somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোট ছোট ছোটগল্প

০৩ রা জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৪:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

টিপ
আমি মানতে পারি না, ভাবতে পারি না, কোন সাজগোজ ছাড়া ও চলে যাবে। সাইত্রিশ বছর একসাথে বসবাস। কখনোই দেখিনি নিজেকে এলেমেলো রেখেছো ও। তেমন কিছু নয়, চোখে একটু কাজল, কপালে একটা টিপ, একটা মালা কী দুজোড়া দুল এটুকু সাজ ওর চাই-ই চাই।
এখন কতো নিরাভরণ লাগছে ওকে। মুখটা ফ্যাকাশে, বিবর্ণ। ¯্রফে সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটা প্রাণহীন পুতুল। এতো অচেনা কখনো মনে হয়নি ওকে।
ঘুমুতে যাবার আগেও একটু লোশন, ক্রিম মাখানো ওর অভ্যাস। আজ লোশন ছাড়া, ক্রিম ছাড়া কীভাবে ঘুমোবে। ডিওডোরেন্ট স্প্রেও করেনি।
আতর, লোবান এই সব তো কখনো ও ব্যবহার করেনি। এইসব পছন্দও করতো না। মরা বাড়ি থেকে দূরে থাকতো বরাবর। এতো প্রাণবন্ত মানুষটাকে মরা বাড়িতে মানাতোও না। সেই মানুষটা ¯্রফে কয়েকটা সাদা কাপড় আর আতর লোবানের আড়ালে কী করে অনন্ত নিদ্রা যাবে!
আমি ওর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারটা খুলি। তখন কেউ কোন পাশে নেই। পকেটে লুকিয়ে নেই ওর প্রিয় জিনিসটি।
সবাই মিলে ওকে কবরে নামিয়ে দেয়। তারপর আমি সবাইকে বলি, এই তো শেষ দেখা, আমাকে ওর কাছে একটু একা থাকতে দাও।
মিনিটের জন্য সবাই একটু সরে দাঁড়ায়। আমি ঝুকে আসি ওর মুখের কাছে। কাপড়টা একটু সরাই। পকেট থেকে টিপটা বের করে ওর কপালে পড়িয়ে দেই।
তারপর মাটি চাপা দিয়ে দেই।
আশা করি মহান সৃষ্টিকর্তার ওর কপালের টিপটিকে অপছন্দ করবে না।

নাক ডাকা
ইহা অত্যন্ত বিছ্ছিরি ব্যাপার। বিশেষত সুন্দরী নারীদের নাক ডাকা। আমি কখনো ভাবতেই পারি নাই, আমার বউ নাক ডাকিবে। এক বিছানায় পাশে শোয়া মানুষটি অনবরত নাক ডাকিয়া গেলে ঘুুমের কী পরিমাণ ব্যাঘাতই না হয়! এই জন্য আমরা বিছানা আলাদা করতে বাধ্য হইয়াছি। ভালই চলিতেছিলো। তারপর একদিন সে বাসায় ফিরিবার পথে রিকশা থেকে পড়িয়া গেলো। ইচ্ছা করিয়া পড়ে নাই, পেছন থেকে একখানা দামী গাড়ি ধাক্কা মারিলো। এক ধাক্কাতেই যা ঘটার ঘটিয়া গেলো। পায়ের ফিবুলা নামের হাড্ডি ভাঙিলো, গোড়ালি আলাদা হইয়া গেলো। ডাক্তার অপারেশন করিতে বলিলো। প্রায় তিন ঘণ্টা অপারেশন করিয়া ওর পায়ের ভেতর পাত, স্ক্রু ইত্যাদি লাগাইয়া দেয়া হইলো। মাঝরাতে ওকে কেবিনের বিছানায় দেওয়া হইলো। মরফিন দেওয়া আছে, সে তখনও অচেতন, নাক ডাকিতে থাকিলো। অপারেশন সাকসেসফুল শুনিয়া আমিও পাশের বিছানায় শুইতে গেলাম। অমনি চিৎকার! ব্যথায় ককিয়ে উঠছে আমার বউ। পারলে নিজের চুল ছেঁড়ে। মাঝরাতে ডাক্তার-নার্স ছোটাছুটি। পেইনকিলার দেয়া হইলো। ব্যথা কিছুক্ষণের জন্য মরিলো। আবার ঘণ্টাখানেক পরেই চিৎকার। আবার আরেকখান পেইনকিলার। আবার নাক ডাকিবার শব্দ। আমার চোখে ঘুম লাগিতে না লাগিতেই পুনরায় চিৎকার। এইবার ডাক্তার বলিলো, ব্যথা একটু হইবেই, সইতে হইবে, এর বেশি পেইনকিলার দেওয়া যাইবে না। আমি তাহার মাথার কাছে বসিলাম। হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলাম। আস্তে আস্তে সে ঘুমাইতে লাগিলো। সে আরামে নাক ডাকিতে লাগিলো, এই প্রথম তাহার নাক ডাকায় স্বস্তি পাইলাম।

মারিয়া সিবিলিয়ান মারিয়ান
মারিয়ান মারা গেলেন অশুভ একটা দিনে। ১৩ জানুয়ারি, ১৭১৭ সাল। প্রায় দুই বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্থ ছিলেন তিনি। কিন্তু কাজ থামাননি। কাজ অবশ্য তেমন বড় কিছু নয়। পোকামাকড়, ফুল, প্রজাপতি, সাপ, ব্যাঙের ছবি আকা। এইসব হাবিজাবি ছবি বিক্রি করেই তার দিন চলে। কিন্তু সে আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেলো। ক্রমশ হাত পা আরো অবশ্য হয়ে গেলো। মারিয়ান আর ছবি আঁকতে পারে না। ক্রমশ সে দেওলিয়া হয়ে যায়। এই দূর্দিনে মেয়ে ডরোথি দেখলো, তার পক্ষাঘাতগ্রস্থ মায়ের বিছানার চারপাশে প্রজাপতি এসে বসে, মাকড়শারা ঘরের কোণায় ঘুরঘুর করে, টিকটিকিরা হেঁটে যায় দেয়াল জুড়ে, জানালা দিয়ে লতানো গোলাপ উঁকি দেয়, বাহারি গুবড়ে পোকারা মারিয়ানের আঁকার খাতার উপরে হেঁটে বেড়ায়। মারিয়ান ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে। তারপর দেখতে দেখতে ১৩ তারিখ এসে যায়। কফিনে ভরে তাকে শুইয়ে দেয়া হয় আর্মস্টার্ডামের এক গোরস্থানে। সেইখানেও দেখা গেলো আজব কা-। প্রতিদিন দলে দলে পোকামাকড়রা এসে তার কবরে জমায়েত হয়। কবরের বুক জুড়ে, কোল ঘেষে, অচেনা সব বুনো ফুল লতা গজিয়ে উঠে। মারিয়ার মৃত্যুর পর ডরোথি মায়ের আঁকা ছবিগুলো নিয়ে বই প্রকাশ করে। সে বইয়ের সুবাদে মানুষ বুঝতে পারে, সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার সাপ, ব্যাঙ, প্রজাপতি আর ফুলেরা নেদারল্যান্ডের একটি কবরে এসে ভিড় করেছে। মানুষ চিনতে পারেনি, পোকামাকড় আর ফুলেরা ঠিকই চিনেছে তাদের প্রিয় মারিয়ানকে। তাই আজও সাদরে বরণ করে রেখেছে তাকে।

গল্পের বাইরের তথ্য : জন্মের ৩৬৬ বছর পর সুইস প্রকৃতি বিজ্ঞানী, চিত্রকর মারিয়া সিবিলিয়ান মারিয়ানকে আজ বিশ্বের অন্যতম একজন নারী বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসাবে গণ্য করা হয়। ২ এপ্রিল তার ৩৬৬তম জন্মদিনে গুগলের ডুডলে উঠে আসে তার আঁকা কয়েকটি পোকামাকড় আর লতাপাতা।

অনডিনসের অভিশাপ
পৃথিবীতে মাত্র ২০০ অভিশপ্ত লোক আছে, তাদের মধ্যে আমি একজন। অনডিনস নামের এক দেবী তার চরিত্রহীন স্বামীকে অভিশাপ দিয়েছিলো, তুমি ঘুমাতে পারবে না, ঘুমালেই নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যাবে, তোমার মৃত্যু হবে। আমি চরিত্রহীন না, কিন্তু আমার উপরেও এই অভিশাপ জারি হয়েছে। তোমরা হয়তো জানোই না, অনডিনস্্ কার্স একটি দূর্লভ অসুখ। ডাক্তাররা তাদের গাল ভরা ভাষায় একে বলে, কনজেনিটাল সেন্ট্রাল হাইপোভেনটিলেশন সিনড্রোম (সিসিএইচএস)। এই রোগে তুমি ঘুমাতে পারবে না। ঘুমালেই যে কোন সময় মৃত্যু হতে পারে। তোমার মস্তিষ্ক ভুলে যেতে পারে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার কথা। তাই ঘুমানো যাবে না।
আমি ঘুমাই। কিন্তু আমার এই অসুখে ঘুমালে মরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই আমার ঘুমের দাম বেশি। আমি কৃত্রিম শ্বাস প্রশ্বাস ব্যবস্থা নিয়ে ঘুমাই। আয়রন লাংস বা লোহার ফুসফুস নামের এক যন্ত্র আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। আমি যতোক্ষণ ঘুমাই ততোক্ষণ কৃত্রিমভাবে আমার দম ওঠানামা করে। আর তার দাম পড়ে প্রতি রাতে ৪৫ হাজার টাকা। টাকা কোন বড় সমস্যা না, আমার বাবা দুইবার মন্ত্রী ছিলেন। আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট টাকা তার আছে। গাড়িতে, চলার পথে, যে কোন আড্ডায় খেয়াল রাখা হয় আমি যেন ঘুমিয়ে না পড়ি। লাইফ সাপোর্ট ছাড়া আমার ঘুমানো নিষেধ। কিন্তু আমার মগজে একটা কবিতা ঘোরে, ঘুমায়ে পড়িবো, কোনোদিন জাগিবো না আর, জাগিবার গাঢ় বেদনার অবিরাম ভার সহিব না আর...।
আমি আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দুপুর বেলা অভিশাপ মুক্ত হবো। জাগিবার গাঢ় বেদনা থেকে মুক্ত হবো, একেবারে ঘুমিয়ে যাবো, কাউকে কিচ্ছু না বলে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১৩ দুপুর ১২:৪১
৮টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×