১.
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে আছে ডিনা।
একটা জরুরি নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছে ও। নির্দেশনা পেলে অনেকগুলো কাজ করতে হবে। এই অপেক্ষাটা তাই অত্যন্ত দুর্বিসহ লাগছে ওর কাছে। কিন্তু নিজে নিজে কিছু করা যাবে না। তথ্যটা আগে চাই।
প্রায় পাঁচ মিনিট হলো মিরেনকে সে পাঠিয়েছে রিবোর কাছে। একটা জরুরী বার্তা নিয়ে গেছে মিরেন। রিবো সে বার্তাটা পড়তে পারলে হয়!
আজ সকাল থেকে খুব বড় ধরনের একটা গোলমাল যাচ্ছে ডিনার চারপাশ জুড়ে। খুব সুরক্ষিত একটা জায়গায় বাস করে ডিনা । কখনোই এই সুরক্ষা দেয়ালের বাইরে যায়না ও। কিন্তু তারপরও চারপাশের অস্থিরতা বুঝতে পারে। এমন ঘটনা অবশ্য এই প্রথম নয়। প্রায়ই এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। আর এসব সময়ে ডিনাকে খুব সতর্ক থাকতে হয়। মিরেনের মাধ্যমে রিবোর সাথে যোগাযোগটাও বাড়িয়ে দিতে হয় বহুগুণ। সে যোগাযোগটা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ভিন্ন। অনেক দ্রুত এবং নির্ভুল। কোন রকম এদিক সেদিক হলেই বিপর্যয়। ডিনা অবশ্য এখনো বড় ধরনের কোন সমস্যার মুখে পড়ে নি এ নিয়ে। মিরেন অনেক দক্ষতার সাথে তার দায়িত্ব পালন করে আসছে।
আরো বেশ কিছুটা সময় পাড় হয়ে গেলো। ঠিক কতটা সময়? ডিনা ঠিক বুঝতে পারে না। অপেক্ষার মুহুর্তগুলো সবসময় দীর্ঘ হয়।
ক্রমশই অস্থিরতা বাড়ে ডিনার। কিছু একটা ভাবতে যাচ্ছিল, হঠাৎ শরীরের ঠিক মাঝখানে একটা প্রচন্ড আঘাতে ভারসাম্য হারায় ডিনা। তারপর একটা তীক্ষ্ম ছুড়ির ধার বোধ করে পেটের দিকটায়। মুহুর্তে ডিনার শরীরটা বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। পুরো ঘটনা ঘটতে সময় লাগে মাত্র কয়েক সেকেন্ড। ডিনা প্রচন্ড ব্যাথায় আঁতকে ওঠে থেমে যায়। চোখ বুজার আগ মুহুর্তে হঠাৎ তার মনে হয় টিফান তার কপাল ছুয়ে গেছে। আর কিছু অনুভব বা ভাবার সুযোগ পায়না ডিনা। নিঃসার হয়ে পড়ে তার দু’টুকরো শরীর।
টিফান বেশ খানিক্ষণ বিমূঢ হয়ে থাকে ঘটনায় আকস্মিকতা ও ভয়াবহতায়। ডিনা তাদের সবার জন্য কত প্রয়োজনীয় তা এখানকার ছেলে বুড়ো প্রত্যেকে জানে। তারা যেভাবে থাকে সেটা একক এবং সামষ্টিক দিক থেকে আলাদা যেমন তেমনি একও বটে। টিফান জানে তাদের এই এলাকার বাইরেই রয়েছে আরো এরকম লক্ষ লক্ষ বাসস্থান। সেখানেও তার মতো অনেকেই আছে। আছে ডিনার মতো, রিবোর মতো, মিরনার মতো সবাই। তারা জানে পরষ্পরের উপস্থিতি। এবং তাদের প্রত্যেকের সুস্থতার উপরই নির্ভর করে তাদের টিকে থাকা। যে কেউ এক জায়গায় সমস্যায় পড়লে তার প্রভাব পড়তে পারে আশপাশের আরো কয়েক জায়গায়। এমনও ঘটে বাইরের ইন্ধনে অনেকে বিগড়ে যায়। তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তাদের দমন করার জন্য ব্যবস্থা নেয় কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা বিভাগ। সমূলে বিনাশ করেই তবে ক্ষান্তি মিলে। এটা না করে উপায় থাকে না। বৃহত্তর স্বার্থে কাউকে না কাউকে তো হারাতেই হবে। ঘটে আরো অনেক বিচিত্র ঘটনা। হঠাৎ বহিশত্রুর আক্রমণ হয় তাদের জগতে। হাজার হাজার এলাকা ধ্বংস হয়ে যায়। এই ধ্বংসের খেলাটা শুরু হয় ডিনাকে দিয়ে। ডিনাকে কোনভাবে দখলে নিতে পারলেই সমগ্র এলাকাটা হয়ে ওঠে শত্রুর সহজ বিচরণভূমি। টিফান, মিরনা, রিবো সবাই তখন শত্রুর হয়ে কাজ করে। অন্যের ক্রিড়ণক হয়ে কাজ করা কী যে মানসিক যন্ত্রনার বিষয়। কিন্তু কিছু করার থাকে না তাদের। তখন তারা নিজেরই প্রার্থনা করতে থাকে কেউ এসে তাদের ধ্বংস করে দিক। বুঝে শুনে শত্রুর হাতে দেহমন সপে দেয়ার বোঝা থেকে মুক্তি চায় তারা।
আজ কী এমনই কিছু ঘটলো? ডিনার ওপর প্রথম আঘাতটা অন্তত তাই মনে করিয়ে দেয় টিফানকে। অন্ধকার ভবিষ্যতের আশঙ্কায় পাংশু হয়ে যায় তার মুখটা। কী করবে ভাবে? ডিনাকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টাটা করবে? করতেই হবে। এটাই তাদের সত্যিকার বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।
টিফান কাছে টেনে নেয় ডিনার নিস্তেজ শরীর। ভালোভাবে খেয়াল করে। ওর চোখের দিকে তাকায়। কোথায় যেন একটা হালকা জ্যোতি এখনো লেগে আছে। মুখটা ফ্যাকাসে হয়েছে বটে কিন্তু এখনো ঠিক প্রাণহীন বোধ হয় না। কী মনে করে টিফান দ্রুত হাত দেয় ডিনার পেটের দিকে, যেখানে তার দেহটা খন্ড হয়ে গেছে। গায়ের হালকা পলিমারের পোশাকটা একটু টেনে তোলে। সপসপ রক্তে ভেসে চুপসে গেছে পোশাক। টিফান ধীরে ধীরে সড়ায় পোশাকের আবরণ। ডিনার শুভ্র শরীরের কিছু অংশ উন্মুক্ত হয় ওর চোখের সামনে। ছিন্ন, রক্তে ভেজা।
আরো একটু গভীরভাবে দেখতে যাবে টিফান হঠাৎ ডিনার গলার দিকটায় চোখ যায় ওর। গলার কাছে একটা শক্ত আবরণ থাকার কথা ডিনার। ওটা সবসময় থাকে। টিফান সন্ধিগ্ধ চোখে আরো কাছে যায়। আতঙ্কিত চোখে আরো গভীরভাবে খেয়াল করে। মনে মনে প্রার্থনা করে- যা ভাবছে তা যেন না হয়। যেন দেখে অন্তত একজায়গায় হলেও আবরণটা আছে ডিনার গলায়। দ্রুত হাত দিয়ে খানিকটা পোশাক সরায়। নিজের চোখেই বিশ্বাস হয় না। একে একে সবগুলো জায়গা পরীক্ষা করে। ডিনার গলা থেকে বুক পর্যন্ত মিথেনের আবরণ থাকার কথা। সেটা নেই। কোথাও নেই। আকাশ থেকে তারার খসে পড়ার মতো সেগুলো উধাও হয়ে গেছে। বুঝতে বাকি থাকে না টিফানের। ঘরে শত্রু বিভীষণ- মনে মনে আওড়ায়। তারপর আতঙ্কের মাঝে কোথায় যেন একটা আশার আলো ঝিলিক দেয় ওর চোখের ভেতর।