খাদ্য অধিদপ্তরের সহকারী উপখাদ্য পরিদর্শক এবং নিম্নমান সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদের লিখিত পরীক্ষা বাতিল হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার পর জাতীয় স্বার্থে এ পরীক্ষা বাতিলের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। সরকার তদন্ত কমিটির এ সুপারিশ আমলে নিয়ে নতুন করে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে কার কাছ থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে তা খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছে তদন্ত কমিটি। কমিটি পুনরায় তদন্তের মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
দেশের ২১টি জেলায় খাদ্য অধিদপ্তরের সহকারী উপখাদ্য পরিদর্শক এবং নিম্নমান সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় গত ২৭ জানুয়ারি। সহকারী উপখাদ্য পরিদর্শকের ৪২৮টি পদের বিপরীতে দুই লাখ ১৮ হাজার এবং নিম্নমান সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিকের ৫০৩টি পদের বিপরীতে ৩০ হাজার প্রার্থী পরীক্ষায় অংশ নেন। দেশের একাধিক জায়গায় এ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হলে তোলপাড় শুরু হয়। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সব সময় বিজি প্রেসে ছাপানো হলেও খাদ্য অধিদপ্তরের ওই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপানো হয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রেসে।
এ অবস্থায় খাদ্য মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরে সময় আরো সাত দিন বাড়িয়ে নেয় কমিটি। গতকাল রবিবার কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তিন সদস্যের ওই কমিটির প্রধান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুল আউয়াল হাওলাদার গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা খাদ্য বিভাগের সচিবের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। এ বিষয়ে কোনো কিছু জানতে হলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত।'
খাদ্য বিভাগের সচিব বিডি মিত্র গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'তদন্ত প্রতিবেদন পেয়েছি। আমি এখনো পড়তে পারিনি। তাই কোনো মন্তব্য করতে পারছি না।'
তদন্ত কমিটি ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে নেওয়া পরীক্ষা সম্পূর্ণ বাতিলসহ ছয় দফা সুপারিশ করে। কমিটি ভবিষ্যতে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য প্রশ্নপত্র মুদ্রণ কাজ নিরাপদ ও পূর্ব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো সংস্থাকে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। প্রশ্নপত্র মুদ্রণ, বাঁধাই ও প্যাকিং সংক্রান্ত কাজ মূল কমিটির হলেও তারা কেউ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। ভবিষ্যতে এসব কাজের সঙ্গে মূল কমিটির সম্পৃক্ততা থাকা বাধ্যতামূলক বলে তদন্ত কমিটি মনে করে। নিয়োগ প্রত্যাশী সংস্থার কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মুদ্রণ, প্যাকিং ও বাঁধাই কাজে সম্পৃক্ত না করার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে দু-একজন ঊর্ধ্বতন নির্ভরযোগ্য কর্মকর্তাকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রে তাঁদের দায়িত্ব বণ্টন সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো গর্হিত অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করার জন্য যথাযথ তদন্তের কথা বলেছে কমিটি।
সুপারিশ ছাড়াও তদন্ত কমিটি সাত দফা অভিমত পেশ করেছে। এসব অভিমতের মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সত্যতা পাওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষক ও কর্মকর্তারা জড়িত ছিলেন। এসব শিক্ষক ও কর্মকর্তা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত কি না সে বিষয়ে তদন্ত কমিটি নিশ্চিত হতে পারেনি। প্রশ্নপত্র মুদ্রণ, প্যাকিং এবং বিতরণ কাজে খাদ্য অধিদপ্তরের ১১ জন কর্মকর্তা এবং ইসলামী ফাউন্ডেশনের ৩৫ জনসহ মোট ৪৬ জন জড়িত ছিলেন। এত বেশিসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশ্নপত্র মুদ্রণ কাজের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাদের মধ্যে কেউ এ ফাঁসের সঙ্গে জড়িত কি না তাও নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি কমিটি। তদন্ত কমিটি তাদের অভিমতে আরো জানিয়েছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রেসের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। প্রশ্নপত্র মুদ্রণের মতো গোপনীয় কাজের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রেসকে বেছে নেওয়া যৌক্তিক মনে করে না কমিটি। সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যেসব ব্যবস্থা আবশ্যিকভাবে অনুসরণ করা হয় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রেসে সেসব ব্যবস্থা নেই। প্রেসে প্রশ্নপত্র মুদ্রণ, বাধাই ও প্যাকিং কাজ গোপনীয়তার সঙ্গে করার জন্য খাদ্য অধিদপ্তর নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সমর্থ হয়নি বলেও তদন্ত কমিটি জানিয়েছে।
তদন্ত কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস, আইবিএর পরিচালকের কার্যালয়, শাহবাগ থানা, খাদ্য অধিদপ্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, কুড়িগ্রাম জেলার ডিসি অফিস, পুলিশ সুপারের অফিস ও কয়েকটি থানা সরেজমিন পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্টদের সাক্ষ্য নেয়। তদন্ত কমিটির কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. এ এম আমজাদ জানান, ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র (সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত) তাঁকে ফোন করে জানায় জহুরুল হক হলের ২৪২ নম্বর রুম থেকে খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও তার উত্তর বিভিন্ন ঠিকানায় ই-মেইল করা হচ্ছে। তিনি তখন হল প্রভোস্টকে ফোন করেন। প্রভোস্টের অনুমতি নিয়ে হাউস টিউটর এস এম রেজাউল করীমকে সঙ্গে নিয়ে জহুরুল হক হলে যান প্রক্টর। সেখানে গিয়ে দেখেন ২৪২ নম্বর রুমটি তালাবদ্ধ। পাশের রুম ২৪১ থেকে জানানো হয় কিছুক্ষণ আগে রুম বন্ধ করে নির্দিষ্ট ছাত্র হলের বাইরে গেছে। তাদের সন্ধানে প্রক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে যান। রাত ১টায় বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার তাঁকে ফোনে জানান, জসীম উদ্দীন হলের দ্বিতীয় তলায় দুজন লোক প্রশ্নপত্র বিক্রি করছে। সেখানে গিয়ে প্রক্টর তাদের হাতেনাতে ধরে ফেলেন। তাদের মধ্যে একজনের নাম মেজবাহউদ্দিন। তিনি দর্শন বিভাগের ২০০৩-০৪ বর্ষের ছাত্র বলে জানান। অন্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয় দিলেও তারা ভুয়া ছাত্র বলে পরে জানা গেছে। তাদের আইডি কার্ড, মোবাইল ফোন জব্দ করেন প্রক্টর। পরে উপাচার্যের নির্দেশে রাত আড়াইটায় তাদের শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়।
মূল খবর::
Click Here