somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিকিৎসকের অধিক

০২ রা এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার চিকিৎসক গুলজার আহমেদ পেশাগত শল্যচিকিৎসক হলেও তিনি রোগী দেখেন পেশাগতির চেয়ে অনেক নিবিড়ভাবে। একবার তাকিয়ে আর দুবার প্রশ্ন করেই দুষ্পাঠ্য অক্ষরে খসখস করে ব্যবস্থাপত্র লিখতে শুরু করেন না। রোগীকে যেন তিনি রোগী হিসেবে দেখেন না, ভাবেন একজন ‘মানুষ’ বিপদে পড়ে তাঁর কাছে এসেছে সাহায্যের জন্যে। তাই নিছক টাকার চিন্তা মাথায় থাকে না। তিনি পরম মমতা নিয়েই মানুষকে সাহায্য করেন। সেজন্যেই আমি তাঁকে বলেছি: ইউ আর অ্যা ডক্টর অ্যান্ড মোর দ্যান অ্যা ডক্টর।

অস্ত্রোপচারের পরদিন। গভীর রাত। হাসপাতাল নীরব, নিভৃত। তীব্র ব্যথা উঠল আমার। পাঁচতলায় দায়িত্বরত চিকিৎসকের কথাবার্তা প্রলাপের মতো লাগল। অগত্যা রাত তিনটায় খুদে বার্তা পাঠালাম গুলজার সাহেবকে। তিনি তখন তাহাজ্জুদে মগ্ন। উদ্বেগ নিয়ে ফজরও পড়লেন। ভোরের আবছা আলো ফুটফুট করছে। হরতাল। পিকেটাররা রাস্তায় নামছে। এরই মধ্যে গাড়ি নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। ৫১৬ কেবিনে এসে ঘুমের ওষুধে অবসন্ন আমাকে ডেকে তুললেন। বললেন: ‘মানসিক উৎকণ্ঠায় ভুগছেন বলেই আপনার ব্যথাটা এমন তীব্র। আসলে এ কোনো সমস্যাই না।’ তারপর নার্স ডেকে যন্ত্রপাতি-ওষুধপত্তর নিয়ে লেগে গেলেন কাজে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ক্ষতটা পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত করে দিলেন। পরদিন ছাড়া পাব হাসপাতাল থেকে। বলে গেলেন, বিল শোধের আগে যেন তাঁকে একবার ফোনে কল করি।

তা-ই করলাম। তিনি ক্যাশ কাউন্টারে কথা বললেন। ম্যানেজারকে টাকার অঙ্ক থেকে তাঁর সমস্ত ভিজিট বাদ দিতে নির্দেশ দিলেন। আরো কী বললেন, তখন বুঝি নি। বিলের কাগজ হাতে পেয়ে দেখলাম আরেক দফা কাটাকুটি। ১৬৩২ টাকা বাদ। বাবত: ডিসকাউন্ট বাই চেয়ারম্যান।

ক্লিনিং ও ড্রেসিঙের জন্যে গতকাল ফের গিয়েছিলাম গুলজার সাহেবের কাছে। ইতোপূর্বে আরো একদিন তিনি ভিজিটের টাকা রাখেন নি। তাই কাল আমার প্রস্তুতি ছিল দ্বিগুণ। পাঁচ শো টাকার দুটা নোট আমি টেবিলে রাখলাম। তিনি বললেন, ‘দু শো টাকা দিন।’ অনুনয়ের সুরে বললাম, ‘স্যার, আজকের মতো টাকাটা রেখে দিন।’ আবারো, ‘উঁহু, আমার দু শো চাই।’ অগত্যা একটা নোট সাধলাম। হলো না। বললেন, ‘ভাংতি না থাকলে পরে দেবেন।’ কী আর করা, ব্যর্থ হয়ে খুঁজেপেতে দু শো টাকাই দিলাম। মনে মনে বললাম: “স্যার, ইউ আর অ্যা ডক্টর অ্যান্ড মোর দ্যান অ্যা ডক্টর।”

এ সুন্দর আচরণ আমার প্রতি বিশেষভাবেই করা হয়েছে এমন নয়। আমি মোটেও বিশেষ কেউ নই। অন্যদিকে, আর্থিকভাবে আমি তৈরী হয়েই গিয়েছিলাম, সাহায্যপ্রার্থী ছিলাম না। কাজেই সুন্দর ব্যবহার ও আর্থিক আনুকূল্যের কারণ আমি নই, তিনিই। তিনি সুন্দর মানুষ। বিশেষ মানুষ। তাই তাঁর সবকিছুই সুন্দর ও বিশিষ্ট। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সকল রোগীর প্রতিই তিনি সদয় ও আন্তরিক।

আমাদের রুগ্ণ সমাজে কেউ চিকিৎসক হতে চাইলে মেধার আগে চলে আসে টাকার প্রশ্ন। অঢেল অর্থ ভাঙিয়ে যারা ডাক্তার হন, ঘাটে ঘাটে ঘুষ দিয়ে যারা পদোন্নতি পান, পেশাগত জীবনে স্বাভাবিকভাবেই সেবার চেয়ে তাঁদের কাছে বড় হয়ে ওঠে অর্থ। ফলে দরিদ্র রোগীদের কাছে লোভী ও স্বার্থপর ডাক্তারের অভিধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কশাই। অতি দুঃখজনকভাবে, আমাদের সমাজে ডাক্তারের চেয়ে কশাই বেশি এবং সেবাবৃত্তির চেয়ে শোষণবৃত্তিই প্রবল। এর মূল কারণ মানবিক মূল্যবোধের অভাব। আমাদের শিক্ষাক্রম আমাদেরকে সেই বোধটি যোগায় না। যোগায় অনেক তথ্য, শেখায় কেবল পেশাগত দক্ষতা। সে কারণেই আমরা ভালো চিকিৎসক হতে পারি, ভালো প্রকৌশলী হতে পারি, ভালো অধ্যাপক হতে পারি – কিন্তু ভালো মানুষ হতে পারি না। ইসলাম ছাড়া মানবিক নৈতিকতার পূর্ণ ও স্থির কাঠামো আর কেউ ধারণ করে না। অতএব মুসলিমপ্রধান বাঙলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সকল স্তরকে ইসলামী নৈতিকতার আলোকে ঢেলে সাজানো ছাড়া সুন্দর মানুষ ও সৎ নাগরিক তৈরির কোনো উপায় নেই। গুলজার সাহেবের মতো দু-একজন মানুষ বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে থেকেও যে মহৎ ও সৎ মানুষ হয়ে ওঠেন, তার কারণ প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় শিক্ষা ও জীবনাদর্শের অধ্যয়ন। আমরা বিস্মৃতিপরায়ণ, কিন্তু মহাকালে এমন আদর্শনিষ্ঠ মহৎ মানুষদের আসন উন্নত, অক্ষয়। মহত্তম মানুষ ও সত্যতম মনুষ্যত্বের প্রতি সালাম!

–––––––––––––––––––––––––––––––
তথ্য: ডা. গুলজার আহমেদ; এমবিবিএস; এমএস (সার্জারি); সহযোগী অধ্যাপক, সার্জারি : নর্থইস্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট; প্রাক্তন বিশেষজ্ঞ কলোরেক্টাল সার্জন : স্কয়ার হাসপাতাল ও পিজি হাসপাতাল, ঢাকা; চেম্বার : ইবনে সিনা হাসপাতাল, সোবহানিঘাট, সিলেট;
ফোন: ০১৭১৪১৩৮৪৯২; ইমেইল: [email protected]
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×