এতোটাই সৎ ছিলেন মানস চৌধুরী যে উনার ঘুষবিহীন জীবনে কিছুই করা সম্ভব হয়নি । তাই তো শহর থেকে গ্রামে।এসবের কিছুই হতো না যদি নিয়নীর বিয়ে না হতো , যদি দেশ ছেড়ে প্রবাসী জীবনকে গ্রহণ না করতো । আর সবচেয়ে যে ভুলটা তাড়িয়ে ফেরে এখনো সেটা হলো স্বদেশের চাকরী ছেড়ে দেয়া । শুধু অরূপের জন্য সবকিছু ফেলে ছুটে যাওয়া নিয়নী না পেলো অরূপ কে , না বাপিকে । ঘাটের পাশে বসলো নিয়নী । এই ক্ষয়ে যাওয়া ঘাট দেখে কে বলবে এ একসময় কতো অপরূপ ছিলো ! কতোটা জৌলুষ ছিলো এই পুকুরের সবুজ জলের । অনেক চেষ্টা করেও সাঁতার শেখা হয়ে ওঠেনি নিয়নীর । জলে নেমেই শুরু হতো চিৎকার । যারা জানতো না ওর আগমনের কথা সেই চিৎকারে তারাও বুঝে ফেলতো আনন্দবতী , উচ্ছ্বল মেয়েটি এসেছে । সেই জলে নেমে একটা ডুব তারপর ভেঁজা কাপড়ে পাড়ে বসে শুরু হতো গল্প । কখনো যদি কাকু বা দাদু চলে আসতো জোরে শুরু করা আদুরে গালমন্দ । সবাই ওর এসব কথায় হেসে ফেলতো , আচ্ছা রে মা তুই থাক , আনন্দ কর । আর দাদু এসেই বলতো ঠান্ডা লাগবে তো ! যা রে দিদিভাই আর ভেঁজা কাপড়ে থাকিস না । কে শোনে কার কথা ! যারা চলে যেতে চাইতো আটকে রাখতো , থাকো না পিসি আবার তো চলেই যাবো । ওই মায়াময়ী কন্ঠের আবেদন অগ্রাহ্য করে কার সাধ্য !

ভাঙ্গা ঘাট থেকে নিজেকে উঠিয়ে নিয়ে পা বাড়ালো বাড়ীর দিকে।দক্ষিণের ঘরে আগেই বিল্ডিং ছিলো , এখন আরো হয়েছে । শুধু ভেঙ্গে গেছে ভাইদের একতা । দাদু আর দিদা থাকার সময় যে বৌয়েরা একসাথে থাকতো , এখন আর মুখ দর্শনও করে না একে অপরের । ওই দিদা বাপির কাকী ছিলো , যার জন্যে এক হাঁড়ী ভিন্ন হতে বাধ্য হয়েছিলো । যদি উনি বেঁচে থাকতেন আজ হয়তো তাঁর নিজস্ব অতীত কর্মকান্ডের রেশ দেখতে পারতেন । শেষদিকে অবশ্য একটু নাকি দেখা হয়েছিলো ! নিয়নী মৃত্যুর পরের স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস করেনি কখনো । ওর মতে মানুষের সমস্ত ভুল আর শুদ্ধের ফল বেঁচে থাকা অবস্থাতেই পেয়ে যায় । নিজের আজকের এই দিনের জন্য নিয়নী ভাবে এও তার কর্মফল । তবে একটুকুও খারাপ নেই । বরং ভালোই আছে । সেই কবে দিদিমা নিয়নী কে বলেছিলো , দেখিস তোর শেষ জীবনটা খুব ভালোই কাটবে । তাইতো হচ্ছে । অরূপ কে ছেড়ে দেবার পরে বেশ কিছুদিন খারাপ লেগেছিলো । ছেলেটা কে নিয়ে অনেক বন্ধুর পথ পার করতে হয়েছে । সেই সময়টা কি যে দুঃসহ ! তবে বন্ধু নিখিল নিঃস্বার্থভাবে নিয়নীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো । ছেলেটার মুখের দিকে চেয়েই কষ্ট হতো । বিয়ে করেনি শুধু রাজের কথা ভেবেই । অবশ্য নিজেরও একটা ভয় ছিলো যদি আবার সেই জীবনের মতো সময় চলে আসে ! আর চিন্তা করতো যদি কখনো রাজ তার মাকে এসে অভিযোগ করে তুমি দোষী মামনি । এই ভয়ে দিনগুলোকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো । অবশ্য কখনোই নিয়নী রাজের থেকে তার বাবাকে দূরে রাখেনি । যখন চেয়েছে বাবা-ছেলে দেখা করেছে । কিন্তু অবাক ব্যাপার এতো কয়টা বৎসরেও কখনো রাজ জিজ্ঞাসা করেনি কেন নিয়নী আলাদা হয়েছে । বরং মা কে অনেকটুকু সময় সঙ্গ দিয়েছে যা আজকের ছেলেদের থেকে আশাও করা যায়না । প্রবাসী জীবন থেকে যখন দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ আর ওর বৌ এষা ছাড়তে চায়নি নিয়নী কে । মেয়ের শখ মিটিয়ে দিয়েছে এষা ।

আদরের স্থানগুলো বড্ড তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায় । উত্তরের ঘরের দাদু বেঁচে থাকার সময় বাড়ীতে বেড়াতে এলেই পিসিমনি কে বলতেন , আমার দিদিভাই এসেছে রে । ছোট্ট আলু কড়া করে ভাঁজি কর রে মনি । ঘন ডালও রান্না করিস । আজ কোথায় সেই দাদু আর সেই আলুও বাজার থেকে হারিয়ে গেছে । সেই দরিদ্র দশা এখনো কাটেনি । বাড়ীতে এলেই লুকিয়ে পান-সুপুরি খাওয়া হতো দিদার কাছে গিয়ে । সেই দিদার হাসি যা সুন্দর ছিলো এককালে । শেষ যখন দেখে ফোঁকলা দাঁত কিন্তু সেই হাসিটুকু ছিলো তখনো । বাড়ীতে অনেক মানুষ শুধু সবাই তাকে দেখেই যাচ্ছে , কিন্তু কেউ কোনো কথা জানতে চাইছে না । কাকাত ভাই অমিত কে সে ঠিকই চিনে ফেলে । শরীর কতো ভারী হয়ে গেছে । পুরোদস্তুর সংসারী ।

কি রে কেমন আছিস ? চিনতে পারিস আমাকে ?
দিদিভাই তুমি ! কবে এলে বিদেশ থেকে ? দিদিভাই ঘরে আসো । এই রানী দেখো কে এসেছে ! প্রণাম করো ।

নিয়নী সত্যি অবাক হলো । তার মানে এখনো কেউ মনে রেখেছে । নইলে দক্ষিণের ঘরের অনেকেই দেখলো কেউ তো জানতেই চাইলো না । বললো , না রে বাপি-মামনির ঘরটা দেখতে এসেছি । মন্দিরটায় কে পুজো দেয় রে ? নীরব হয়ে গেলো অমিত । দিদিভাই সেই মন্দির তো আর নেই । দখল হয়ে গেছে জেঠু চলে যাবার পরেই । থমকে গেলো নিয়নী । এমন করেই কি হারিয়ে যায় ? চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবীটা একেবারে জন-মানবহীন । বড়ো নিঃসঙ্গ লাগছিলো । অনেক কিছুই তো হারিয়ে গেছে জীবন থেকে । কিন্তু তবু এমন কষ্ট হয়নি ।

ধীর পায়ে আবার যে পথ দিয়ে এসেছিলো মাথাটা নীচু করে বয়সী শরীর নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো । পেছন থেকে অমিত ডাকছে দিদিভাই কোথায় যাও ? কিন্তু ওর কানে সেই ডাক যাচ্ছেইনা । ড্রাইভার দরোজা খুলে দিলো । করিম গাড়ী ঘোরাও । করিম জানে তাকে কোথায় যেতে হবে । নিয়নী কে তার নিজের আশ্রম ডাকছে । যেখানে সে এখনো আড্ডা দেয় , গান গায় । নাচতে গেলে হাঁপিয়ে যায় । মাতিয়ে রাখে সমস্ত নিঃসঙ্গ বন্ধুদের । এখানে সে অভিনয় করে না , তবে অনেক রাতে দৃষ্টি কিছু খোঁজে । কি জানি কি খোঁজে বুঝে পায়না নিয়নী ।

দেওছড়া চা’বাগান,শমশেরনগর,মৌলভীবাজার
০৭ আগষ্ট , ২০১০ ইং ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১২ সকাল ৮:১৯
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×