আজ ২১ শে ফেব্রুয়ারি। মহান ভাষা দিবস। একজন বাঙালি হিসেবে গর্বের সাথে বলছি এটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। বাংলা-ই পৃথিবীর একমাত্র ভাষা যার জন্য মানুষ জীবন দিয়েছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলা ভাষা-ভাষীদের জন্য এই মহান স্বীকৃতি এনে দেয়। তারপর থেকে এই দিনটি বিশ্বের ১৮৮ টি দেশে শ্রদ্ধার সাথে পালিত হয়ে আসছে। এই ভাষার প্রতি সম্মান দেখিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০০৮ সালকে ‘আন্তর্জাতিক ভাষা-বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে।
ওই দিনটি ছিল ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এবং বাংলা ক্যালেন্ডারের ১৩৫৮ সালের ৮ই ফাল্গুন বৃহস্পতিবার। ভিনদেশি ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা করতে করতে আমরা বাংলা সন আর তরিখটির কথা প্রায় ভুলতেই বসেছি। ফেব্রুয়ারি আসলেই চারপাশে শুরু হয় ভাষা প্রেমীদের আনাগোনা। বড় বড় বোদ্ধারা যুক্তি-তর্ক দিয়ে বাংলার গুরুত্ব তুলে ধরেন। বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ, বিকৃতি ইত্যাদির চুলচেঁড়া বিশ্লেষণ করেন। আমি নিশ্চিত যে, আমার এই প্যানপ্যানানিও আপনি শুনতেন না যদি না এটা ভাষার মাস হতো। আমরা কি আসলেই ‘মৌসুমী-বাঙালি’...? বোধ হয় সত্য। আমি অনেকগুলো মানুষকে চিনি যাদের বিভিন্ন উৎসবে পরার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পোশাক রয়েছে। যা নির্দিষ্ট দিনটির সাথে মানানসই। তারা খুব জাঁকজমকের সাথে প্রতিটি উৎসবই পালন করে থাকেন।
নিজেদের সংস্কৃতি পালনের পাশাপাশি আমরা ভিন্ন দেশের সংস্কৃতিও পালন করে থাকি। তবে ধারণ করার জন্য নিজেদের চিরকালীন সংস্কৃতিটাকে ধারণ করাটাই বোধ হয় যুক্তিযুক্ত। তাহলে আর ভিন্ন সংস্কৃতি দেশীয় সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে যেতে পারবে না। এই ‘ছাপিয়ে যাওয়া’টাকেই বড্ড বেশি ভয় পাই। মানব সমাজ যেহেতু গতিশীল তাই সেখানে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তবে পরিবর্তনটা যেন নিজের সত্ত্বাকে মাড়িয়ে না হয়।
আমরা আরও কি আরও বেশি করে নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা করতে পারি না? অবশ্যই পারি। এ জন্য নিজেদের আর একটু বেশি সচেতনতা প্রয়োজন। চাইনিজরা নিজেদের ভাষাটাকে অনেক কষ্ট করে শিখে। একটা বাঙালি শিশু যেখানে দুই বছর বয়সেই পুরোপুরি কথা বলতে শিখে সেখানে চীনা শিশুর মাতৃভাষা শিখতে ৮-১০ বছর বয়স হয়ে যায়। সে দেশে বোধ হয় এ জন্যই ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষা সহজে দখল নিতে পারে না। কই, চীন তো কোন অংশেই আধুনিকতা থেকে পিছিয়ে নেই; বরং অনেক বেশি এগিয়ে।
একটি ছোট্ট বিষয় বলি। আমার খুব কাছের একটি বন্ধু আছে। বন্ধুটি মোটামুটি সাহিত্যপ্রেমী। যথাসম্ভব শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে চেষ্টা করে। আমরা একসাথে আড্ডায় বসলে একটা মজার খেলা খেলি; তা হলো আমরা যে কোনো একটা বিষয়ের উপর আলোচনা করবো। কথা বলার সময় খেয়াল রাখবো যেন কোন ইংরেজি শব্দ না বলা হয়। বললেই একটি শব্দের জন্য এক নম্বর গণনা করা হবে। তবে যে শব্দগুলোর প্রচলিত বাংলা শব্দ নেই, সেগুলোর ক্ষেত্রে ইংরেজি শব্দ বলা যাবে। আমরা এই খেলাটা দারুণ উপভোগ করি। কখনো কেউ কথা বলার সময় একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে যখন ‘স্যরি’ বলে তখন সবাই সজোরে হেসে উঠি। আমার সেই বন্ধুটি কিছুদিন আগে ফোনে পরিচিত একটি মেয়ের সাথে দেখা করে ও কিঞ্চিৎ প্রেমে পড়ে যায়। মেয়েটির সাথে তার অনেক কথা হয়। এক পর্যায়ে সে তাকে ভালো লাগার কথা জানায়। মেয়েটি তথাকথিত আধুনিকা। সে আমার বন্ধুটিকে জানায়- “তুমি কিছুটা ‘ব্যাক ডেটেড’ তোমাকে আরও আধুনিক হতে হবে। কথা বলার সময় ইংরেজি না বললে কেমন যেন ‘গাঁইয়া’ মনে হয়। চুলে ‘স্পাইক’ করতে হবে। সর্বোপরি আমার কথা মতো নিজেকে বদলাতে হবে। যদি তা পারো আমি তোমাকে ভালোবাসবো।“
বন্ধুটি বড় ব্যথিত হয়ে বিষয়টি আমাকে বলে-‘যে ভাষাটার চর্চার জন্য আমরা সাধনা করি তার জন্য আজকে অপমানিত হলাম’। আমি বললাম-বন্ধু তুমি ভুল দরজায় কড়া নেড়েছো। এই মেয়েটি তোমার জন্য নয়। তারপরও ভালো লাগা বলে কথা। ভেবে দেখো, কী করবে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম- হায় রে আধুনিকতা...!
আমরা চাইলেই সুন্দর বাংলায় কথা বলতে পারি। ভাষাটাকে ভালোবেসে যদি একটু সচেতন হই তবে কথা বলার সময় আর ‘বাংলিশ’ হবে না। এই যেমন- ‘থ্যাংক ইউ’ না বলে যদি বলি ‘ধন্যবাদ’ কিংবা ‘স্যরি’ না বলে ‘দু:খিত’ এভাবে প্রত্যেকটি কথা বাংলায় বলার চেষ্টা করলে একটা সময় আমরা সুন্দর নির্ভেজাল বাংলায় কথা বলতে পারবো। তাহলেই বোধ হয় এই ভাষাটির প্রতি আরো বেশি সম্মান দেখানো হবে। আশার কথা হলো-আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো এখন অনেক বেশি সচেতন। যদিও ‘এফএম’ রেডিও গুলো নিয়ে বিতর্ক আছে। তবুও সবাই এগিয়ে আসলে এই সমস্যাটি থাকবে না। ‘এবিসি’ রেডিও পরিপূর্ণ বাংলায় অনুষ্ঠান করার চেষ্টা করে। এতে তাদেঁর জনপ্রিয়তা মোটেও কমে যায়নি বরং বেড়েছে। সবারই উচিত এ ব্যাপারে আরও সচেতন হওয়া। আমরা নিজেদের উন্নয়নের জন্য বিদেশি ভাষা শিখবো, তবে তা জগাখিচুড়ি করে নয়।
যেদিন আমরা পুরোপুরি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারবো সেদিনই বোধ হয় ভাষা শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। আর তখনই আমরা বাঙালি হয়ে বাংলা ভাষার পূর্ণ মর্যাদা ও ভালোবাসা দিতে পারবো। নইলে যে ভাঙনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি তা বোধ হয় আরও বেশি করে অনুভূত হবে...।