somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুখারী শরীফের হাদীস : একটি ভ্রান্তি নিরসন

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১২ সকাল ৭:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন সোয়া চৌদ্দশত বছর হলো। আমরা তাঁকে দেখতে পাইনি, তার পবিত্র মুখের কথা শুনতে পাইনি, কিন্তু তাঁর পুরো জীবনের আদর্শ অনুসরণ করে চলছি। তিনি যা আদেশ করেছেন, যা নিষেধ করেছেন, সব জেনে বুঝে মান্য করার চেষ্টা করি।

কীভাবে তা সম্ভব হচ্ছে?
এটা হচ্ছে একমাত্র হাদীসে নবীর উসীলায়। হাদীসের বিশাল বিপুল ভাণ্ডার সামনে রেখে যেন আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই দেখতে পাই। যেন তাঁর যবানের কথাই শুনতে পাই। ইসলামের শুরু যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সব সময়ই আল্লাহ তায়ালা তার মনোনীত এক দল শ্রেষ্ঠ বান্দাকে হাদীস হেফাযতের কাজে নিয়োজিত রেখেছেন। যুগে যুগে অগনিত মুহাদ্দিসীন হাদীসের সেবায় তাদের পুরো জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। হাদীসের জন্য দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আহার-নিদ্রা ছেড়েছেন। পরিবার-পরিজন ও ঘর-বাড়ির কথা ভুলে সরাইখানায় জীবন কাটিয়েছেন। রিজাল শাস্ত্রের কিতাব খুললে পাতায় পাতায় তাঁদের সেসব সংগ্রাম-সাধনার অফুরন্ত নমুনা সামনে আসে।

তাঁদের একেক জন হলেন লক্ষ লক্ষ হাদীসের হাফেয। তাঁদের মধ্যে অনেকে নিজের মুখস্থ হাদীসগুলো গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তবে তাদের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। তাই বলে যারা গ্রন্থ রচনা করেননি তাদের হাদীস হারিয়ে যায়নি। তাদের ছাত্র বা ছাত্রের ছাত্র হয়তো সংকলনে আত্মনিয়োগ করেছেন।

তিনি তাঁর হাজার হাজার শায়খের হাদীস লিপিবদ্ধ করে ফেলেছেন। এভাবে প্রায় দশ-বারো জনের রচনায় বিশুদ্ধ হাদীসগুলো মোটামুটি গ্রন্থবদ্ধ হয়েছে বলা যায়। মুহাদ্দিসীনের জামাত এক বিশালায়তন জামাত। একজনের পক্ষে সবার ছাত্র হওয়াও সম্ভব নয়, সবার হাদীস পাওয়াও সম্ভব নয়।
আমাদের অনেক ভায়েরা আছেন যারা কোনো হাদীস শুনলেই জিজ্ঞেস করেন,এ হাদীস বুখারী শরীফে আছে কি? যদি উত্তর হয় ‘না,’ তাহলে হাদীসটিকে কোনো গুরুত্বই দেন না। তারা মনে করেন, বুখারী শরীফেই শুধু বিশুদ্ধ হাদীসগুলো রয়েছে। এছাড়া সব হাদীস বানোয়াট বা ভিত্তিহীন। হাদীস সংকলনের ইতিহাস দেখলে তাদের এ মানসিকতা কতটা অযৌক্তিক তা সহজেই অনুমান করা যায়। একে তো সব হাদীস একজনের পক্ষে জানাই সম্ভব ছিল না, দ্বিতীয়ত তাদের অনেকেই জানা হাদীসগুলোও সব লিপিবদ্ধ করেননি কলেবর বৃদ্ধির আশংকায়। ইমাম বুখারী রহ. তাদের অন্যতম। ইমাম বুখারী রহ. বলেন, আমি এ কিতাবে শুধু সহীহ হাদীস লিখেছি। আর প্রচুর সহীহ হাদীস কলেবর বেড়ে যাওয়ার ভয়ে ছেড়ে দিয়েছি। (হাদিউস সারী, তাহযীবুত তাহযীব)

বুখারী শরীফ নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ফলে অন্যান্য হাদীস গ্রন্থের প্রতি নিদারুন অবিচার হচ্ছে। সহীহ মুসলিম শরীফ বুখারী শরীফের সমপর্যায়ের রচনা। অনেক বড় বড় মনীষী সহীহ মুসলিমকে সহীহ বুখারীর উপর স্তরের গন্য করেছেন। যেমন- (১) হাফেয আবু আলী নিসাপুরী বলেন, আসমানের নীচে সহীহ মুসলিমের চেয়ে বিশুদ্ধ কোনো (হাদীসের) কিতাব নেই। (২) হাফেয মাসলামা বিন কাসেম কুরতুবী বলেন, ইসলামের ইতিহাসে সহীহ মুসলিমের মত কোনো গ্রন্থ প্রণীত হয়নি।
এছাড়া প্রাচীন স্পেন, মরক্কো ও মিসরের ওলামায়ে কেরামও এই মতামত পোষণ করতেন।

যদিও বেশিরভাগ মনীষী সহীহ বুখারীকে প্রথম স্থানে রেখেছেন, কিন্তু সহীহ মুসলিম বুখারীর কত কাছাকাছি স্থানে আছে তা পূর্বোক্ত মতামত থেকে সহজেই বোঝা যায়। শুধু সহীহ মুসলিম কেন, সিহাহ সিত্তার অন্যান্য কিতাব বা আরো যেসব নির্ভরযোগ্য হাদীসগ্রন্থ আছে সেগুলোর মর্যাদা তুলনামূলক নীচে হলেও কতটুকু নীচে? একটি উদাহরণ থেকে এটা পরিষ্কার হতে পারে। ধরুন, কোনো শ্রেণীতে বিশজন পরীক্ষার্থীর ফলাফল প্রকাশ পেলো। তাতে দেখা গেলো, শফিক মোট ৫০৪ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে। রফিক দ্বিতীয় হয়েছে। সে পেয়েছে ৫০৩ নম্বর। আর রাকিব ৫০১ নম্বর পেয়ে তৃতীয় হয়েছে। এখন এ শ্রেণীতে শফিক সবচে’ মেধাবী স্বীকার করতে হবে। কিন্তু রফিক, রকিব তারা কি মোটেও অবজ্ঞার পাত্র? তাদেরকে অবহেলা করবে এমন পাগল আছে কেউ? আমরা কিন্তু হাদীসগ্রন্থগুলোর সাথে সে আচরণই করছি।

বুখারী শরীফ সর্বাধিক বিশুদ্ধ হাদীসের কিতাব তাতে সন্দেহ নেই। বিতর্কেরও অবকাশ নেই। তবে এ ব্যাপারে দুইটি কথা আরজ করতে চাই-
ক. সহীহ বুখারী সর্বাধিক বিশুদ্ধ সামষ্টিক বিচারে। পৃথক পৃথকভাবে অন্যান্য কিতাবের যে কোনো হাদীস বুখারী শরীফের চেয়ে বিশুদ্ধ হতে পারে, এর অনেক উদাহরণ আছে। একটি উদাহরণ যেমন -
বুখারী শরীফের ১২৮০ (হিন্দুস্তানী সংস্করণ-১২৬৬) নং হাদীসে বলা হয়েছে, যখন আবু সুফিয়ানের মৃত্যু সংবাদ এলো শাম থেকে। একই ঘটনার বর্ণনায় সহীহ মুসলিম (হি. খণ্ড-১, পৃ. ৪৮৭) ও সুনানে বায়হাকী (হাদীস নং ১৫৯২৫) তে এসেছে, যখন আবু সুফিয়ানের মৃত্যু সংবাদ এলো। সেখানে শাম থেকে কথাটি নেই।

ইতিহাসে দেখা যায়, আবু সুফিয়ানের মৃত্যু সর্বসম্মতিক্রমে মদীনায় হয়েছে। সুতরাং এখানে ইমাম বুখারীর ভ্রান্তি বা ওয়াহাম হয়েছে। বোঝা গেলো অন্য কিতাবের যে কোনো হাদীসকে ঢালাওভাবে বুখারীর হাদীসের নীচে স্থান দেয়া যুক্তির চোখে সঠিক নয়।

খ. ধরুন কোনো প্রতিষ্ঠান চাকুরির বিজ্ঞপ্তি দিলো। তাতে শর্ত করা হলো শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি প্রার্থীর সংশ্লিষ্ট কাজে দশ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অপরদিকে আরেকটি প্রতিষ্ঠান একই চাকরির বিজ্ঞপ্তি দিলো। তারা অভিজ্ঞতার শর্ত করলো তিন বছরের। এখন উভয় প্রতিষ্ঠান শর্ত মোতাবেক চাকুরি দেয়ার পর প্রথম প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি তুলনামূলক বেশি যোগ্য হবে ঠিক কিন্তু দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান যাকে নিয়োগ দিলো তাকে দিয়ে কি প্রতিষ্ঠান চলবে না? অবশ্যই চলবে এবং বেশ ভালোভাবে চলবে।
সহীহ বুখারীর ব্যাপারটি ঠিক এমনই। হাদীসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের জন্য মুহাদ্দিসীনে কেরাম যে মানদণ্ড দাড় করিয়েছেন এবং যেসব শর্তাবলি আরোপ করেছেন, ইমাম বুখারী ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে একটি নতুন শর্ত যোগ করেছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুহাদ্দিসীন মনে করেন, হাদীসের বিশুদ্ধতার জন্য সেটি নিস্প্রয়োজন। ইমাম মুসলিম সহীহ মুসলিমের ভূমিকায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, উক্ত অতিরিক্ত শর্তটির কোনই গুরুত্ব নেই। ইমাম মুসলিম নতুন শর্তারোপের কারণে ইমাম বুখারীর সমালোচনা করেছেন এবং তাতে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করেছেন।
তবে হ্যাঁ, আমাদের উদাহরণ থেকে এটা পরিষ্কার যে, এ নতুন শর্ত পূরণ হলে হাদীসের বিশুদ্ধতায় আরো উৎকর্ষ আসে। কিন্তু এ শর্ত পূরণ না হলেও কোনই ক্ষতি নেই।
শুধু বুখারী শরীফ মেনে চলাই যে যথেষ্ট নয় এ ব্যাপারে দুটি চুম্বক যুক্তি দেয়া যেতে পার-

ক. ইমাম বুখারী রহ. তাঁর কিতাবটি বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন অধ্যায়ের শুরুতেও বিসমিল্লাহ লিখেছেন। যে হাদীসের উপর আমল করে তিনি এটা করেছেন সে হাদীসটি বুখারী শরীফে নেই। ইমাম বুখারী নিজেও তো তাহলে বুখারী শরীফের বাইরের হাদীসকে মানতে দ্বিধা করেন না।

খ. সহীহ বুখারীতে প্রায় চারশো বাব তথা পরিচ্ছেদ আছে, যেগুলোর অধীনে ইমাম বুখারী রহ. কোনো হাদীস আনতে পারেননি। তাহলে কি আমরা মেনে নেবো যে, এসব ব্যাপারে হাদীসের কোনো নির্দেশনা নেই? দ্বীন কি তাহলে অপূর্ণাঙ্গ? বুখারী শরীফের বাইরের হাদীস যারা ফেলে দিচ্ছেন তারা প্রকারান্তরে বিশাল বিস্তৃত দ্বীনকেই সংকুচিত করে ফেলছেন।
খোলাসা কথা হলো, আমরা যা করবো বুঝে শুনে বাস্তবসম্মতভাবে করবো। অন্ধের মত কাজ করা বুদ্ধিমানের পরিচয় নয়। বুখারী শরীফ নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি আমাদের মধ্যে কুসংস্কারের মত ছড়িয়ে পড়েছে। এ কুসংস্কার থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, জামে তিরমিযী, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাই,সুনানে ইবনে মাজাহ এ ছয় কিতাবকে একসাথে সিহাহ সিত্তা বা বিশুদ্ধ ছয় কিতাব বলা হয়। এসব কিতাবের অথবা অন্যান্য উল্লেখযোগ্য হাদীসগ্রন্থের কোনো সহীহ হাদীস যখন আমাদের সামনে পেশ করা হবে তখন সেটা মেনে নিতে আমাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা থাকতে পারবে না, এটাই সুস্থ বিবেকের দাবি।

সূত্রঃ মজলিসে দাওয়াতুল হক্ব
১৫টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে আপনি হাদিস শুনতে চান?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:৪৫


,
আপনি যদি সচিব, পিএইচডি, ইন্জিনিয়ার, ডাক্তারদের মুখ থেকে হাদিস শুনতে চান, ভালো; শুনতে থাকুন। আমি এসব প্রফেশানেলদের মুখ থেকে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, বাজেট,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×