somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মসজিদ

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১২ রাত ২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শীত আসি আসি করছে। দক্ষিণের বাতাসটাও ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। বিকেল গড়িয়ে গেছে। পশ্চিমদিকের জারুল গাছটার আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে সুয। এখনো পাতার ফাঁকে ফাঁকে তার দ্যুতি ঝিলিক দিচ্ছে। বিকেলের হিমেল বাতাসটা শালিকখালির পানিতে ভিজে আরো ঠান্ডা হয়ে হোসেন গাজীর পাকা দাঁড়ীতে শীতল পরশ বুলিয়ে গেল। শালিকখালি আগে নদী ছিল, এখন মৃতপ্রায় খাল। দাদীদের মুখে শোনা যায়, খানেদের আমলে এই শালিকখালি নদীতে দিনের বেলা কামট কুমির সাঁতরে বেড়াত।

হোসেন গাজীর দহলিজ ঘরে ছোটখাট একটা মিটিং বসে গেছে। গাজী বাড়ীর প্রায় সব পুরুষ মানুষ উপস্থিত। বয়স্করা হোসেন আলীর কাছ ঘেঁষে বসেছে। হোসেন গাজী, যৌবনে কি উচ্ছৃংখল ছিল সে। এখানেই বসে সারা রাত সে ইয়ার দোস্তদের সাথে তাস খেলে, মদ খেয়ে মৌজ মাস্তি করে কাটিয়েছে। তার বাপ বহুত চেষ্টা করেছে ছেলেকে শোধরাবার। বিয়ের পর হোসেন গাজী এমনিতেই বদলে গেল। ঘর সংসারের দিকে মনযোগ দিল। ভিন গাঁয়ের ইয়ার দোস্তদের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকল। নিজ বংশের লোকেরা আসতে থাকল। বৈঠকি আড্ডায় সন্ধ্যাগুলো এখন এখানে মুখর থাকে। বলতে গেল হোসেন গাজী এখন গাজী বাড়ীর মাথা। টাকা পয়সাও তার আর দশ জনের চেয়ে একটু বেশী আছে।
মুরুব্বীদের থমথমে মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা সিরিয়াস। অবশ্য মুরুব্বীরা কোন মিটিং বা বৈঠকে গেলে গম্ভীর হয়ে বসে থেকে ভারিক্কি আনার চেষ্টা করে।মুরুব্বীরা লম্বা বেঞ্চীতে বসেছে। হোসেন গাজীর বাড়ীর রাখাল ছেলেটা সবাইকে এক প্রস্থ পান দিয়ে গেল। এক খানা হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ারে বসে আছে হোসেন গাজী। ভাবনার সাগরে ডুবে সে গম্ভীর মুখে দাঁড়িতে হাত বুলাচ্ছে।

ফিসফিস করে অনেকেই কথা বলছে। পেছনে বসা যুবকদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। আজ বিকেলে মান্দারডাঙ্গায় বসে আর তাস পেটানো হল না। মাছ চোরা তোবারেক একটু ঠোঁটকাটা স্বভাবের। কথা বলার সুযোগ না থাকলেও সে কথা বলার চেষ্টা করে। এখন সুযোগ পেয়ে সে আর দেরী করল না। সোজা হোসেন আলীর দিকে ফিরে বলল,

“ মিয়া ভাই, এইরাম কিরি চলতি দিলি তো হয় না। এট্টা কিছু না করলি এইবার হবে না। সরদার’রা পাইছে কি হ্যাঁ। উগে জাগায় মজিদ ঘর বানাইছে বুলে কি যন তন আমাগে সাথে এইরাম ব্যাভার করবে। এট্টা উচিত শিক্ষা দিয়া দরকার।”

মজলিশে বসা প্রায় সবাই তোবারেকের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিল। আইজুলের বাপতো চিংড়ী মাছের মত লাফাতে লাগল। হাঁপানির ব্যারাম না থাকলে এখনি গিয়ে এ সরদার বাড়ির সবকটা জোয়ান মরদের মাথা তল্লা বাঁশ দিয়ে থেঁতলে দিয়ে আসত।

হোসেন গাজী মানুষ চরিয়ে খাওয়া পাবলিক। বাপের রেখে যাওয়া জায়গা জমিতে সে সাধারণ গৃহস্থ্য জীবন অনায়াসে কাটাতে পারত। কিন্তু সুদের কারবারে সে এতটাই ফেঁপেছে যে আশপাশের দশ গ্রামের মানুষ তাকে তোঁয়াজ খাতির করে চলে। রাস্তায় বেরুলে সালাম দেয়। যদিও আড়ালে আবডালে এখনো মানুষ তাকে সুদখোর বলে গালি দেয়। তাতে হোসেন গাজীর কিছু আসে যায় না। মানুষের স্বভাব ওইরকম। যার খায় তারই হাগে। চতুর হোসেন গাজী কৌশলে তার সুদখোর পরিচয় মুছে ফেলবে। সবাই জানে। কিন্তু এক সময় ভূলে যাবে। হোসেন গাজী তাই ভূল চাল দিতে চায় না।

ঘতনা অতি সামান্য। জুম্মাবারে ইমাম সাহেব খোতবা পড়ছিলেন মিম্বরে দাঁড়িয়ে। মসজিদ টা বেশ পুরাতন। ব্রিটিশ পিরিয়ডে বাপের দাদারা বানিয়েছিল। পাকা ভিটের উপর টালির ছাদ। মানুষজন তখন কম ছিল। মসজিদের ভিতর তিন কাঁতার মানুষ ধরত। তখনকার দিনে এই গ্রাম থেকে খুলনা টাউনে যেতে হত গহনার নৌকায় চড়ে। সঙ্গে করে দুই তিন দিনের চাল ডাল নিয়ে নিত হত। এই গ্রামের নাম ভাগবাহ। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা প্রত্যন্ত এই গ্রাম সরল জীবনের প্রতিচ্ছবি। যুগ বদলছে। এখন দিনে দিনেই খুলনায় গিয়ে ফিরে আসা সম্ভব। অষ্টাশির ঝড়ে মসজিদ ভেঙ্গে গেলে আবার নতুন করে তোইরী করা হয়। বারান্দার পেছনের কাঁতারে বসে আইজুল সমবয়সীদের সাথে ফিসফিস করে গল্প করছিল। নিশ্চই মজার কোন ব্যাপার। শ্রোতারা হেসে এ ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছে। সামনের কাতারে বসা মাঝবয়সীরা বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু তাদের যেন ভ্রুক্ষেপ নাই। সরদারদের তোঁতলা আক্কাস একটু চ্যাঁতা স্বভাবের। সেই ধমকে উঠল, “ ওই বিয়াদব পোলা, ফুসুর ফাসুর বন্ধ কর। নালি ঘাড় ধইরে মজিদ ঘর তে বাইর কইরে দেব।”

কি গাজীদের গলা ধাক্কা দেবে সরদার বাড়ির আকাইচ্ছা। গাজীদের কয়েকজন কথা পড়ার আগেই উঠে দাঁড়াল। কথা কাটাকাটি আর গালাগালিতে মসজিদ যেন হাটখোলা হয়ে গেল। একটু আগে এখানে শান্ত সমাহিত পরিবেশ ছিল। সবার আল্লাহ ভয় যেন কপ্পুরের মত উড়ে গেল।

হোসেন গাজী সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে নিরবতা ভাংল, “ মজিদ হল আল্লার ঘর। ইডা নে কাইজা ফ্যাসাদ কত্যি নেই। নবী রছুল ব্যাজার হবে মিয়া। আমাগে উচিত আলাদা এক খান মজিদ ঘর বানাইনে। কি কও তুমরা।”

অতি উত্তম প্রস্তাব। সবাই রাজি। কিন্তু সমস্যা হল জায়গা দেবে কে। হোসেন গাজীই সমাধান করল।

“ আমার এই দৌলুজ ঘর খান আমি মসজিদের নামে ওয়াকফ করে দিলাম। পাশে এট্টা পউর কাট্টি হবে। আস্তে আস্তে আমরা মজিদ ঘর টা পাকা করি ফ্যালবানে। আর হাশেম গাজীর ছাবালডা তো চাইর পারা কুরানের হাফেজ। ওই নামাজ পড়াক। কি কও তুমরা?”

সবাই আর কি বলবে। সবাই খুব খুশি। সবাই মিলে মাগরিবের নামাজ পরল দহলিজ ঘরে। দহলিজ ঘরের নাম এক মিনিটেই পালটে হয়ে গেল ‘মজিদ ঘর’।

সপ্তাহ খানেক কেটে গেল। মাটিয়াল রা পুকুর কাটছে। সেই চেয়ার টা জারুল গাছটার নিচে পেতে বসে আছে হোসেন গাজী। তার চোখ মসজিদ ঘরের দিকে। এক সময় মানুষ কত আড্ডা মেরেছে এখানে বসে, বিড়ি তামাক খেয়েছে, তাস পিটিয়েছে। আজ মানুষ যখন এখানে আসে একটা শ্রদ্ধা ভাব থাকে তাদের চোখে মুখে। হালকা সুরে কথা বলে। দুনিয়াবী কথা বলতে গেলে প্রায় বলেই না। ওযু ছাড়া কেউ মসজিদে ঢোকে না। কারো ওযু ভেঙ্গে গেলে সাথে সাথে ওযু বানাতে পুকুর ঘাটে ছুটে যায়। আল্লাহর ভয়েই কি মানুষ এটা করে! তা কি করে হয়? আল্লাহ কি শুধু মসজিদ ঘরগুলোতে বসে থাকে? মানুষ যখন পৃথিবীর পথে পথে পাপ করে বেড়ায় তখন কি তার আল্লাহর কথা মনে থাকে না। নাকি মানুষের ভিতর একটা পূজারী স্বভাব থাকে যা মানুষকে সাকার কিছুর প্রতি বারবার টেনে নেয়। এই স্বভাবের কারনেই কি মানুষ গাছ, পাথর, প্রতিমাকে পুজা করে।বাবরী মসজিদের কথা মনে পড়ে গেল, হোসেন আলী ভেবে পায় না, মানুষ কাকে শ্রদ্ধা করছে, মহান আল্লাহকে নাকি মসজিদ ঘরকে।

পউর = পুকুর
মাটিয়াল = যারা মাটি কাটে
ছাবাল = ছেলে
উগে= ওদের
নালি = না হলে
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যমদূতের চিঠি তোমার চিঠি!!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:০৮

যমদূতের চিঠি আসে ধাপে ধাপে
চোখের আলো ঝাপসাতে
দাঁতের মাড়ি আলগাতে
মানুষের কী তা বুঝে আসে?
চিরকাল থাকার জায়গা
পৃথিবী নয়,
মৃত্যুর আলামত আসতে থাকে
বয়স বাড়ার সাথে সাথে
স্বাভাবিক মৃত্যু যদি নসিব... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×