ক্ষমা চেয়েই বলতে হয় যে, মৃত্যু সংবাদটি পাওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি রুনি-সাগর দম্পতিকে চিনতাম না। এটা হয়তো বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের ব্যাপকতা এবং আমার অজ্ঞতা এ দুয়ের সমন্বয়ের কারণে হয়ে থাকতে পারে। তবে এমন নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক হত্যাকান্ডে দেশের বাকি স্বাভাবিক মানুষগুলোর মতো আমিও ব্যথিত হয়েছি। বিশেষ করে তাদের একমাত্র শিশুসন্তানের কান্না আমাকে আবেগে জর্জরিত করেছে। এই বত্রিশ বছর বয়সেও বাবা-মার ব্যবহারিক ও মানসিক আশ্রয় আর সাহায্য ছাড়া একদিনও চলার সামর্থ্য রাখিনা। আমি জানিনা এই ছোট্ট শিশুটি তার অনাগত দিনগুলো বাবা-মায়ের স্নেহ ব্যতিত কিভাবে পার করবে। পত্রিকায় দেখেছি মাননীয় নেত্রী এই অবুঝ শিশুটির দায়িত্ব স্বয়ং নিয়েছেন। বিষয়টি প্রশংসনীয়। তবে ধ্রুব সত্য হচ্ছে এই যে, সরকার প্রধানতো দূরের কথা, কল্পিত সেই সর্বশক্তিমানও মা-বাবার বিকল্প নন। ধর্মবিশ্বাসে আমি নাস্তিক। তবে চলমান পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা এবং নির্দয়তা দেখে প্রতিমুহুর্তে এক অসীম শক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। সত্যিই একজন অসীম ক্ষমতার কেউ থাকলে পৃথিবীটাতে হয়তো কিছুটা ন্যায়বিচার থাকত।
দেশের সকল স্তর থেকে এ নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করা হয়। সহকর্মী হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই সাংবাদিক সমাজ ছিল এ দাবিতে সবচেয়ে সরব। গণমাধ্যমে পাশাপাশি রাজপথেও এ দাবিতে তাঁরা সরব হয়েছেন। তবে মৃত্যুর দু'দিন পার না হতেই আমরা একই সাংবাদিক মহলের কাছ থেকে বিপরীতধর্মী কিছু কদর্য্য আচরণেরও দেখা পাচ্ছি। খুনের রিপোর্ট করতে গিয়ে বা খুনী চিহ্নিত করতে যেয়ে তাঁরা নিহত দম্পতির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এমন সব তথ্য উপস্থাপন করছেন যা সত্যিই কষ্টের। বরাবরের মতোই এ সংবাদগুলোর উৎস তথাকথিত "বিশেষ সূত্র"। এই "বিশেষ সূত্র"টা আসলে কি তা আমজনতা জানতে পারেনা, জানবেও না। কিন্তু "বিশেষ সূত্র" হতে প্রাপ্ত এ খবর যে, শোক মুহ্যমান নিহত মানুষ দু'জনের নিকটজনের জন্য কতোটা বিব্রতকর তা কি ঐ তথাকথিত রিপোর্টাররা বুঝেন? অবশ্যই বুঝেন। তবে এক্ষেত্রে এ উপলব্ধির চেয়েও তাদের কাছে মুখ্য হচ্ছে মুখরোচক সংবাদ ছাপিয়ে পত্রিকার কাটতি বাড়ানো।
পক্ষীকুলের মধ্যে কাক অন্যতম নীচু প্রকৃতির বলে চিহ্নিত। পঁচা আবর্জনা ও মৃত জন্তুর উচ্ছিষ্টই এর প্রধান খাদ্য। যতই ইতর হোক না কেন সমাজে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে যে, কাক কাকের মাংস খায়না। বরং একটি কাক বিপদে পড়লে মুহুর্তেই সেখান শত শত কাক হাজির হয়। এদের স্বজাত্যবোধ তাই প্রবাদতুল্য। কাকের মতো ইতর প্রাণী নিজের মৃত স্বজাতির মাংস না খেলেও আমাদের মনুষ্যকুলের মধ্যে সভ্য বলে পরিচিত সাংবাদিক সমাজ ঠিকই একে অপরের মাংস খায়। এক্ষেত্রে রুনি-সাগর দম্পতির প্রতি বিশেষ সাংবাদিক মহলের আচরণ ব্যতিক্রমধর্মী কোন ঘটনা নয়। প্রতিনিয়নতই তাঁরা একে অপরের বিষেদগারে মত্ত। কাটতি বিবেচনায় প্রথম আলো দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠিত একটি পত্রিকা। বিদগ্ধ সংবাদকর্মী জনাব মতিউর রহমান এর সম্পাদক। অপরদিকে কালের কন্ঠ তুলনামুলক নতুন হলেওে এখানে আবেদ খান এবং ইমদাদুল হক মিলনের মতো বিদগ্ধজনেরা সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। এতো বিদগ্ধ এবং জ্ঞানী মানুষের সমারোহ থাকা স্বত্তেও পত্রিকা দুটোর প্রধান কাজ হচ্ছে তাঁদের কর্পোরেট মালিকদের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করা। আর তল্পিবাহকের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তাঁরা একে অপরের বিরুদ্ধে সদা বিষেদগারে মত্ত। একে অপরের কুৎসা রটনা তাঁদের কাছে জাতীয় ইস্যুর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। সার্বিক বিবেচনায় পত্রিকা দু’টির সংবাদকর্মীদের আচরণ সাংবাদিকের মতো নয়, বরং কোন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের একান্ত অনুগত কর্মচারীর মতো।
সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়ে থাকে। এ স্তম্ভের কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রের অন্য তিনটি স্তম্ভ তথা নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ত্রুটিসমুহ দুর করে রাষ্ট্রে সংহতি আনয়ন। সংহতি আনয়নকারী স্তম্ভ অর্থাৎ সংবাদপত্র এবং এর সাথে সংশ্লিষ্টদের যখন এমন নড়বড়ে অবস্থা তখন দেশের বাকি স্তম্ভগুলোর যে কি দশা তা সহজেই অনুমেয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৩:২২