somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুপার হিরো

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৯:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হুমায়ূন আহমেদ

হিরো একটি পশ্চিমা কনসেপ্ট। এদের কমিক বইয়ে হিরো আছে (ব্যাটম্যান, স্পাইডারম্যান, সুপারম্যান), বাস্তবেও আছে।
আমাদের তেমন কিছু নেই। মাঝেমধ্যে এক-আধজনকে পাওয়া যায়— ভাঙা রেললাইনের সামনে গামছা নিয়ে দাঁড়িয়ে ট্রেন থামায়। অনেকের জীবন রক্ষা করে। আমরা কিছুদিন তাকে নিয়ে হইচই করে ব্যাক টু দ্যা প্যাভিলিয়ন। উল্টো ব্যাপারও আছে, পুরো ট্রেন জ্বালিয়ে দেওয়া।
পশ্চিমা একজন হিরোর গল্প দিয়ে আজকের লেখা শুরু করছি। তার নাম টেরি ফক্স। কানাডার এক যুবক। মাত্র বাইশ বছর বয়সে ভয়াবহ ক্যানসার (osteosarcoma) তাকে আক্রমণ করল। তার একটি পা কেটে ফেলে দিতে হলো। টেরি ফক্স হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ভাবলেন, ক্যানসার গবেষণার জন্যে আরও অর্থ প্রয়োজন। তিনি ঘোষণা করলেন, এক পা নিয়েই তিনি কানাডার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত দৌড়ে ক্যানসারের জন্যে অর্থ সংগ্রহ করবেন।
আটলান্টিক সমুদ্রে পা ডুবিয়ে তিনি দৌড় শুরু করলেন। তত দিনে একটা নকল পা লাগানো হয়েছে। এক শ তেতাল্লিশ দিন পর্যন্ত তিনি নকল পায়ে দৌড়ালেন। ৩,৩৩১ মাইল অতিক্রম করে তাকে থামতে হলো। কারণ ক্যানসার তখন ফুসফুস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। মাত্র তেইশ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। তিনি ক্যানসার রিসার্চের জন্যে রেখে গেলেন সংগ্রহ করা এক শ মিলিয়ন ডলার। এখন সংগ্রহ পাঁচ শ মিলিয়ন ছেড়ে গেছে।
ক্যানসার রিসার্চের অর্থ সংগ্রহের জন্যে বিশ্বজুড়েই টেরি ফক্স ম্যারাথন হয়। পঁচিশতম ম্যারাথনে পৃথিবীর তিন মিলিয়ন মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। আমার যতদূর মনে পড়ে, বাংলাদেশেও এই ম্যারাথন হয়েছে।
ক্যানসার হাসপাতাল ও গবেষণাকেন্দ্রের জন্যে আমরা অর্থ সংগ্রহে নামতে যাচ্ছি। আমাদের গুরু অবশ্যই টেরি ফক্স।
আমি টেকনাফে বঙ্গোপসাগরে পা ডুবিয়ে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত যাব। আমার পক্ষে দৌড়ানো সম্ভব না। কারণ শিশুপুত্র আমার দুই পা চেপে ধরে থাকবে। এরা পা চেপে ধরায় ওস্তাদ। আমি পরিবার ছাড়া এক দিনও একা থাকতে পারি না। আমার সঙ্গে আমার দুই শিশুপুত্র এবং তাদের মা থাকবে। আমরা প্রতীকী অর্থে মাঝে মাঝে দৌড়াব। বাকিটা গাড়িতে। এই আনন্দযাত্রায় সবাইকে আমন্ত্রণ।
ক্যানসার ইনস্টিটিউটের জন্যে আমি যে সাড়া পেয়েছি তাতে আমার মনে হয়েছে আমার মানবজীবন ধন্য। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
অভিনেতা রহমত (নয় নম্বর বিপদ সংকেত) আমাকে জানিয়েছেন রাজশাহীতে তাঁর পাঁচ বিঘা জমি দিতে চান। যদি ক্যানসার ইনস্টিটিউট ঢাকায় হয় তাহলে তিনি তাঁর সঞ্চিত পাঁচ লাখ টাকা দিতে চান। এর বেশি তাঁর আর নেই। থাকলে তাও দিতেন।
নিউইয়র্কের বাঙালি ডাক্তার নাহরিন মামুন জানিয়েছেন ঢাকায় তাঁর জমি আছে। পুরোটাই তিনি ক্যানসার ইনস্টিটিউটকে দিয়ে দিতে চান। আমি যখন বলব তখন।
জেনেভা থেকে আনজু ফেরদৌসী জানিয়েছেন, তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সঞ্চয় ১০ হাজার ডলার শুরুতে দিতে চান। এক্ষুনি দিতে চান। পরে যদি কিছু খরচ হয়ে যায়।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আমেরিকার প্রধান প্রধান হাসপাতালে বাংলাদেশের ডাক্তার সন্তানরা প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করে যাচ্ছেন।
পৃথিবীর সেরা অনকোলজিস্টের অনেকেই বাংলাদেশি। একজন অনকোলজিস্ট রথীন্দ্রনাথ বসু ওভারিয়ান ক্যানসারে যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন।
এঁরা সবাই বাংলাদেশের ক্যানসার ইনস্টিটিউটের জন্যে যা করণীয় তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
অনলাইনে দেখলাম, ২৫০ জন নিজেদের ভিক্ষুক ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁরা অর্থ সংগ্রহের জন্যে ভিক্ষার থালা নিয়ে পথে বের হবেন।
আর হিমুর দল তো হলুদ পাঞ্জাবি পরে তৈরি হয়েই আছে। তারা নাচুনি বুড়ি। ঢোলের বাদ্যের অপেক্ষা।
কনফুসিয়াসের বিখ্যাত বাণী সবাইকে মনে করিয়ে দেই। ‘আ জার্নি অব আ থাউজ্যান্ড মাইলস বিগিনস উইথ আ সিংগল স্টেপ’। আমরা কিন্তু প্রথম ‘স্টেপ’ নিয়ে নিয়েছি।
আল্লাহপাক বলেছেন, তোমরা বেহেশতে প্রবেশ করবে হিংসামুক্ত অবস্থায়।
আমাদের ক্যানসার হাসপাতালে একই অবস্থা। তবে হিংসা না, সবাইকে প্রবেশ করতে হবে রাজনীতিমুক্ত অবস্থায়। ডাক্তাররা আওয়ামী লীগ, বিএনপি করবেন, ইলেকশন হবে, মারামারি হবে—তা কখনো না।
পৃথিবীর কোথাও আমি ছাত্রদের এবং শিক্ষকদের রাজনৈতিক দল করতে দেখিনি। এই অর্থহীন মূর্খামি বাংলাদেশের নিজস্ব ব্যাপার। এই মূর্খদের মধ্যে আমিও ছিলাম। ড. আহমদ শরীফ এবং অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অতি শ্রদ্ধেয় দুজন। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সাদা দলে ইলেকশন করেছি। এখন নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হয়। মূর্খ মনে হয়। আমাদের ক্যানসার ইনস্টিটিউটে মূর্খদের প্রবেশাধিকার নেই।
বিশ্বমানের গবেষণা শুরুতেই আমাদের ইনস্টিটিউটের পক্ষে সম্ভব হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। তবে সারা বিশ্বের ক্যানসারের ওপর গবেষণার ফলাফল তারা ব্যবহার করতে পারবেন।
বিদেশি ডাক্তারদের প্রতি আমাদের এক ধরনের মোহ আছে। মোহভঙ্গের সময় এসেছে। বাংলাদেশের সেরা অনকোলজিস্টরা ইনস্টিটিউট চালাবেন। একটি আমেরিকান হাসপাতালে সর্বাধুনিক যেসব যন্ত্রপাতি থাকবে তার সবই থাকবে আমাদের ইনস্টিটিউটে। যন্ত্রপাতি দেখাশোনা এবং পরিচালনার জন্যে দক্ষ শক্তিশালী টিম থাকবে। বর্তমান চিকিৎসা অতিমাত্রায় যন্ত্রনির্ভর।
দামি যন্ত্রপাতি কেনার বাংলাদেশি স্টাইলে আমরা যাব না। কোনো টেন্ডার না। ইনস্টিটিউট ঠিক করবে তার কী যন্ত্র দরকার। তারা সরাসরি কিনবে।
বাংলাদেশি স্টাইল হলো—প্রথমে টেন্ডার ডাকা হবে। ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের পোষা ছাত্র দল ঝাঁপিয়ে পড়বে। টেন্ডার হয়ে যাবে। এখন বিদেশ ভ্রমণ পালা। নানান টিম আলাদা আলাদাভাবে যন্ত্র কেনা এবং তার প্রয়োগ জানতে বিদেশ ভ্রমণ করবে। সবশেষে যাবেন মন্ত্রী মহোদয় (স্ত্রী এবং শ্যালিকাসহ)।
যন্ত্র কেনার পর সবার আগ্রহ শেষ হয়ে যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরে যন্ত্র পড়ে থাকবে দিনের পর দিন। কেউ ছুটিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করবে না। ছুটানোর দায়িত্ব কার এই নিয়ে জটিলতা। যন্ত্র ছোটানোতে আর মালকড়ি পাওয়ার সম্ভাবনা নাই।
এক সময় যন্ত্র ছাড় করা হবে। যন্ত্র বসাতে লাগবে প্রায় এক বছর। তত দিনে যন্ত্র বেঁকে বসেছে। এটা একটা সুসংবাদ, কারণ যন্ত্র কেন কাজ করছে না এটা জানার জন্যে বেশ কিছু দল আবার বিদেশ সফর করবে। স্ত্রী-শ্যালিকাসহ মন্ত্রী মহোদয় আবারও যাবেন।
পাদটীকা
বাংলাদেশের একজন রোগী উন্নত চিকিৎসার জন্যে আমেরিকায় এসেছেন। নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি সেরা ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করাবেন। তাঁর রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং বিভাগীয় প্রধান রোগী দেখতে এসে বললেন, আপনার কী কী সমস্যা আমাকে বলবেন?
রোগী চোখ কপালে তুলে বললেন, আপনি বাংলাদেশি নাকি?
হ্যাঁ। আমার বাড়ি চিটাগাং।
রোগী থমথমে গলায় বললেন, এত টাকা-পয়সা খরচ করে আমেরিকায় এসে আমি বাংলাদেশি ডাক্তারের চিকিৎসা নিব না। আমেরিকান ডাক্তার লাগবে। বাংলাদেশি দিয়ে চলবে না।

একটা ব্যাপার আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়েছি, তখন পশ্চিমারা বাঁদরের চেয়ে সামান্য ওপরে অবস্থান করছিল।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের শুরুটা আমরা করেছি। চৈনিক ও আরবদের অবস্থান আমাদের নিচে। পাঁচ হাজার বছর আগে আমাদের সার্জনরা প্লাস্টিক সার্জারি করতেন।
কর্কট রোগ (ক্যানসার) সম্পর্কে পাঁচ হাজার বছর আগের ভারতীয় চিকিৎসকেরা নিদান দিয়ে গেছেন। শূন্য এবং অসীম—এই দুই সংখ্যা আমাদের আবিষ্কার।
আমাদের সবার উচিত শৈশবের একটি কবিতা নতুন করে পড়া—
‘আমরা যদি না জাগি মা
কেমনে সকাল হবে?’

সূত্র: প্রথম আলো
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×