somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'ভালবাসায় শরীর না মন?' : সাপ্তাহিক ২০০০ - ভ্যালেন্টাইন সংখ্যা ২০১২

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘আপনি কখনো কাউকে ভালবেসেছেন বা প্রেমে পড়েছেন?’ মাঝ বয়সের কোনো ব্যক্তিকে ফেলে আসা জীবনে চোখ বুলিয়ে আপনার প্রশ্নটির জবাব দিতে বলুন তো। নিজের প্রতি সৎ থেকে সত্য কথাটা স্বীকার করেন যদি, এমন কাউকে বোধকরি খুঁজে পাওয়া যাবে না যার উত্তর না বোধক হবে। কিন্তু তাকেই যদি আবার প্রশ্ন করেন ‘আচ্ছা, বলুন তো, ভালবাসা কাকে বলে? প্রেমের সংজ্ঞা কী?’ দেখবেন, বলতে গিয়ে কেমন আটকে যাচ্ছেন তিনি। আসলে তার দোষ-ই বা দেবেন কেমন করে? প্রেম বা ভালবাসার সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা তো এখনো দিতে পারেননি কেউ না কোনো সাহিত্যিক, কোনো দার্শনিক বা মনস্তাত্তিক। প্রেম আর ভালবাসা একই বিষয় কি না তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। ইংলিশ-বাংলা ডিকশনারিতে ‘লাভ’ (LOVE)-এর অর্থ হিসেবে প্রেম ও ভালবাসা দুটোই লেখা থাকলেও, বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ‘প্রেম’-এর অর্থ বা সমার্থক শব্দ হিসেবে ভালবাসা এবং উল্টোভাবে ‘ভালবাসা’র ক্ষেত্রে প্রেম লেখা থাকলেও অনেকের কাছেই ‘ভালবাসা প্রেম নয়’। এক্ষেত্রে অবশ্যই নর-নারীর মধ্যকার প্রেম-ভালবাসা বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অনুভূতির কথাই বলা হচ্ছে, বাবা-মা-ভাই-বোন বা বন্ধুর প্রতি অনুভূতিকে এখানে ‘লাভ’ অর্থে বোঝানো হয়নি।

প্রেম বা ভালবাসার অর্থ বোধে আমজনতা দুভাগে বিভক্ত। এক দলের কাছে ভালবাসা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শরীরপ্রধান একটি অনুভূতি। শরীরের উপস্থিতি ছাড়া ভালবাসার অস্তিত্ব তাদের কাছে অকল্পনীয়। তারা ভালবাসার ফ্রয়েডীয় তত্তের অনুসারী। বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান নিউরোসায়েন্টিস্ট সিগমুন্ড ফ্রয়েড-ও তার মতাদর্শী মনস্তাত্তিকদের মধ্যে সব প্রেমের উৎস শরীরী আকর্ষণ- যৌনতা। এমনকি পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের ভালবাসাও কাম-উৎসারিত বলেই তাদের ধারণা। কালের প্রবাহে এই থিউরি বিতর্কিত এবং এর বিপক্ষে শক্ত যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনো এই মতবাদের প্রভাব কম নয়। এখনো অনেকের কাছে প্রেম মানেই শরীর বা যৌনতা।

বিপরীত মতাদর্শীদের কাছে প্রেম শাশ্বত, চিরন্তন, স্বর্গীয় এক অনুভূতি। সেখানে শরীরের কোনো স্থান নেই। পরস্পরের প্রতি মানসিক আকর্ষণই সেখানে প্রেম বা ভালবাসার ভিত্তি এবং স্থায়িত্বের নিয়ামক। তাদের মতে, যতক্ষণ অনুভূতিটা মনের ততক্ষণই তা ভালবাসা। এতে শরীর ঢুকে গেলে তা আর তাদের কাছে ভালবাসা নয়Ñ কেবলই যৌনতা, কাম। তাদের ধারণায়, মানসিক আকর্ষণ প্রবল হলেই কেবল প্রেম টিকে থাকে। এদের কাছে ভালবাসা ব্যাপারটি ‘প্লেটোনিক’। বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো যদিও মোটা দাগে প্রেমের কোনো তত্ত¡ উপস্থাপন করেননি, তবে তার দর্শনের একাংশে এমন এক ধরনের প্রেমের ধারণা দেয়া হয়েছে, যা ইন্দ্রিয়াতীত এক চিরš—ন সৌন্দর্যের ধারক।

কেউ আবার দেহজ আকর্ষণ-প্রধান অনুভূতিকে ‘প্রেম’ বলে আখ্যায়িত করেন, মানসিকটি ‘ভালবাসা’। আবার কেউবা বলেনÑ নর-নারীর পারস্পরিক ভালবাসা বা প্রেমে শরীর বা যৌনতা আসতে পারে।

এই বিতর্ক চিরকালীন। মনীষী-বিজ্ঞানী-গবেষকরাও এখনো একমত হতে পারেননি, আসলে প্রেম বা ভালবাসা শরীরপ্রধান নাকি মনপ্রধান।

প্রেমের ধরন নিয়ে গ্রহণযোগ্য একটি মতবাদ দিয়েছেন কানাডার প্রখ্যাত মনস্তত্তবিদ জন অ্যালান লি। তার তত্তের নাম- ‘কালারস অব লাভ’ (ভালবাসার রং!)। রঙের মতবাদের সঙ্গে মিল রেখে এই তত্তের নাম দেয়া হয়েছে। মূল রং তিনটি লাল, সবুজ, নীল। বাকি সব রং এই তিন রঙের ভিন্ন ভিন্ন মিশ্রণের ফল। একই রকমভাবে লির তত্¡ মতে, প্রেমের ধরন প্রধানত তিনটি-ইরোস (Eros), লুডোস (Ludos), এবং স্টর্জ (Storge)। ইরোসে মনের চেয়ে শরীর-সৌন্দর্য প্রভাব বিস্তার করে বেশি। এতে কামনা বা উপভোগই প্রধান এবং তাৎক্ষণিক আবেগ বেশি। লুডোস ঘরানার প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রেমকে খেলা হিসেবে গ্রহণ করে। সম্পর্কের ব্যাপারে এরা মোটেও বিশ্বস্ত ও আন্তরিক নয়। একসঙ্গে একাধিক প্রেম চালিয়ে যেতে এরা দ্বিধাহীন। স্টর্জ ধরনের প্রেম হয় দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের, ভালো লাগার, মানসিক বোঝাপড়ার পরিণতিতে। এই ধরনের প্রেমে যৌনতার চেয়ে বিশ্বাস, নির্ভরতা ও মানসিক আকর্ষণ বেশি। এই তিন প্রধান ধরনের প্রেমের সংমিশ্রণে আরো তিন ধরনের প্রেমের দেখা মেলে। ইরোস আর লুডোসের সংমিশ্রণে ম্যানিয়া (Mania)- যাকে বলা যায় ‘পাগলের মতো ভালবাসা’। এতে আবেগ খুবই তীব্র থাকে, প্রিয়জনের সান্নিধ্য ছাড়া পৃথিবীর সব কিছুই অর্থহীন মনে হয়। লুডোস আর স্টর্জের সমস্তিত রূপ প্রাগমার (Pragma)-এর অনুসারী প্রেমিক-প্রেমিকারা বাস্তববাদী। এরা আগে থেকেই জীবনসঙ্গীর মাঝে যেসব বৈশিষ্ট্য দেখতে চায় তার তালিকা করে রাখে এবং সে অনুযায়ী সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। সর্বশেষ ধরনটি হচ্ছে অ্যাগাপি (Agape)। এতে ইরোস আর স্টর্জ উভয় ধারার বৈশিষ্ট্যের সমš^য় ঘটে। অ্যাগাপি হচ্ছে নিঃ স্বার্থ প্রেম। এতে প্রতিদানের আশা না করে প্রেমিক বা প্রেমিকা তার প্রিয়জনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে।

ভালবাসার আরেকটি গ্রহণযোগ্য মতবাদ দিয়েছেন আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী রবার্ট জেফ্রি স্টার্নবার্গ। তার মতবাদ ‘ভালবাসার ত্রিভুজ তত্ত¡’ হিসেবেই পরিচিত। তার মতে, ত্রিভুজের তিন বাহুর মতো ভালবাসারও তিনটি ভিন্ন উপাদান Intimacy বা অন্তরঙ্গতা, Passion বা কামোচ্ছাস এবং Commitment বা প্রতিশ্রুতি। অন্তরঙ্গতা বলতে বোঝায় পরস্পরের প্রতি নৈকট্যের অনুভব। প্যাশন হচ্ছে কাম, জৈবিক আকর্ষণ বা যৌন আকাক্সক্ষা। আর দীর্ঘস্থায়িত্ব ও পারস্পরিক নির্ভরতায় ভবিষ্যতের পরিকল্পনাই হচ্ছে কমিটমেন্ট। ভালবাসার এই তিনটি উপাদানের উপস্থিতি-অনুপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে ভালবাসা বা প্রেমকে সাতটি ভাগ করেছেন স্টার্নবার্গ। এর মধ্যে যেমন রয়েছে শুধু যৌনতানির্ভর ভালবাসা বা Infatuated Love, রয়েছে Companionate Love - দীর্ঘস্থায়ী বিবাহিত জীবনে এ ধরনের ভালবাসা দেখা যেতে পারে, যেখানে যৌনতা মুখ্য নয়, কিন্তু অন্তরঙ্গতা আর প্রতিশ্রুতির সমš^য়ে ভালবাসা বিরাজমান। অন্তরঙ্গতা আর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে যদি যৌনতাও বিদ্যমান থাকে তখন একে বলা হয় Consummate Love. একজন প্রেমিক বা প্রেমিকা তার জীবনে প্রেমের এই সাতটি ধরনই উপভোগ করতে পারেন, একই মানুষের প্রতি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন রীতির প্রেম অনুভব করতে পারেন। আবার সব ধরন একই ব্যক্তির জীবনে বা একই প্রেমেরক্ষেত্রে নাও ঘটতে পারে।

আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী হেলেন ফিশার প্রেম-ভালবাসাকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন- Lust, Attraction, Attachment. Lust হচ্ছে যৌনতার সমার্থক। Attachment হচ্ছে রোমান্টিক ভালবাসা যাতে আবেগ প্রাধান্য পায়। Attachment হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের জন্য প্রয়োজনীয় গভীর অনুভ‚তি। ফিশারের মতেও, প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক এই তিনটি ধরনের যে কোনো একটি দিয়ে শুরু হতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে তা অন্য ধরনে পরিবর্তিতও হতে পারে। আবার একই সঙ্গে তিনটি ধরনই উপস্থিত থাকতে পারে।

প্রেম শরীরসর্বস্ব নাকি মনসর্বস্ব এই বিতর্কের এখনো পর্যন্ত কোনো সমাধান মেলেনি। মনস্তাত্তিক, দার্শনিক, সমাজবিদরা ভালবাসার যেসব মতবাদ দিয়েছেন বা দিচ্ছেন সেগুলোও যে সর্বজনগ্রাহ্য বা বিতর্কের ঊর্ধ্বে তাও নয়। তবে এসব মতবাদের কথা ভেবে ভেবে কে কবে প্রেম করেছে, প্রেমে পড়েছে? ‘ভালবাসা কারে কয়?’ সার্বজনীন এই প্রশ্নকে এক পাশে ঠেলে রেখেই যুগে যুগে প্রেমের আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে কপোত-কপোতীরা।

.............................................................................
Click This Link
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভুল শুধু ভুল নয়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৬

এক
লেখাটা একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি। ১৯৯৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে শফিপুর আনসার একাডেমিতে বিদ্রোহ হয়। ৪ ডিসেম্বর পুলিশ একাডেমিতে অভিযান চালায়। এতে চারজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছিল। এটি ছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। VF 3 Mini: মাত্র 60 মিনিটে 27 হাজার বুকিং!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:০৪



আমার ব্যাক্তিগত গাড়ি নেই কিন্তু কর্মসূত্রে বেঞ্জ , ক্যাডিলাক ইত্যাদি ব্যাবহার করার সুযোগ পেয়েছি । তাতেই আমার সুখ । আজ এই গাড়িটির ছবি দেখেই ভাল লাগলো তাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ময়লাপোতার কমলালেবুর কেচ্ছা!! (রম্য)

লিখেছেন শেরজা তপন, ২১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩


বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাময়িক পোস্ট: বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন

লিখেছেন করুণাধারা, ২১ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন! view this link

সামহোয়্যারইনব্লগ থেকে কয়েকজন ব্লগার আলাদা হয়ে শুরু করেছিলেন সচলায়তন বা সংক্ষেপে সচল ব্লগ। এটি বন্ধ হবার মূল কারণ উল্লেখ করা হয়েছে দুটি:

১)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×