somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিয়ে একান্ত ব্যাক্তিগত

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মূলঃ চিনুয়া এচেবে
অনুবাদঃ মেহেদী হাসান
একদিন পড়ন্ত বিকেলে লাগস শহরের ১৬ নম্বর কানসাঙ্গা রোডের বাসায় ন্যানে তার প্রেমিক নাঈমেকে কে জিজ্ঞেস করে, “তুমি তোমার বাবার কাছে এখন পর্যন্ত চিঠি লেখনি?”
“না, এই বিষয়টাই আমার ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ভাবছি ছুটির সময় বাড়িতে গিয়ে বললেই বোধ হয় ভালো হবে।”
“কিন্তু কেন? তোমার ছুটির তো এখনও অনেক দেরী-পুরো ছয় সপ্তাহ। তাহলে সে আমাদের শুভ সংবাদের কথা জানতে পেরে সুখী বোধ করবে কিভাবে।”
যেন সে মনের ভেতরে কথা খুঁজে বেড়াচ্ছে এমনিভাবে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাঈমেকে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে, “এ খবরে সে যে সুখী হবে- তা যদি নিশ্চিত হতে পারতাম তাহলে তো কোন দুঃশ্চিন্তাই ছিল না।”
“অবশ্যই সুখী হবে,” খানিকটা বিস্মিত হয়ে ন্যানে জানায়, “ এতে তার আনন্দিত না হওয়ার তো কোন কারন আমার চোখে পড়েনা।”
“তুমি জন্ম থেকেই সারাটা জীবন ধরে এই লাগস শহরে বসবাস করে আসছো এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন সমন্ধে তোমার তেমন কোন ধারনা নেই বললেই চলে।”
“তোমার শুধু ঐ এক কথা, এটা ছাড়া তোমার যেন আর কিছু বলবার নেই। আমি কিন্তু ভাবতেই পারিনা যে ছেলে যখন বিয়ে করার জন্য মনঃস্থির করে ফেলেছে, অন্যদের মত না হয়ে কোন পিতা অসুখী বোধ করতে পারে।”
“হ্যাঁ, তারা অসুখী হবে যদি বিয়ের সকল রকম আয়োজন তাদের দ্বারা সম্পন্ন না হয়, আমাদের দুজনের ক্ষেত্রে বিষয়টা অবশ্য আরো ভয়াবহ- তুমি আমাদের আইবো সম্প্রদায়ের কেউ নও পর্যন্ত।”
এই কথাগুলো এত গম্ভীর ও রূঢ়ভাবে বলা হল যে, তাৎক্ষণিকভাবে ন্যানের মুখ দিয়ে কোন কথা যোগালো না। এই শহরের বিশ্বজনীন আবহে বাস করে উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে উঠার ফলে, কে কাকে বিয়ে করবে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কোন পিতা-মাতা যে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠতে পারে- এটা তার কাছে হাস্যকর বিষয়ের মত মনে হয়।
অবশেষে সে উচ্চারণ করতে পারলো, “তুমি কি আসলেই মনে করোনা যে, আমাদের দুজনের বিয়ে করার বিষয়টি সে শুধু মাত্র বিয়ে হিসেবে দেখবে। আমার সবসময় মনে হয়েছে তোমরা আইবো সম্প্রদায়ের লোকজন অন্তত অন্যদের ব্যাক্তিগত বিষয়গুলো তাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার উপর ছেড়ে দাও।”
“তা ঠিক বলেছো। কিন্তু যখন বিয়ের প্রসঙ্গ আসে, যা হোক বিষয়টা অত সোজা নয়,” সে যোগ করে, “এটা শুধুমাত্র আইবো সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই নয়। যদি তোমার বাবা জীবিত থাকত এবং তাকে ইবিবিও এর মত প্রান্তিক অঞ্চলে বাস করতে হত তাহলে তার আচরণ পুরোপুরি আমার বাবার মতই হত।”
“তা আমি বলতে পারবো না। কিন্তু যাই হোক যেহেতু তোমার বাবা তোমাকে অনেক বেশী ভালোবাসে সুতরাং আমি আমি নিশ্চিত, উনি তোমাকে খুব শীঘ্রই ক্ষমা করে দেবেন। আসো, ভালো ছেলের মত উনাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে সুন্দর করে একটা চিঠি লেখ।”
“চিঠি লেখে উনার কাছে খবরটি পৌছে দেয়া কোন বিবেচক কাজ হবে বলে মনে হয় না। আমি মোটামুটি নিশ্চিত এরকম কোন চিঠি পেলে উনি বড় রকমের একটা ধাক্কা খাবেন, এমনকি বলা যায় না- হার্টফেল হয়ে যেতে পারে।”
“আচ্ছা সোনা, নিজেই বুঝে দেখ কি করবে। হাজার হলেও তুমিই তোমার বাবাকে সবচেয়ে ভালো চেনো।”
যেদিন সে বাড়িতে যাবে সেদিন সন্ধ্যায় সে মনে মনে তার বাবার প্রতি বিরুদ্ধতা এড়াবার জন্য ভিন্ন পথের সন্ধান করতে লাগল, বিশেষ করে যখন তার বাবা বিয়ের বিষয়ে একরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে এবং ইতিমধ্যে তার জন্য মেয়েও ঠিক করে ফেলেছে। প্রথমে সে ভেবেছিল তার বাবার লেখা চিঠি সে ন্যানেকে দেখাবে কিন্তু পরবর্তীতে অন্তত এই মুহূর্তে না দেখানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বাড়ীতে পৌছে চিঠিটি সে আবার পড়ে এবং হাসি ধরে রাখতে পারেনা। তার মনে পড়ে উগোয়ে নামে একটি ডানপিটে মেয়ের কথা; সকল ছেলেদের যে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাতো, স্কুলের নিতান্ত একজন নির্বোধ ছেলে হিসেবে সেও বাদ যেতনা।
আমি তোমার জন্য একটি মেয়ে খুঁজে বের করেছি, যাকে তোমার সাথে খুব সুন্দর মানাবে- মেয়েটির নাম উগোয়ে। সে খ্রিস্টীয় আচার-আচরণে লালিত-পালিত হয়ে বেড়ে উঠেছে। কয়েকবছর পূর্বে সে লেখা-পড়া ছেড়ে দিলে তার বাবা(একজন সুবিবেচক মানুষ)তাকে একজন খ্রীস্টিয় যাজকের কাছে পাঠায়, সেখানে সে একজন ভালো বউ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করে। তার রবিবাসরীয় স্কুলের শিক্ষকের সাথে আমার কথা হয়েছে সে জানিয়েছে, সে খুব শুদ্ধ উচ্চারণে পবিত্র বাইবেল পড়তে পারে। আশা করি, তুমি যখন ডিসেম্বরে বাড়িতে আসবে তখন এ নিয়ে তোমার সাথে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
লাগস থেকে আসার দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় নাঈমেকে তার বাবার সাথে আমগাছের তলায় বসেছিল। এটাই হচ্ছে বৃদ্ধ মানুষটির নির্জন আশ্রয় যেখানে সে বসে বসে বাইবেল পড়ে যখন চৈত্র মাসের প্রখর সূর্‍্য মাথার উপরে জাজ্বল্যমান এবং তরতাজা সঞ্জীবনী হাওয়া গাছের পাতাগুলোকে ধীরে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।
“আব্বা,” নাঈমেকা কোন ধরনের ভণিতা না করেই হঠাৎ শুরু করে দেয়,“আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।”
ক্ষমা? কি জন্যে বাবা? সে বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করে।
“এটা আসলে বিয়ের প্রসঙ্গে”
“কোন বিয়ের প্রসঙ্গে?”
“আমি পারবো না- সত্যি করে বলছি বাবা- আমি আসলে বলতে চাচ্ছি যে নিওয়েকের মেয়েকে বিয়ে করা আমর পক্ষে অসম্ভব।”
“অসম্ভব? কেন অসম্ভব জানতে পারি কি?” তার বাবা জিজ্ঞেস করে।
“আমি তাকে ভালোবাসিনা, এ অবস্থায় বিয়ে করলে তাকে ঠকানো হবে”
“কেউ বলেনি যে তুমি তাকে ভালোবাস। ভালবাসার কি দরকার, কেন তাকে ভালোবাসতে যাবে?”
“বিয়ে আজকাল বদলে-----”
“শোন বাবা,” তার বাবা হঠাৎ মাঝখানে বাঁধা দিয়ে বলে, “কোন কিছুই বদলে যায় না। একজন তার বউয়ের মধ্যে যা খোঁজে তা হল- ভালো চরিত্র এবং ধর্মপরায়ণতা, এই দুটিগুন থাকলেই হল।”
নাঈমেকে আলোচনার বর্তমান সূত্রে তেমন কোন আশার আলো দেখতে পেলনা।
সে বলে উঠল, “তাছাড়া আমি একটা মেয়েকে কথা দিয়ে ফেলেছি, ওগোয়ের সকল ভালো গুনাবলী তার মধ্যে আছে এবং সে---------”
তার বাবা যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারেনা। “কি বললে তুমি?” ধীরে এবং বিব্রতভাবে জিজ্ঞেস করে।
“সে একজন ধর্মপরায়াণা খ্রীস্টান,” ছেলে তার বলা থামায় না, “এবং সে লাগস শহরের একটি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষকা।”
“তুমি কি বলতে চাইছো যে সে একজন শিক্ষিকা? তুমি যদি এটাকে একজন ভালো বউয়ের গুন হিসেবে বিবেচনা করে থাক তবে আমি তোমাকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাই যে, একজন খ্রিস্টান নারীর শিক্ষকতা করাই উচিত নয়। করিন্থিয়ানের প্রতি উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিতে সেন্ট পল বলেছিলেন, নারীদেরকে সকল বিষয়ে নীরব থাকাই উত্তম।” সে খুব ধীরে তার আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে পিছনে হাঁটাহাঁটি শুরু করে।
এটা ছিল তার জন্য হৃদয় তোলপাড় করে দেওয়ার মত একটা বিষয় এবং সে ঐ সমস্ত গীর্জা প্রধানদের ভীষণরকমভাবে দোষারোপ করতে শুরু করে যারা আজকাল নারীদেরকে তাদের স্কুলে পড়ানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করে। অনেকক্ষণ ধরে ধর্মকথা বলে ক্ষোভ কাটিয়ে উঠার পর অবশেষে মৃদু স্বরে তার ছেলের বিয়ের বিষয়ে কথা পাড়ে।
“যাই হোক, সে কোন বংশের মেয়ে?”
“তার নাম হচ্ছে ন্যানে আটাং”
কি? তার কন্ঠের সমস্ত কোমলতা হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, “কি বললে ন্যানেটাগা, এটার মানে কি?”
আরেকটু স্পষ্ট উচ্চারণে,“কালাবারের ন্যানে এটাং। এই মেয়ে বাদে অন্য কাউকে বিয়ে আমার পক্ষে মোটেও সম্ভব নয়।” সে এই কথাগুলো হঠকারীর মত বলে ফেলে একটা বিস্ফোরণের আশা করতে থাকে। কিন্তু কোন বিস্ফোরণ ঘটল না। তার বাবা পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে ঘরে ঢুকে গেল। এরকম আচরণ ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এবং এটা নাঈমেকে কে অনেকটাই বিমূঢ় করে ফেললো। বাবার এ ধরনের নীরবতা, প্রচন্ড রকম হুমকি ধামকির বন্যা বয়ে দেওয়ার চাইতেও তার কাছে অনেক বেশী বেদনাদায়ক মনে হয়। সেই রাত্রে বৃদ্ধ লোকটি কোন ধরনের অন্নগ্রহন করা থেকে নিজেকে বিরত রাখল।
সেদিন নাঈমেকের কাছ থেকে চলে যাওয়ার একদিন পর সে তাকে নানারকমভাবে বুঝিয়ে সুজিয়ে ঐ মেয়েটিকে বিয়ে করা থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করল। কিন্তু কোনভাবেই যুবকটিকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলানো গেল না এবং তার বাবা অবশেষে তাকে একেবারে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হল।
এটা তোমার প্রতি আমার দায়িত্ব, আমার কর্তব্য ছিল কোনটি সঠিক এবং কোনটি ভুল তা তোমাকে দেখিয়ে দেওয়া। যে লোক এই ধরনের মনোভাব তোমার মাথায় ঢুকিয়েছে, সাথে সাথে তোমার গলাটাও সে কেটে নিয়েছে। এটা শয়তানের কাজ। সে হাত নেড়ে ইশারায় তার ছেলেকে সেখান থেকে সরে যেতে বলে।
“বাবা, যখন আপনি ন্যানেকে ভালো করে জানবেন তখন তার প্রতি আপনার মন পরিবর্তিত হয়ে যাবে।”
“এই জীবনে তার মুখ আমি কোনদিন দর্শন করবো না, তা বলে রাখছি,” এরকমটাই ছিল তার বাবার উত্তর।
সেই রাত হতেই সে তার ছেলের জন্য প্রার্থনা করতে শুরু করে। যতকিছুই হোক সে আশা ছাড়েনি যে, একদিন তার ছেলে বুঝতে পারবে কি পরিমাণ ভয়াবহ বিপদের দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে। রাত্রি-দিনের প্রত্যেকটা মুহূর্ত সে তার ছেলের জন্য প্রার্থনা করতে থাকে।
তার নিজের দিক থেকে বলতে গেলে, পিতার দুঃখে নাঈমেকে বড়ই কাতর হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সে আশা ছাড়েনি যে- একদিন না একদিন তার বাবার এমন মনোভাব কেটে যাবেই। যদি তার মনে জাগত যে, আজ পর্যন্ত তার সম্প্রদায়ের কোন লোক এমন কোন মেয়েকে বিয়ে করেনি যে ভিন্ন ভাষায় কথা বলে, তাহলে তাকে সম্ভবত একটু কম আশাবাদী হতে দেখা যেত।
“এরকম ঘটনার কথা এর পূর্বে কখনো শোনা যায় নি,” কয়েক সপ্তাহ পরে একটা বৃদ্ধ লোকের ঘোষণা করা রায়টি ছিল এরকম। এই সংক্ষিপ্ত বাক্যটি সে তার সম্প্রদায়ের সকল লোকের সামনে তুলে ধরে। এই বৃদ্ধ লোকটি ছোট-খাট একটি জমায়েত সাথে নিয়ে ওকেকের কাছে সমবেদনা জানাতে আসল যখন তার ছেলের অপকর্মের কথা চতুর্দিকে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়েছে। ততদিনে অবশ্য তার ছেলে লাগসে ফিরে গেছে।
“এরকম ঘটনা পূর্বে কখনো ঘটতে দেখা যায় নি,” মাথা নাড়াতে নাড়াতে বৃদ্ধলোকটি পুনরায় ঘোষণা করে বসে।
“আমাদের পরমকরুনাময় ঈশ্বর কি বলেছেন খেয়াল নেই?” অন্য একটি লোক জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে লোক বলতে থাকে। “সন্তানেরা যে তাদের পিতাদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগবে- এটা পবিত্র গ্রন্থে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। ”
এর মধ্যে অন্য আরেকটি লোক বলে উঠে, “কলি যুগ আরম্ভ হয়ে গেছে।”
আলোচনা ধর্মতত্ত্বের দিকে মোড় নিলে, মাডুবোগু নামের একজন বাস্তববাদী মানুষ আলোচনাটিকে আবার সাধারণ পর্যায়ে নিয়ে আসে।
“আপনার ছেলের ব্যাপারে কবিরাজের সাথে শলা-পরামর্শ করার কথা ভেবেছেন কি?” সে নাঈমেকের বাবার কাছে জানতে চায়।
উত্তর আসে, “সে মোটেও অসুস্থ নয়।”
তাহলে তার হয়েছেটা কি, বলবেন একটু কষ্ট করে? অবশ্যই ছেলেটি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং একজন ভালো কবিরাজই তাকে কেবল সুস্থ চিন্তা-ভাবনায়-অনুভূতিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারে।
“আমালিলে নামক জরবুটি তার দরকার, একই জিনিস যা মহিলারা তাদের উড়নচন্ডী স্বামীকে ফিরিয়ে আনতে, হারানো ভালবাসা পুনরুদ্ধার করতে প্রতিনিয়ত ব্যাবহার করে থাকে।”
“মাডুবোগু ঠিক কথাই বলেছে, অন্য একজন লোক বলে উঠে। এই বিষয়ে জরবুটিই মোক্ষম অস্ত্র।”
“আমি কোন কবিরাজ ডাকবো না।” এধরনের বিষয়ে পাড়া-প্রতিবেশীদের কুসংস্কারপূর্ণ একগুয়ে মনোভাবের কথা নাঈমেকের বাবা খুব ভালো করেই জানে।
“আমি আরেকজন অচুবা হতে চাইনা। আমার ছেলে যদি নিজেই নিজের ক্ষতি ডেকে আনতে চায় আনুক। এক্ষেত্রে চাইলেও তাকে সাহায্য করা আমার আমার দ্বারা সম্ভব হবে না।”
মাডুবোগু বলে ফেলে, কিন্তু এটা নিশ্চয় ঐ মেয়েটির চক্রান্ত। বোঝা যায়, সে একজন গুনী কবিরাজের কাছে গিয়েছিল। সে আসলেই ভীষণ ধূর্ত একটি মেয়ে।
মাস ছয়েক পর, নাঈমেকে তার তরুণী ভার্যাকে বাবার কাছ থেকে পাওয়া একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি দেখায়ঃ
এটা আমাকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়েছে যে- তোমাদের বিয়ের ছবি পাঠানোর মত এমন বর্বর কাজ তোমার পক্ষে করা সম্ভব! আমি এগুলোকে অক্ষতই ফেরত পাঠাতাম। কিন্তু পরবর্তিতে সিদ্ধান্ত নেই, কেটে আলাদা করে শুধু তোমার বউয়ের ছবি ফেরত পাঠানোর; কারন তার সাথে আমার কোন ধরনের সম্পর্ক নেই, থাকতে পারেনা। এমনকি তোমার সাথেও যদি আমার কোন ধরনের সম্পর্ক না থাকতো তাহলে বোধ হয় বেঁচে যেতাম।
ন্যানে চিঠিটি পড়া শেষ করে যখন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া ছবিগুলোর দিকে তাকালো তখন তার চোখ অশ্রুতে ভরে উঠেছে এবং সে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল।
“তার স্বামী বলল, কেদোনা সোনা। সে এমনিতেই খুব ভালো, অনেক সুন্দর প্রকৃতির মানুষ এবং দেখে নিও একদিন সে আমাদের বিয়েটাকে মেনে নেবে।”
কিন্তু বছরের পর বছর গড়িয়ে গেল, সেই একদিন আর আসলো না। দীর্ঘ আটবছর ধরে ওকেকে তার ছেলে নাঈমেকের সাথে কোন ধরনের সম্পর্কই রাখেনি। শুধুমাত্র তিনবার(যখন নাঈমেকে কে বাড়িতে এসে ছুটি কাঁটাতে বলা হয়েছিল) তাকে চিঠি লেখা হয়েছে। একবার কোন এক প্রসঙ্গে সে বলেছিল, আমি তোমাকে আমার বাড়িতে থাকতে দিতে পারিনা। তুমি কোথায় কিভাবে তোমার ছুটি অথবা পুরো জীবন কাটাবে সে বিষয়ে আমার কোন ধরনের আগ্রহ নেই।
নাঈমেকের বিয়েকে কেন্দ্র করে যে কানাঘুষা শুরু হয়েছিল তা ছোট্ট গ্রামটির চৌহদ্দির মধ্যে আটকে থাকেনি। লাগস শহরে বিশেষ করে গ্রামের যারা সেখানে চাকরী করে তাদের মধ্যে এটা ভিন্ন রুপে দেখা দেয়। তাদের বউরা যখন গ্রাম সমন্ধীয় আলোচনায় একত্রিত হয়, সেখানে ন্যানেকে ভালো চোখে দেখা হয় নি। এমনকি তার দিকে এতই আলাদা রকমভাবে তাকানো হচ্ছিল যে, সে যেন তাদের মধ্যকার কেউ নয়, বাইরের লোক। কিন্তু সময়ের বয়ে চলার সাথে সাথে ন্যানে ধীরে ধীরে তার প্রতি তৈরী হওয়া বৈরী ভাবকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে তাদের সাথে বন্ধুত্ব তৈরী করতে শুরু করে। অনিচ্ছুক হওয়া সত্ত্বেও তারা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে যে সে অন্যদের চেয়ে অনেক ভালোভাবে তার সংসারকে আগলিয়ে রাখতে পেরেছে।
আইবো অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত তাদের ছোট গ্রামটিতে এই খবর ছড়িয়ে পড়ে যে নাঈমেকে এবং তার তরুণী ভার্যা অনেক সুখী একটা দম্পত্তি, সুখে শান্তিতে তাদের দিন কেটে যাচ্ছে। কিন্তু তার পিতা এমন কয়েকজনের মধ্যে একজন যারা এই খবরের বিন্দু-বিসর্গও জানতো না। কেউ তার ছেলের কথা তার সামনে উল্লেখ করলেই সে রাগান্বিত হয়ে উঠত। অনেক কষ্টে সে মন থেকে তার ছেলের আস্তিত্ব সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এই নিদারুন কষ্ট তাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল বলা চলে কিন্তু সে মাটি কামড়িয়ে পড়ে থাকে এবং ধীরে ধীরে বিজয় অর্জন করে।
পরবর্তীকালে সে তার ছেলের বউ ন্যানের কাছ থেকে একটি চিঠি পায়, নিজের ভেতরে এত রাগ-ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও একধরনের অনাগ্রহের সাথে সে চিঠির উপর চোখ বোলাতে শুরু করে যতক্ষন পর্যন্ত না হঠাৎ করে তার মুখের ভাব পরিবর্তন হয়ে যায় এবং সে অত্যাধিক মনযোগের সাথে তা পড়তে শুরু করে দেয়।
---আমাদের দুটিমাত্র ছেলে সন্তান যেদিন থেকে জানতে পেরেছে যে তাদের একজন দাদুভাই আছে সেদিন থেকেই তার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি শুরু করেছে। আমার পক্ষে তাদেরকে এটা বলা খুবই কষ্টসাধ্য যে আপনি তাদের সাথে দেখা করবেন না। আমি আপনার কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ জানাচ্ছি, একটিবার শুধু নাঈমেকে তার সামনের মাসের ছুটিতে তাদেরকে কয়েকদিনের জন্য আপনার কাছে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিন। আমি এখানে লাগস শহরেই পড়ে থাকবো---
তার নেয়া সেই কঠিন সিদ্ধান্তের কথা বৃদ্ধলোকটির সাথে সাথেই মনে পড়ে যায় যা সে বছরের পর বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে। সে নিজেকেই বোঝাচ্ছিল, সে অবশ্যই তাদেরকে এখানে বেড়াতে নিয়ে আসার অনুমতি দিবেনা। সে তার পাষাণ হৃদয়কে সকল ধরনের আবেগ অনুভূতি থেকে আড়াল করার চেষ্টা করে। পূর্বে ঘটে যাওয়া একটা যুদ্ধ তাকে যেন আবার পেয়ে বসেছে। সে একটি খোলা জানালার দিকে ঝুঁকে বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকায়। আকাশটি গভীর কালো মেঘে পুরোপুরি ছেয়ে গেছে এবং ততক্ষণে বাতাস বিশাল বেগে ধূলো এবং ঝড়াপাতাগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে চলতে শুরু করেছে। এটা হচ্ছে দুর্লভ কয়েকটি মুহূর্তের একটি যখন প্রকৃতি মানুষের ভেতরকার যুদ্ধে শরীক হয়। খুব শীঘ্র বৃষ্টি নামল, বছরের প্রথম বৃষ্টি। প্রথম থেকেই ঘন ঘন বিদ্যুৎ ঝলকানি এবং বজ্রপাত সাথে অনেক বড় বড় ফোটায় নেমে আসে যা ঋতু পরিবর্তনকে সূচিত করে। ওয়েকে তার নাতি দুটির দিক থেকে তার মনযোগকে ফিরিয়ে রাখতে যারপরনাই চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু সে জানে এমন একটা যুদ্ধ তাকে লড়তে হচ্ছে যেখানে তার জেতার আশা নেই বললেই চলে। সে প্রিয় একটি ঈশ্বরস্তোস্ত্র গুনগুন করে ভাজতে চেষ্টা করে কিন্তু বৃষ্টির বড় বড় ফোটা টিনের চালে পড়ে বারবার তার সুর তছনছ করে দিতে থাকে। তার হৃদয় যেন তৎক্ষণাৎ শিশুগুলোর দিকে ছুটে যেতে চায়। কিভাবে সে তাদের বিরুদ্ধে তার মনের দরজাকে বন্ধ করে রাখবে? এই ভয়ংকর ঝড়ো আবহাওয়ায়, ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে অদ্ভুত এক মানসিক উত্তেজনার বশে সে কল্পনায় তাদেরকে তার সামনে দুঃখভারাক্রান্ত ও উপেক্ষাকাতর মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
অনুশোচনার তাড়নায় পুরো রাত্রি সে এপাশ-ওপাশ করে কাটায় এবং এমন একটি ভয় তাকে পেয়ে বসে যে- তার নাতিদের সাথে দেখা হওয়ার আগেই সে সম্ভবত মারা যাবে।










৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×