somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বলছি - বাংলা চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নেয়া এক 'লক্ষ্মী' দেবীর গল্প !

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেই যখন থেকে হাটতে শিখেছিলাম তখন থেকে পরিবারের সাথে হলে সিনেমা দেখতে যেতাম। তখন হয়তো এতো কিছু বুঝতাম না। মাঝে মাঝে অন্ধকার হলে পর্দার ভিতরে থাকা মানুষগুলোর চিৎকার, মারামারি, কান্নার দৃশ্য দেখলে ঘাবড়ে যেতাম! নিজেও কান্না শুরু করে দিতাম। বয়স যখন ৪/৫ তখন আগের চেয়ে কিছুটা পরিপক্ক বলা যায়। তখন আর পর্দার ভিতরের মানুষগুলোর কর্মকাণ্ড দেখে ভয় পেতাম না, বরং মজা পেতাম। ওরা কাঁদলেও আমি হাসি! ওরা মারামারি করলেও হাসি! অর্থাৎ বোকার মতো কিছু না বুঝেই হাসি! সেই ৪/৫ বছর বয়সে হলে গেলাম । আব্বুর কোলে বসে ছবি দেখছি যা ছিল সম্পূর্ণ সাদাকালো। ছবির নাম 'অবুঝ মন'। নায়ক নায়িকা রাজ্জাক, শাবানা আর সুজাতা। ছবি তেমন কিছু বুঝি নাই, শুধু মনে আছে একটি সুন্দর মুখশ্রীর রমণী একজন যুবককে কে খুব মিষ্টি সুরের একটি গান শুনাচ্ছে যা ছিল " শুধু গান গেয়ে পরিচয়'' । সেই যুবকটি এক সময় অন্ধও হয় তখন সেই সুন্দর মুখশ্রীর সেই রমণীর কি কান্না যা আজও চোখে লেগে আছে। সেই থেকে সেই সুন্দর মুখের মানুষটি আমার শিশু মনে জায়গা করে নেয়। ছবির গল্প, পটভূমি কিছু মনে না থাকলেও সেই সুন্দর মুখটি ঠিকই মনে রয়ে গেলো আমার। অল্প আরেকটু বড় হয়ে সেই মানুষটির নাম জানতে পারলাম যার নাম '' শাবানা''। যে ''শাবানা'' নামক অভিনেত্রী আমার শিশুমন জয় করে নিয়েছিল উনি সেই সবার প্রিয় '' শাবানা''। যার নাম মনে আসলেই চোখে ভাসে স্নিগ্ধ সুন্দর নিষ্পাপ একটি মমতাময়ী মুখ। যে মুখটি আমাদের চিরসুন্দর বাঙ্গালী নারীর প্রতিচ্ছবি হয়ে চোখে ভাসে।

১৯৬৭ সালে পরিচালক এহতেশাম তাঁর উর্দু ছবি 'চকরি' ছবির জন্য একজন নায়িকা খুঁজছিলেন। এই এহতেশাম এর হাত ধরে এসেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রে শবনম যিনি সেই সময়ের একজন জনপ্রিয় নায়িকা। সেই এহতেশাম এবার যাকে পছন্দ করলেন তাঁর পারিবারিক নাম ছিল 'রত্না'। তিনি সেই রত্না নাম বদলে নাম দিলেন 'শাবানা' । সেই থেকে শুরু হলো বাংলা চলচ্চিত্রের এক 'লক্ষ্মী'দেবীর যুগ যা ছিল একটানা ৭০-৯০ দশক পর্যন্ত দুর্দান্ত প্রতাপে।সেই উর্দু 'চকরী' দিয়ে পাকিস্তানের আরেক জনপ্রিয় নায়ক নাদিম এর সাথে অভিনয় দিয়ে যার শুরু সেই ''শাবানা'' অতি দ্রুত হয়ে গেলেন সত্যি সত্যিই বাংলা চলচ্চিত্রের এক রত্ন। যার নিষ্ঠা, সততা ও অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা ছিল পুরোটা অভিনীত সময় জুড়েই সবার কাছে আলোচিত ও সব শিল্পীর জন্য এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। সেই সময়ে যখন রাজ্জাক- কবরী জুটি চরম জনপ্রিয় সেই সময়েই শাবানা সমহিমায় নিজেকে চেনালেন যে তিনি কারো সাথে একক জুটির জন্য জনপ্রিয় হতে আসেননি, তিনি নিজের যোগ্যতা দিয়েই এই চলচ্চিত্র শিল্পে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। সেই ক্ষেত্রে শাবানা পুরোপুরি সফল। ৮অ দশকের শেষ দিকে যখন তাঁর সময়কার সব অভিনেত্রী নায়িকা / মূল চরিত্রে বেমানান সেই সময় তো বটেই ৯০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত শাবানা সেখানে নায়িকা/ মূল চরিত্রে দাপটের সাথে অভিনয় করে গেছেন। একটানা তিন দশক দাপটের সাথে অভিনয় করে যেতে আজ পর্যন্ত শাবানা ছাড়া অন্য কোন অভিনেত্রী পারেনি হয়তো আগামীতেও পারবেনা। সেই শিশুকালে যেদিন থেকে হলে ছবি দেখা বুঝেছি সেদিন থেকেই দেখেছি শাবানা নামটি মানুষের কাছে কত প্রিয় ছিল! যিনি দর্শককে ইচ্ছে মতো যখন খুশি কাঁদাতে পারতো ,যখন খুশি হাসাতে পারতো।তিনি শুধু রাজ্জাক নয়, রহমান, আলমগীর, সোহেল রানা, জসীম, খসরু, উজ্জ্বল এর সাথেও ছিলেন চরম সফল এক অভিনেত্রী। আবার কখনও কখনও শাবানা কে দেখার জন্যই হলে দর্শকের ঢল নামতো। শাবানা মানেই বাংলার একটি চিরচেনা রমণীর রূপ। এমন সময় গেছে যেখানে নায়ক কে সেইটা দর্শকের জানার বিষয় নয় ছবিতে শাবানা আছেন ঐ ছবি তাদের দেখতেই হবে। এমনই এক ইমেজ তিনি গড়ে ছিলেন যা আজও কোন অভিনেত্রী পারেনি। বিশেষ করে আলমগীর -শাবানা জুটি ছিল গ্রামবাংলার, নগরে সবার কাছে সামাজিক ও পারিবারিক ছবির জনপ্রিয় জুটি। যে জুটির ১০০ টির মতো ছবি আছে যার বেশির ভাগই ব্যবসাসফল। আর জসীম -শাবানা ও সোহেল রানা - শাবানা জুটি মানে জমজমাট সামাজিক অ্যাকশন ছবির জনপ্রিয় জুটি। শাবানা অভিনীত ছবির সংখ্যা প্রায় ৪০০ টির মতো যার মধ্য উল্লেখযোগ্য হলো- চকরী, অনুভব, নূপুর, মধু মিলন,সোহাগ, পুত্রবধূ, অনন্ত প্রেম, অবুঝ মন, ছুটির ঘণ্টা,দুই পয়সার আলতা, ভাত দে, ব্যবধান , দেশ বিদেশ ,রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, চাঁপা ডাঙ্গার বউ, সারেন্ডার, বিজয়,অশান্তি, অন্ধ বিশ্বাস, রাঙ্গাভাবী, লালু মাস্তান, সত্য মিথ্যা, স্ত্রীর স্বপ্ন, অপেক্ষা, স্বাক্ষর, উসিলা,মরণের পরে, সান্ত্বনা, অবুঝ সন্তান, পিতা মাতা সন্তান,বাংলার বধূ, গৃহযুদ্ধ, মাস্তান রাজা, কালিয়া, টপ রংবাজ,শত্রু ভয়ঙ্কর, শাসন, জজ ব্যারিস্টারঅজান্তে, দুঃসাহস,ঘাতক, সংসারের সুখ দুঃখ, বাংলার মা, স্নেহ, বিদ্রোহী কন্যা, বিদ্রোহী বধূ, দুর্জয়, সত্যর মৃত্যু নেই, স্বামী কেন আসামী, বাংলার নায়ক এর মতো অসংখ্য ব্যবসা সফল ছবি আমাদের উপহার দিয়েছিলেন। এসব ছবিতে কখনও গরীব দুখী এক নারী, কখনও শহরের আধুনিক মেয়ে, কখনও স্বামী ভক্ত বাংলার চিরচেনা স্ত্রী, কখনও ভাবী, কখনও মা, কখনও এক প্রতিবাদী নারী এমন সব চরিত্রে অভিনয় করে পুরোটা সময় দর্শকদের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতেন। শাবানার শেষ পরিণতি না দেখা পর্যন্ত বাংলার মহিলা দর্শকরা সহ পুরুষ দর্শকরাও হলের আসন ছেড়ে উঠতে চাইতেন না। এমনই এক দুর্দান্ত অভিনেত্রী ছিলেন যিনি সব অভিনেত্রীর মাঝে সবচেয়ে বেশী পুরস্কৃত হয়েছেন।


তিনি শুধু একজন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রীই ছিলেন না, ছিলেন একজন খুবই ব্যবসা সফল প্রযোজক। স্বামী ও প্রযোজক ওয়াহিদ সাদিক কে নিয়ে গড়ে তুলেন 'এস এস প্রোডাকশনস'। যা বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা প্রযোজনা সংস্থা হিসেবে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। এস এস প্রোডাকশনস এর উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হলো - অশান্তি, বিজয়, অন্ধ বিশ্বাস, রাঙাভাবী, অচেনা, লক্ষ্মীর সংসার, ঘাত প্রতিঘাত, স্বামী কেন আসামী এর মত আরও অনেক ব্যবসাসফল ও পুরস্কারপ্রাপ্ত ছায়াছবি। যিনি নিজের অভিনয় ও প্রযোজিত দুর্দান্ত সব ছবি দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে করেছেন অনেক সমৃদ্ধ। আজ তিনি বহুদূরে সেই আমেরিকায় সপরিবারে বসবাস করছেন তবুও বাংলার কোটি মানুষ তাঁকে আজও ভুলতে পারেনি। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখবেন যে যেদিন থেকে শাবানা অভিনীত ও প্রযোজিত ছবি মুক্তিপাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে সেদিন থেকেই বাংলা চলচ্চিত্র ধীরে ধীরে তাঁর জৌলুস হারিয়ে ধ্বংসের পথে পা বাড়িয়েছে। সেজন্য শাবানা কে বলা যায় বাংলা চলচ্চিত্রের এক 'লক্ষ্মী' দেবী।আজও সেই 'লক্ষ্মী'দেবীর স্থান কেউ দখল করতে পারেনি যার জন্য হয়তো আজও আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প পতনের মুখ থেকে উদ্ধার হয়নি। আজ মুখ থুবড়ে পড়া আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পে তাঁর মতো একজন ''লক্ষ্মী'' দেবীর খুব খুব বেশী প্রয়োজন।





























এমন আরও অনেক অনেক সেরা কিছু পেতে চাইলে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে বাংলার সেরা আর্কাইভে সাবস্ক্রাইব করুন

একটি শিক্ষিত রেডিও
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ দুপুর ১২:১৮
১৬টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×